আবদুল্লাহ আল মোহন

১.
গিরিশ চন্দ্র সেন শুধু নরসিংদীর বা বাংলাদেশের নয়, গোটা উপমহাদেশেরই একটি অতি পরিচিত নাম। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নামে তিনি অধিক পরিচিত। তাঁর প্রধান পরিচয় ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন – এর প্রথম বাংলা অনুবাদক হিসেবে, বাংলা ভাষায় কুরআন শরীফের সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ তিনিই প্রথম করেন। মুক্তমনা ও অসাধারণ মানুষ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন সাহিত্যিক, গবেষক ও ভাষাবিদ। ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক হিসেবে ‘ভাই’ খেতাবে ভূষিত হন। এ ছাড়া আরবি-ফার্সি ভাষায় ব্যুপত্তি অর্জন ও কুরআন-হাদিসের প্রথম অনুবাদক হিসেবে লাভ করেন ‘মৌলভী’ খেতাব। সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমেই অমর হয়ে আছেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। ১৯১০ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকায় তিনি মারা যান। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী গ্রামের বাড়িতে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মহাপ্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

২.
ধর্মবেত্তা ও অনুবাদক গিরিশচন্দ্র সেন (জন্ম: ১৮৩৫ – প্রয়াণ : ১৫ আগস্ট, ১৯১০) পেশাগত জীবনের প্রথম পর্যায়ে ময়মনসিংহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কাচারিতে নকলনবিশ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে স্বল্প সময়ের জন্য ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করে সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম পর্যায়ে তিনি ঢাকা প্রকাশে কাজ করেন এবং এতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। পরে তিনি ‘সুলভ সমাচার’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক এবং মাসিক ‘মহিলা’ (১৩০২) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর প্রভাবে ১৮৭১ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং প্রচারব্রত গ্রহণ করে উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত ও ব্রহ্মদেশ ভ্রমণ করেন। গুরু কেশবচন্দ্র সেনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি ইসলামি সাহিত্য-সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। এ উপলক্ষে আরবি ভাষা ও ইসলামিক ধর্মশাস্ত্র চর্চার জন্য তিনি ১৮৭৬ সালে লক্ষ্ণৌ গমন করেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে কুরআনের বঙ্গানুবাদ (১৮৮১-৮৬) সম্পন্ন করেন। বাংলা সাহিত্যে এটা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি। ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ, চারিত্রিক উদারতা এবং সত্যবাদিতার জন্য গিরিশচন্দ্র ব্রাহ্ম-হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। এক কথায় তিনি ছিলেন সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীক। তাই সকলের নিকট তিনি ‘ভাই গিরিশচন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

৩.
সুদীর্ঘকাল ধরে প্রায় ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেই সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল যে, মূলভাষা থেকে অনূদিত হলে গ্রন্থটির পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হবে। পবিত্র কুরআন সম্পর্কেও এমন ধারণা ছিল। এ কারণে অনেক মুসলিম মনীষী এর বঙ্গানুবাদ করতে সাহস পাননি। গিরিশচন্দ্র সেনই অন্য ধর্মালম্বী হয়েও এই ভয়কে প্রথম জয় করেন। শুধু কুরআন শরীফের অনুবাদ নয় তিনি ইসলাম ধর্ম বিষয়ক অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক গবেষণাও করেন। পূর্ণাঙ্গ কোরআন শরিফের প্রথম বঙ্গানুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। টীকা-টিপ্পনীসহ নির্ভুল এ অনুবাদ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হলেও এর আগে বেশকিছু প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে, এর প্রথম নিদর্শন হলো মধ্যযুগের কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪১০) ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্য। বইটি আসলে সুরা ইউসুফের অনুবাদ। ১২৭৫ বঙ্গাব্দে পুঁথির ভাষায় কোরআনের আমপারা ও সুরা ফাতিহার বঙ্গানুবাদ করেন কলকাতার আকবর আলী।১৮০৮ সালে পুঁথির ভাষায় আমপারা অনুবাদ ও তাফসির করেন রংপুরের আমিরুদ্দীন বসুনিয়া। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে গোলাম আকবর আলী ‘তরজমা আমছেপারা বাঙ্গালা’ ও মীর ওয়াহেদ আলী ‘কোরআন কালামুল্লাহ ও সাওয়াসসুল কোরআন’ রচনা করে বাংলায় কোরআন চর্চার পথে শামিল হন।রাজেন্দ্রনাথ মিত্র নামে এক খ্রিস্টান কোরআন বঙ্গানুবাদে হাত দিয়েছিলেন। তিনি ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পারা অনুবাদ করেন। অনুবাদ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় লেখক আর এ কাজে মনোযোগী হননি। তারপর পাদরি তারাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮২ সালে কোরআন অনুবাদের ব্যর্থ চেষ্টা করেন।বাংলা ভাষায় কোরআন শরিফের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে। ব্রাহ্মধর্মের নববিধান মণ্ডলীর ধর্মপ্রচারক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন দীর্ঘ চার বছরে এর অনুবাদ ও টীকা-টিপ্পনী শেষ করেন।

৪.
আমরা জানি, খ্রীস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগেই ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বিজেতা মুসলমানদের আগমন হয়। আর বণিক ও ইসলাম ধর্ম প্রচারক হিসাবে তাঁদের আগমন আরো আগে; তবুও মুসলমানদের সর্বপ্রধান ও মূল জীবনব্যবস্থা সম্বলিত মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়নি। বাংলা ছিল তখন প্রায় সাত কোটি লোকের ভাষা; এ ভাষায় রচিত অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদার অধিকারী ছিল। তখন আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষাবিজ্ঞ আলেমের অভাব ছিল না – এঁদের মধ্যে অনেকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর ভাল দখলও ছিল। তাঁদের রচিত ও অনূদিত বিভিন্ন পুস্তক হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এদিকে তাঁদের কারও মনোযোগ ছিল না। জানা যায়, টাঙ্গাইলের মওলানা আমিরউদ্দিন বসুনিয়া এ সময় আমপারার কিছু অংশ কাব্যে অনুবাদের চেষ্টা করেছিলেন. তাঁর কাব্যিক আমপারার অপূর্ণাঙ্গ অনুবাদখানি কাঠের হরফে মুদ্রিত হয়েছিল এবং কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক এবং হযরত মুহম্মদ (স.) এর প্রথম বাঙালি জীবনীকার ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তিনি এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য কেশব চন্দ্র সেনের নির্দেশে, গিরিশ চন্দ্র সেন ১৮৭১ সালে ব্রাহ্মমতে দীক্ষিত হন এবং ইসলাম ধর্ম, আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানার্জনে অগ্রহান্বিত হন। উল্লেখ্য, তিনি বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি, উর্দু ভাষায় পূর্বেই পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। গিরিশ চন্দ্র সেন ছয় বছর (১৮৮১-১৮৮৬ খ্রি) পরিশ্রম করে নিজের বিদ্যার উপর সাহস ও দৃঢ়তা রেখে কুরআন শরীফের প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন। তাঁর এই অনুবাদ মুসলিম আলেমগণ অনুমোদন ও গ্রহণ করলে বিতর্কহীনভাবে গিরিশ চন্দ্র জয়মাল্য পান। মওলানা আকরাম খাঁও গিরিশ চন্দ্রের অনুবাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

৫.
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বর্তমান নরসিংদী জেলার পাঁচদোনা গ্রামে এক বিখ্যাত দেওয়ান বৈদ্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহ্যবাহী সেন পরিবারে ১২৪১ সনের বৈশাখ মাসে, ১৮৩৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে গিরিশ চন্দ্র সেনের জন্ম হয় বলে জানা যায় কিন্তু জন্মের সঠিক তারিখ, দিন অনেক অনুসন্ধান করেও বের করতে পারিনি। গিরিশচন্দ্রের পিতা ছিলেন মাধবরাম সেন এবং পিতামহ ছিলেন রামমোহন সেন।তার প্রপিতামহ ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের ভাই দর্পনারায়ণ নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর দরবারের প্রভাবশালী অমাত্য ছিলেন। নবাব তাকে রায় উপাধি প্রদান করেন। হিন্দু পরিবার হলেও তাদের সুনাম-সুখ্যাতি বা প্রভাব-প্রতিপত্তির কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরবি-ফার্সি ভাষা সংশ্লিষ্ট পান্ডিত্য ও জ্ঞান। এ বংশের আদি পুরুষ দ্বিজদাস সেন পশ্চিমবঙ্গের (মালদহ) অধিবাসী ছিলেন। গিরিশচন্দ্ররা ছিলেন তিন ভাই। ঈশ্বরচন্দ্র সেন, হরচন্দ্র সেন এবং সর্বকনিষ্ঠ গিরিশচন্দ্র সেন। ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পরিবার ছিল অত্যন্ত গোঁড়াপন্থি। পরিবারে সনাতন ধর্মের আচরণ প্রয়োজনের তুলনায় একটু বাড়াবাড়ি রকমভাবেই মেনে চলা হতো। এমন একটি কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে জন্ম নিয়েও গিরিশচন্দ্র সেন একজন সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত মানুষ হয়েছিলেন। অন্য ধর্মের উপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

৬.
প্রাথমিক পড়া শেষ করে গিরিশচন্দ্র ঢাকার পোগোজ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি বেশিদিন বিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা হয়নি। তাঁর বিদ্যালয় ছাড়ার কারণ নিয়ে একটি ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। একদিন তিনি শ্রেণীকক্ষে দেখলেন শিক্ষক তাঁর এক সহপাঠীকে পড়া না পারার জন্য খুব মারছেন। এই দেখে তাঁর মনেও ভয় ধরে গেল, শিক্ষক যদি তাঁকেও মারেন। এই ভয়ে তিনি বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে বাসায় চলে এলেন। তাঁর বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি। এরপর তিনি পাঁচদোনায় নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তার পাশের গ্রাম শানখোলায় কৃষ্ণ চন্দ্র রায় নামে একজন খুব ভালো ফারসি জানা লোকের কাছে গিরিশচন্দ্র ফারসি ভাষা শিখতে শুরু করেন। বছর দুয়েকের মধ্যে ফারসি ভাষা তিনি বেশ ভালো ভাবেই আয়ত্ব করে ফেলেন। গিরিশচন্দ্র ময়মসিংহের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কাজী মৌলবী আব্দুল করিম সাহেবের কাছে রোক্কাতে আল্লামী অধ্যয়ন করেন। ১৮৭৬ সালের আরবি শিক্ষার জন্য গিরিশ চন্দ্র লক্ষ্মৌ যান। লক্ষ্মৌ ব্রাহ্ম সমাজের আনুকূল্যে এবং সহযোগিতায় জ্ঞানবৃদ্ধ মৌলবী এহসান আলী সাহেবের কাছে আরবি ব্যাকরণ ও দিওয়ান-ই-হাফিজের পাঠ গ্রহণ করেন। লক্ষ্মৌ থেকে কলকাতায় ফিরে একজন মৌলবীর কাছে এ বিষয়ে আরও কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর ঢাকায় নলগোলায় মৌলবী আলিমউদ্দিন সাহেবের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্যের পাঠ গ্রহণ করেন।

৭.
বেশ কিছুদিন বেকার বসে থাকার পর তিনি তাঁর মেজভাইয়ের সাথে চাকরির খোঁজে ময়মনসিংহ গমন করেন। সেখানে তিনি ময়মনসিংহ জেলাস্কুলে সহকারী শিক্ষকের (দ্বিতীয় পন্ডিত) পদে যোগদান করেন। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সামান্য এক চাকরির মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলেন না। তাঁর ছিল জ্ঞানের পিপাসা। তিনি নিজে নিজেই পড়াশোনা শুরু করলেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাও শুরু করলেন গিরিশচন্দ্র। তৎকালীন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় তিনি ময়মনসিংহের সংবাদদাতা ছিলেন। তাছাড়া এই পত্রিকায় তাঁর অনেকগুলো লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল।

৮.
চাকরি ছেড়ে দিয়ে গিরিশচন্দ্র কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁর সাথে দেখা হয় রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের তৎকালীন প্রচারক কেশবচন্দ্র সেনের। সে সময় কেশবচন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের নববিধান শাখার প্রধান। তাঁরই প্রভাবে গিরিশচন্দ্র সেন ব্রাহ্ম মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজ তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভাই উপাধিতে ভূষিত করে।

৯.
কেশবচন্দ্রের অনুরোধ ও ব্যবস্থাপনাতে তিনি ফারসি ভাষায় আরো গভীর জ্ঞান লাভ এবং আরবি-ফারসি সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করার জন্য কানপুর ও লখনউ গমন করেন। ফিরে আসার পর কেশবচন্দ্রের উৎসাহেই তিনি ইসলামি দর্শনের উপর গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য প্রধান বাঁধাই ছিল ভাষা। হিন্দু ও খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহ অনেক আগেই বাংলায় অনূদিত হয়েছিল, কিন্তু ইসলাম ধর্মের কোন ধর্মশাস্ত্রই বাংলাভাষায় ছিলনা। বিশেষ করে পবিত্র কুরআন ও হাদিস তখনো বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। যার ফলে কুরআনের মর্মার্থ অনুবাধন করা থেকে বৃহত্তর মুসলিম গোষ্ঠী পুরোপুরিই বঞ্চিত ছিল। তাই ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন পরিচালিত নববিধান সভা ইসলাম ধর্মগ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। স্বাভাবিকভাবেই, আরবি-ফারসি ভাষার সুপন্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন।

১০.
তিনি কুরআন শরীফের সম্পূর্ণ অংশ, মিশকাত শরীফের প্রায় অধিকাংশ, হাদিস, তাজকিরাতুল আউলিয়া, দিওয়ান-ই-হাফিজ, গুলিস্তাঁ, বুঁস্তা, মকতুব্বত-ই-মাকদুস, শারফ উদ্দিন মুনিবী, মসনভী-ই-রুমী, কিমিয়া-ই-সাদত, গুলশান-ই-আসরার ইত্যাদিসহ বহু ইসলামি গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন।

১১.
তাঁর প্রথমগ্রন্থ ব্রহ্মময়ী-চরিত(জীবনী) প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘হিতোপদেশমালা’-র গল্পগুলো ছিল কবি শেখ সাদির গুলিস্তাঁ গ্রন্থের কিছু গল্পের অনুবাদ। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকার গিরিশ প্রেস থেকে। ‘ধর্ম ও নীতি’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালের ১৮ জুলাই কলকাতার ওল্ড ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে। এরপর তিনি ‘আকসিরে হেদায়েত’ থেকে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ‘ধর্ম-বন্ধু’ গ্রন্থটি। এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালের ২০ আগস্ট কলকাতার বাহ্মসমাজ থেকে। তিনি তিন খন্ডে পারস্যের কবি হাফিজের জীবনী, নৈতিক উপদেশ ও বাণীসমূহের অনুবাদ প্রকাশ করেন। এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এবং তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯৮ সালের ১৮ অক্টোবর। তিনটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয় কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ থেকে। ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ নামক গ্রন্থ থেকে তিনি মুসলিম দরবেশদের বাণীসমূহ সঙ্কলন ও অনুবাদ করে প্রকাশ করেন ১৮৭৭ সালের ১৯ আগস্ট। ‘দরবেশদিগের উক্তি (তাসাউফ)’ শিরোনামের এই গ্রন্থটিও প্রকাশ কয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে। উর্দুগ্রন্থ ‘আকসিরে হেদায়েত’ থেকে তিনি মুসলিম দরবেশগণের বাণী সঙ্কলন ও অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ‘নীতিমালা’ শিরোনামের এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালের ১৯ আগস্ট। ‘দরবেশদের ক্রিয়া'(তাসাউফ) প্রকাশিত ১৮৭৮ সালে এবং মুসলিম পীর-দরবেশরা কীভাবে আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত হন, নামাজ আদায় করেন ও কীভাবে তত্ত্বলাভ করেন, এ সম্পর্কিত আলোচনা বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ ‘দরবেশদিগের সাধন প্রণালী’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। কুরআনের বাছাই করা আয়াতের অনুবাদ ‘প্রবচনবলী (ধর্ম উপদেশ)’ প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে ১৮৮০ সালের ২০ জানুয়ারি।ভাই গিরিশ্চন্দ্র সেনের মিশনারিসুলভ কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’-র বাংলা অনুবাদ ‘তাপসমালা’ শিরোনামে একটি ধারাবাহিক গ্রন্থের প্রকাশ। তাজকিরাতুল আউলিয়াতে মোট ৯৬ জন মুসলিম দরবেশের কাহিনী বর্ণিত আছে। এই কাহিনীগুলো ভাই গিরিশচন্দ্র সেন বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি মোট ছয় খন্ডে এই বিশাল অনুবাদ কর্মটি সম্পন্ন করেন।

১২.
অনুবাদক হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি কুরআনের অনুবাদের কাজ শুরু করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে মোট ১২ টি খন্ডে এই অনুবাদক্ররম সমাপ্ত করেন। ‘তাপসমালা’র দুটো খন্ড বের হওয়ার পর ১৮৮১ সালের ১২ ডিসেম্বর কুরআনের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। প্রথম খন্ড প্রকাশের সময় গিরিশচন্দ্র অনুবাদকের নাম গোপন রাখেন। কারণ তৎকালীন সময়ে কাজটি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মুসলিম সমাজে এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণাই ছিলনা। গ্রন্থটিতে শুধুমাত্র প্রকাশক গিরিশচন্দ্র সেন এবং মুদ্রক তারিণীচরণ বিশ্বাসের নাম ছিল। ৩২ পৃষ্ঠার এই খন্ডের মূল্য ছিল মাত্র চারআনা। কিন্তু গিরিশচন্দ্রের আশংকা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হলো। মুসলমান আলেমসমাজ এই মহৎকর্ম সম্পাদন করার জন্য এই অজ্ঞাতনামা অনুবাদকের প্রশংসা করে ব্রাহ্মসমাজের নিকট পত্র প্রেরণ করেন। তাঁদের প্রশংসাপূর্ণ পত্রের অংশবিশেষ নিন্মে তুলে ধরা হলোঃ “ আমরা বিশ্বাস ও জাতিতে মুসলমান। আপনি নিঃস্বার্থভাবে জনহিত সাধনের জন্য যে এতোদৃশ চেষ্টা ও কষ্ট সহকারে আমাদিগের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকার সাধনে নিযুক্ত হইয়াছেন, এজন্য আমাদের আত্যুত্তম ও আন্তরিক বহু কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি দেয়। ” “ কুরআনের উপরিউক্ত অংশের অনুবাদ এতদূর উৎকৃষ্ট ও বিস্ময়কর হইয়াছে যে, আমাদিগের ইচ্ছা, অনুবাদক সাধারণ সমীপে স্বীয় নাম প্রকাশ করেন। যখন তিনি লোকমন্ডলীয় এতোদৃশ্য উৎকৃষ্ট সেবা করিতে সক্ষম হইবেন, তখন সেই সকল লোকের নিকট আত্ন-পরিচয় দিয়া তাঁহার উপযুক্ত সম্ভ্রম করা উচিত। ” কুরআন অনুবাদ শেষ করে ভাই গিরিশচন্দ্র্র সেন বলেছিলেনঃ “ আজ কুরআনের সমাপ্ত দেখিয়া আমার মনে যুগপৎ হর্ষ-বিষাদ উপস্থিত। হর্ষ এই যে, এত কালের পরিশ্রম সার্থক হইল। বিষাদ এই যে, ইহার প্রথমাংশ শ্রী মদাচার্য্য কেশবচন্দ্রের করকমলে অর্পণ করিয়াছিলাম। তিনি তাহাতে পরমাহ্লাদিত হইয়াছিলেন এবং তাহার সমাপ্তি প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। শেষাংশ আর তাঁহার চক্ষুর গোচর করিতে পারিলাম না। ঈশ্বর তাঁহাকে আমাদের চক্ষুর অগোচর করিলেন। তিনি অনুবাদের এরূপ পক্ষপাতী ছিলেন যে, তাহার নিন্দা কেহ করিলে সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ অনুবাদ সমাপ্ত দেখিয়া তাঁহার কত না আহ্লাদ হইত, এছাড়াও তাঁহার কত আশীর্ব্বাদ লাভ করিত। ” কুরআনের সম্পূর্ণ খন্ড একত্রে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালে। সম্পূর্ণ খন্ডেই প্রথম তিনি স্বনামে আত্নপ্রকাশ করেন। ভাই গিরিশ্চন্দ্র সেন অনূদিত কুরআনের চতুর্থ সংস্করণে মৌলানা আকরাম খাঁ একটি প্রশংসাসূচক ভূমিকা লিখেছিলেন।

১৩.
কুরআনের পর তাঁর আর একটি বড় কাজ হাদিসের অনুবাদ। হাদিসও কয়েকখন্ড পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম খন্ড হাদিস-পূর্ব-বিভাগ (১ম খন্ড) প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি। শেষ খন্ড হাদিস-উত্তর-বিভাগ (৪র্থ খন্ড) প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।

১৪.
তাঁর জীবনী গ্রন্থমালা সমূহও মূলত ‘তাপসমালা’র সমতুল্য। ‘মহাপুরুষ চরিত’ প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৮৩ সালে। প্রথম ভাগে ছিল হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও হযরত দাউদ (আ.)-এর জীবনী। দ্বিতীয় ভাগে ছিল হযরত মুসা (আ.)-এর জীবনী। এটি ১৮৮৪ সালের ৬ জানুয়ারি। তৃতীয় ভাগে আছে ইহুদী রাজা কিং ডেভিডের জীবনী। তাঁর ‘জীবনচরিতমালা’-র আরেকটি বড় গ্রন্থ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনী। এর প্রথমখন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ সালের ২৩ জানুয়ারি। দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালের ২৪ জানুয়ারি। তৃতীয় ও শেষ খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালের ২৮ মে।

১৫.
তাঁর রচিত অন্যান্য জীবনীগ্রন্থ হলো: পরমহংসের উক্তি ও জীবনী। এই গ্রন্থে ১৮৪ টি বাণী আছে। প্রকাশকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৩। ইমাম হাসান ও হোসাইন। প্রকাশকাল ১ জানুয়ারি, ১৯০১। বিশ্বাসী সাধক গিরিন্দ্রনাথ। প্রকাশকাল ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৩। চারিজন ধর্মনেতা [ প্রথম চার খলিফা, তথা হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.), হযরত ওমর (রা.), হযরত ওসমান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.)]-এর জীবনী। প্রকাশকাল ২৫ জুলাই, ১৯০৬। সতীচরিত্র ( মহারাণী শরৎ সুন্দরী দেবী-র জীবনী। প্রকাশকাল ২৫ জানুয়ারি, ১৯১১। মৃত্যুর পর প্রকাশিত। চারি সাধ্বী মোসলমান নারী ( হযরত খোদেজা, ফাতেমা, আয়েশা ও রাবেয়ার জীবনী। মৃত্যুর পর প্রকাশিত।

১৬.
তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হলো: তত্ত্ব কুসুম (ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন)। প্র্রকাশকাল ২০ এপ্রিল, ১৮৮২। তত্ত্বরত্নমালা (ফারসি ভাষা থেকে ধর্মীয় নীতিকথার অনুবাদ)। প্রকাশকাল ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৮২। ১৮৮৫ সালের ৮ আইনের সহজ বাংলা অনুবাদ (দুখন্ড)। প্রকাশকাল ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৫। নববিধান প্রেরিতগণের প্রতিনিধি (ব্রাহ্মধর্মের নববিধান সংঘের কার্যক্রমবিষয়ক গ্রন্থ)। প্রকাশকাল ২৪ জানুয়ারি, ১৮৮৭। নববিধান কি? প্রকাশকাল ২৪ ব্জানুয়ারি, ১৮৮৭। তত্ত্ব সন্দর্ভমালা (নববিধানের মূলতত্ত্ব)। প্রকাশকাল ২৭ আগস্ট, ১৮৯৩। কাব্যলহরী (পাঠ্যপুস্তক : কবিতা)। প্রকাশকাল ১৮ জুন, ১৮৯৭। দরবেশী (তাসাউফ)। প্রকাশকাল ১৯ এপ্রিল, ১৯০২। ধর্মবন্ধুর প্রতি কর্তব্য (বিবিধ)। প্রকাশকাল ২২ মার্চ, ১৯০৬। আত্মজীবনী। প্রকাশকাল ১৯০৭। মহালিপি (পারস্যের শরাফত-আল-দীন আহমদ মালিরির পত্রাবলীর অনুবাদ। প্রকাশকাল ১৯০৯।

১৭.
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘সুলভ সমাচার’ নামের দুটি পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন। তৎকালীন পশ্চাৎপদ নারী সমাজের জাগরণে নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন ‘মহিলা’ নামের একটি পত্রিকা। তিনি নিজেই এর সম্পাদক ছিলেন।

১৮.
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন নিজে ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হয়েও বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম অনুবাদ করেছেন কোরআন শরিফ। এ ছাড়া অনুবাদ ও রচনা করেছেন ইসলামবিষয়ক ২৫টি বই। যেভাবে বাংলা হলো কোরআন শরিফ তার ইতিহাস জানার চেষ্টা করা যাক। প্রথমেই প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী গিরিশচন্দ্র সেন কেন পবিত্র কোরআন শরিফ বঙ্গানুবাদে হাত দিয়েছিলেন? এর পেছনে আছে কেশবচন্দ্র সেনের সব ধর্মের সমন্বয়সাধনের চেষ্টা। কিন্তু সমন্বয় করতে হলে তো আগে সেই ধর্মগুলো সম্পর্কে জানতে হবে। তাই সারকথা জানার জন্য প্রধান চারটি ধর্ম ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টধর্মের মূলগ্রন্থগুলো বাংলায় অনুবাদের জন্য চারজন ব্রাহ্মপণ্ডিতকে দায়িত্ব দেন ব্রাহ্মধর্মের নববিধানমণ্ডলীর প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন। আগে থেকেই ফারসি ও কিঞ্চিৎ আরবি জানতেন বলে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন অনুবাদের দায়িত্ব পেলেন গিরিশচন্দ্র সেন। বড় কঠিন কাজ। কোরআন শরিফ ও হাদিস পড়ে তার বঙ্গানুবাদ করার জন্য প্রয়োজন গভীর আরবি জ্ঞান। সত্য বটে, তিনি ফারসি জানেন। ফারসি চর্চা তাঁর পুরুষানুক্রমিক ধারা। কিন্তু ‘গভীর’ দূরে থাকুক, আরবি ভাষা একেবারেই জানতেন না তিনি। আর যেটুকু ইসলামশাস্ত্র ও ফারসি ভাষা তিনি জানেন তা তাঁর নিজের বিচারে ‘পল্লবগ্রাহিনী’ বিদ্যা; কোনো শাস্ত্র ও ভাষায় গভীর জ্ঞান তাঁর নেই। তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। এ বয়সে কি আরবির মতো দুরূহ ও অপরিচিত ভাষা শিক্ষা করে তাতে গভীর জ্ঞান অর্জন করে ইসলামি ধর্মশাস্ত্র বাংলায় অনুবাদ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব? কিন্তু কেশবচন্দ্রের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় সেই দুরূহ কাজেই নেমে পড়লেন তিনি। ‘মোসলমান জাতির মূলধর্মশাস্ত্র কোরাণ পাঠ করিয়া ইসলাম ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব অবগত হইবার জন্য… আরব্য ভাষার চর্চা করিতে’ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লখ্নৌ শহরে পাড়ি দিলেন। আরবি ভাষা শিক্ষা করতে শহরের ব্রাহ্মসমাজের যথোচিত সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি। মৌলবি সাহেবের বেতন এবং তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সমাজ থেকেই করা হয়েছিল। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ‘সুবিজ্ঞ বৃদ্ধ’ মৌলবি এহসান আলী। মৌলবি সাহেবের বয়স পঁচাত্তর, ‘স্থূলোন্নত সবলাকার পুরুষ’। প্রতিদিন সকালে তিনি আসতেন। তাঁর কাছে ‘আরব্য ব্যাকরণ এবং পারস্য দেওয়ান হাফেজের চর্চা’ করতেন গিরিশচন্দ্র। রোজ তিনি তিন-চার ক্রোশ অর্থাৎ ছয় থেকে আট মাইল পথ হেঁটে গ্রামে গিয়ে অধ্যাপনার কাজ করতেন। এক বেলায় এক সের আটার রুটি আর আধ সের মাংস খেতেন তিনি। ‘তাঁহার পায়ের উপযোগী বৃহৎ বিনামা বাজারে ক্রয় করিতে পাওয়া যাইত না, তিনি ফরমায়েস করিয়া মুচি দ্বারা প্রস্তুত করাইয়া লইতেন।’ (আত্দজীবনী: গিরিশচন্দ্র সেন) মৌলবি সাহেব গিরিশচন্দ্রকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। এরপর কলকাতায় একজন মৌলবির কাছে কিছুদিন আরবি ভাষা শিখে ঢাকায় চলে আসেন গিরিশচন্দ্র। নলগোলার মৌলবি আলীমুদ্দীনের কাছে আরবি ইতিহাস ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এ সময়েই তাঁর কোরআন পাঠের আকাঙ্ক্ষা হয়। জানতেন ‘কোনো মুসলমান কোরাণ-বিক্রেতা’ তাঁর কাছে পবিত্র এই ধর্মপুস্তক বিক্রি করবে না। তাই ‘ঢাকা নগরস্থ সমবিশ্বাসী বন্ধু’ মিঞা জামালউদ্দিনের মাধ্যমে একখানা কোরআন কেনেন। গিরিশচন্দ্র লেখেন, ‘আমি তফসির ও অনুবাদের সাহায্যে পড়িতে আরম্ভ করি। যখন তফসিরাদির সাহায্যে আয়াত সকলের প্রকৃত অর্থ কিছু বুঝিতে পারিলাম, তখন তাহা অনুবাদ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।’ উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন বলে তিনি শাহ আব্দুল কাদের ও শাহ রফিউদ্দীনের উর্দু অনূদিত কোরআন থেকে সাহায্য নিতে সক্ষম হন। অনুবাদকালে তিনি যশোরের মৌলবি আলতাফউদ্দীনের কাছ থেকেও পরামর্শ নিয়েছিলেন। রঞ্জন গুপ্তের ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮৮১ সালের শেষভাগে ময়মনসিংহ শহরে অবস্থানকালে কোরআন শরিফ অল্প অল্প অনুবাদ করে খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ শুরু করেন গিরিশচন্দ্র। সর্বপ্রথম তিনি ১৮৮০ সালে কোরআনের একটি ক্ষুদ্র সংকলন প্রকাশ করেন। এরপর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদে হাত দেন। ১৮৮১ সালের শেষের দিকে শেরপুরের চারুযন্ত্র প্রেস থেকে অনুবাদের প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। শেরপুর ছিল তখন ময়মনসিংহ জেলায় ছোট মফস্বল শহর। প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল এক হাজার কপি। বিধর্মীয় হাতে পবিত্র কোরআন অনুবাদ হলে তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পক্ষ-বিপক্ষে চলতে থাকে। গিরিশচন্দ্রের আত্দজীবনীতে উল্লেখ করা হয়, ‘মুসলমান বনু্লদের মধ্যে একজন বন্ধু ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ একজন কাফের করেছেন, তাকে পাইলে তার শিরশ্ছেদন করবো।’ অবশ্য ১৮৮২ সালে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হলে মুসলমান সমাজের কয়েকজন আলেম গিরিশচন্দ্রের কাজকে অভিনন্দিত করেন। মুসলমান জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বঙ্গানুবাদিত কোরআন শরিফের অগ্রিম গ্রাহকমূল্য পরিশোধ করতে থাকেন। যার ফলে পরবর্তী খণ্ডগুলো প্রকাশ সহজতর হয়েছিল। কলকাতার বিধানযন্ত্র থেকে প্রতিমাসে খণ্ডে খণ্ডে বের হতে থাকে কোরআন। প্রায় দুই বছর ধরে কোরআন সম্পূর্ণ অনূদিত ও মুদ্রিত হয়। পরিশেষে সবগুলো খণ্ড একসঙ্গে বাঁধাই করা হয়। ১২ খণ্ডের সম্পূর্ণ কোরআনের মূল্য ধরা হয়েছিল আড়াই টাকা। এ আড়াই টাকা ছিল তখনকার প্রাথমিক শিক্ষকের মাসিক বেতন-সমতুল্য। সম্পূর্ণ কোরআনের প্রথম সংস্করণটি নিঃশেষ হলে ১৮৯৮ সালে কলকাতায় দেবযন্ত্র থেকে বের হয় দ্বিতীয় সংস্করণ। ১৯০৮ সালে কলকাতায় মহালগঙ্গা মিশন প্রেস থেকে বের হয় তৃতীয় সংস্করণ। ১৯৭৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণ বের করে ঢাকার ঝিনুক পুস্তিকা। কলকাতায় হরফ প্রকাশনী থেকে হরফ সংস্করণ হিসেবে তার মুদ্রণ হয় ১৯৭৯ সালে। আস্তে আস্তে অনুবাদটি শিক্ষিত ও ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানদের উচ্চ প্রশংসা লাভ করে। ১২৮৮ বঙ্গাব্দের ৬ ফাল্গুন ইসলামী চিন্তাবিদ মজফর আব্দুল্লাহ এক পত্রে গিরিশচন্দ্রের প্রশংসা করে লেখেন, ‘আপনি যে ধর্ম উদ্দেশ্যে যারপরনাই পরিশ্রম করে এ অনুবাদ করেছেন, এর ফল আল্লাহ আপনাকে ইহ ও পরকালে প্রদান করবেন।’ অনুবাদের প্রশংসা করে চিঠি দেন কলকাতা মাদ্রাসার ভূতপূর্ব আরবি শিক্ষক আহমদউল্লাহ। চিঠিতে বলেন, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের গভীর অর্থ প্রচারে সাধারণের উপকারে নিযুক্ত হয়েছেন, সে জন্য আপনাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।’ তৎকালীন সময়ে কোনো কোনো মাওলানা-মৌলবি গিরিশচন্দ্রকে ‘মৌলভী গিরিশ’ উপাধি দিয়েছিলেন। মুসলমান সমাজ ভালোবেসে তাঁর নামের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন ‘ভাই’। ১৮৭৬ সালে আরবি শেখায় প্রবৃত্ত হয়ে ১৮৮১ সালে মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এমন একটি দুরূহ কাজ সম্পন্ন করাটা আজকের যুগে মনে হয় অলৌকিক। তাই তো মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর কাছে গিরিশচন্দ্রের এই অনুবাদকর্মটি জগতের অষ্টম আশ্চর্য।

১৯.
এবার একটু মামা-ভাগ্নের গল্প শোনা যাক। গিরিশচন্দ্র সেন একজন গর্বিত মামা ছিলেন। তাঁর ভাগ্নেকুল ছিল শিক্ষা-দীক্ষা আর মানগৌরবে জগদ্বিখ্যাত। তাঁর বোন অন্নদাসুন্দরী দেবীর ঘর আলোকিত করেছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রথম আইসিএস ও ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সের প্রথম ভারতীয় সদস্য স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত (১৮৫১-১৯১৬)। ঢাকা পোগজ ও কলেজিয়েট স্কুলের এই কৃতী ছাত্র অক্সফোর্ড থেকে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) ও লিংকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ইংল্যান্ডেই তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁকে কেসিএসআই (নাইট কমান্ডার অব দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া) উপাধিতে ভূষিত করে। কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের ভাই প্যারীমোহন গুপ্ত ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রথম বাঙালি সিভিল সার্জন।তাঁদের আপন ভাগ্নে ছিলেন বাংলা সংগীতের পঞ্চরত্নের অন্যতম অতুলপ্রসাদ সেন (১৮৭১-১৯৩৪)। তিনি অতুলপ্রসাদী সংগীতের জনক। তাঁর মা হেমন্তশশী দেবী ছিলেন পূর্ববাংলার প্রথম বিধবা, যার আবার বিয়ে হয়েছিল। ভাই কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত ও প্যারীমোহন গুপ্তের সহযোগিতায়ই তা সম্ভব হয়েছিল। এই মামাদেরই বদান্যতায় ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার হয়ে আসেন অতুলপ্রসাদ। তা ছাড়া তিনি আপন মামাতো বোন কৃষ্ণগোবিন্দের মেয়ে হেমকুসুম গুপ্তকে বিয়ে করেন প্রেম করে। ১৯০০ সালের দিকে ভাই-বোনের এ বিয়ের শুদ্ধতা নিয়ে যাতে প্রশ্ন না ওঠে, সে জন্য অতুলপ্রসাদ ও হেমকুসুম গুপ্ত ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড এলাকায় বিয়ে করেন।এই অতুলপ্রসাদ সেনেরই খালাতো বোন সরলা গুপ্তের মেয়ে ছিলেন সুপ্রভা রায়। যাঁর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র সত্যজিৎ রায়। নির্মাতা হিসেবে তাঁর সাফল্য নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে সত্যজিৎ রায় শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করতেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত আর মামা অতুলপ্রসাদ সেনের নাম। বলতেন তাঁদের ‘জিন’ বংশ পরম্পরায় তাঁর দেহে প্রবাহিত না হলে তিনি কখনো সত্যজিৎ রায় হয়ে উঠতেন না।

২০.
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন যেমন মানবতাবাদী তেমনই নারীর প্রতি উদার ও সহানুভূতিশীল। নারী জাতিকে জাগ্রত ও মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য ১৩০২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস থেকে ‘মহিলা’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। পাশাপাশি নারীদের সাহিত্যচর্চাও উৎসাহ দিতেন গিরিশ সেন। তাঁর অনুরোধে মহিলা পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন বেগম রোকেয়া। সে সূত্রে দুজনের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠি আদান-প্রদানও হতো। রোকেয়াকে মা বলে সম্বোধন করতেন গিরিশচন্দ্র। মহিলা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি মহিলাবিষয়ক পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন।আত্দজীবনী সূত্রে জানা যায়, তিনি নারীসমাজকে শিক্ষিত, কুসংস্কারমুক্ত ও স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য নিজ গ্রাম পাঁচদোনায় জনহিতকর অনেক কাজ করেছিলেন। এর মধ্যে একটি হলো বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।ময়মনসিংহে অবস্থানকালে মুড়াপাড়ার জমিদার রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। ঠিক তখনই তিনি স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথন ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে স্ত্রী শিক্ষার আবশ্যকতা নিয়ে ‘বনিতা বিনোদ’ নামে একটি গদ্য পুস্তিকা লেখেন। যা তৎকালীন সময়ে বিদ্যালয়ে পাঠ্য বইয়ের মর্যাদা পেয়েছিল।১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ তারিখে সম্পাদিত গিরিশচন্দ্রের উইলটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। উইলে তিনি তাঁর লেখা সব বইয়ের লভ্যাংশের চার ভাগের তিন ভাগ নিজ গ্রাম পাঁচদোনার দুঃখী-বিধবা, নিরাশ্রয় বালক-বালিকা, দরিদ্র বৃদ্ধা ও নিরুপায় রোগী এবং নিঃসম্বল ছাত্রছাত্রীদের অন্ন-বস্ত্র ও চিকিৎসাবিদ্যায় সাহায্যার্থে ব্যয় করার নির্দেশ দেন।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক কালের কণ্ঠ, আনন্দবাজার পত্রিকা, দেশ, ইন্টারনেট)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here