ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো

সুলেখক কবি কমলেশ দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রণীত ‘প্রাচীন চট্টগ্রাম ও সেকালের হিন্দু সমাজ’ গ্রন্থটি ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হবার পরপরই গ্রন্থটি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রন্থটিতে বর্ণিত বিষয় সম্পর্কে আমার কিছু আলোচনা নিচে প্রদত্ত হলো।
চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। লেখক যথার্থই বলছেন যে “এই অঞ্চলের হিন্দু সমাজ ভারতীয় আদি হিন্দু সভ্যতার ও সংস্কৃতির সাথেই সম্পৃক্ত ছিল এবং তারই বিস্লিষ্ট একটি অংশ” (মুখবন্ধ)। লেখকের এই অভিমত সঠিক। মহাকাব্যদ্বয় এবং পুরাণ গ্রন্থ সমূহে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে চট্টগ্রামের উল্লেখ আছে।
গ্রন্থটিকে প্রামাণিক ও তথ্যভিত্তিক করতে গিয়ে লেখক বহু সংখ্যক বিদ্বান ব্যক্তির এবং বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ ও সাময়িকীর সাহায্য নিয়েছেন। গ্রন্থের ভূমিকায় এবং সহায়ক গ্রন্থ তালিকায় তিনি উৎসসমূহের উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রামের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে লেখক বহু সংখ্যক মানচিত্রের উল্লেখ করেছেন। এই মানচিত্রসমূহ বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। লেখক অনেক অর্থব্যয় করে বিদেশ থেকে এই মানচিত্রগুলোর অনুকৃতি সংগ্রহ করেছেন।অনুসন্ধিৎসু পাঠক এবং গবেষকদের পক্ষে এই মানচিত্রগুলি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে বলে আমরা মনে করি। হিন্দু ধর্মের প্রবর্তন সম্বন্ধে লেখক কমলেশ দাশগুপ্ত বলছেন, ‘হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠা বা বিকাশের নেপথ্যে কোনো একক শক্তি কাজ করেনি। প্রাচীন হিন্দু সমাজের যে ছয়টি স্তম্ভ যথা বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ন, মহাভারত ও পুরাণ প্রমুখই হিন্দু ধর্ম ও সমাজের মুখ্য ধারক ও প্রবাহকের ভূমিকা নিয়ে চার হাজার বছর ধরে প্রবহমান” (পূর্বাভাস)। লেখকের এই অভিমত সম্পূর্ণ সঠিক এবং দ্বিমত পোষণ করবার কোন অবকাশ নাই।
লেখক বলছেন যে “হিন্দু সমাজের প্রধান স্তম্ভ বৈদিক শাস্ত্রের সঙ্গে ইরানিয়ান ধর্মশাস্ত্র আবেস্তার সাযুজ্য দেখা যায়” (পূর্বাভাস)। কথাটা সঠিক, কারণ ভারতীয় আর্যরা এবং ইরানীয় আর্যরা একই শাখার (Indo Iranian) অন্তর্ভুক্ত।
হিন্দু ধর্মে জাতিভেদ একটি কৃত্রিম সমাজ ব্যবস্থা। হিন্দু ধর্মে অনেক মুনি ঋষি ব্রাহ্মনেতর বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাধনার বলে তাঁরা উচ্চবর্ণে উন্নীত হয়েছিলেন। লেখক কমলেশ দাশগুপ্ত এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন মুনিঋষির উল্লেখ করেছেন যাঁরা সমাজে ভক্তিভাজন হয়েছিলেন। লেখক যথার্থই বলেছেন, ‘জ্ঞান এবং কর্ম যোগই হিন্দু সমাজের মুখ্য বিধায়ক (পূর্বাভাস, পৃ ৩)।
চন্দ্রনাথ-সীতাকুণ্ড চট্টগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান এবং শক্তি ও শৈব সাধনার কেন্দ্রস্থল। অবিভক্ত ভারতের একান্নটি পীঠস্থানের অন্যতম পীঠস্থান হলো চট্টলে (সীতাকুণ্ড) অবস্থিত দেবী ভবানীর মন্দির। এখানে দেবী পার্বতীর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ হস্ত পতিত হয়েছিল। লেখক কমলেশ দাশগুপ্ত চন্দ্রনাথ-সীতাকুণ্ডে অবস্থিত মন্দির সমূহের বিস্তৃত ও সচিত্র (পৃ ১৭-পৃ ৩৩) বিবরণ দিয়েছেন। এই বিবরণ থেকে চন্দ্রনাথ-সীতাকুণ্ড তীর্থস্থান সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। এ প্রসঙ্গে লেখক ‘চন্দ্রনাথ মাহাত্ম্য ও সীতাকুণ্ড দর্পণ এবং ‘চন্দ্রনাথ ও সীতাকুণ্ড মাহাত্ম্য’ শীর্ষক দু’টি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। এ দুটি পুস্তকই তীর্থযাত্রী এবং সাধকদের নিকট মূল্যবান।

হিন্দুধর্মের সাথে হিন্দু মন্দিরের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। চট্টগ্রামে বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক মন্দির দেখা যায়। অধিকাংশ মন্দির কোন বিশেষ শিল্প শৈলীর অনুসরণে নির্মিত হয়নি। তবে মন্দিরগুলিকে সুদৃশ্য বলা যায়। লেখক তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে প্রায় ৩৫/৩৬ টি মন্দিরের ফটো ক্যামেরা বন্দী করেছেন। অনেক পরিশ্রম করে তিনি মন্দির স্থলে গিয়ে মন্দিরে রঙীন ছবি তুলেছেন এবং ছবির পরিশোধন করেছেন। গ্রন্থকারের নিকট ছবিগুলি মূল্যবান সম্পদ হিসাবে বিবেচনার যোগ্য।
গ্রন্থের তৃতীয় পর্বের আলোচ্য বিষয় চট্টগ্রামে বহিরাগত হিন্দুদের অভিবাসন। অভিবাসনকারীদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লেখক গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করেছেন, প্রধানত উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সাথে পরিচিত হয়েছেন। চট্টগ্রামের বর্ণ হিন্দুদের সম্বন্ধে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন।
লেখকের বিবরণ অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল (বীরভূম, বর্দ্ধমান, হুগলি) থেকে অভিবাসনকারীরা চট্টগ্রামে আগমন করে। কি কারণে তারা নিজেদের বাসভূমি ত্যাগ করে চট্টগ্রামে আসে সে সম্বন্ধে কমলেশ বাবু লিখেছেন যে নবাব আলীবর্দিখানের শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গে মারাঠা দস্যুদের আক্রমণ ও লুটতরাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অধিবাসীরা দেশত্যাগ করে (পৃ.১০০)। লেখকের অভিমত সঠিক বলেই আমরা মনে করতে পারি।
গ্রন্থের চতুর্থ পর্বে শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই পর্বে লেখক শিক্ষার বিভিন্ন দিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি আলোচনা করেছেন।
লেখক চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ, প্রতিটি যুগই নিজ নিজ বৈশিষ্টে সমুন্নত। লেখক প্রতিটি যুগের শিক্ষা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনা যথাযোগ্য হয়েছে।
প্রাচীন যুগের গুরুরা আশ্রমবাসী ছিলেন এবং তাঁদের শিষ্য বা ছাত্ররা তাঁদের সান্নিধ্যেই থাকতেন। ছাত্রদের নিকটে রেখেই গুরুরা প্রত্যক্ষভাবে শিষ্য বা ছাত্রদের নানা বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। এই শিক্ষাদান পদ্ধতি দীর্ঘদিন এমন কি কয়েক বছর ধরে চলত। গুরু যখন মনে করতেন যে তার শিষ্য বা ছাত্রের জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হয়েছে তখনই শিষ্য বা ছাত্র আশ্রম ত্যাগের অনুমতি লাভ করত্‌ এবং সংসার জীবনে প্রবিষ্ট হতো। বেদ উপনিষদের যুগে গুরুর আশ্রমই ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আশ্রমেই চলত ছাত্র শিষ্যদের জ্ঞানের অনুশীলন। ছাত্র-শিষ্যদের কোন নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ছিল না। গুরু বা উপাধ্যায় যা ভাল মনে করতেন তাই ছাত্র-শিষ্যদের নিকট পাঠদান করতেন। তবে বেদ, উপনিষদ, মুক্তপাঠ, ব্যাকরণ, ছন্দ শিক্ষা, শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যা প্রভৃতি সাধারণ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল।
মধ্যযুগে আশ্রমবাসের প্রথা পরিত্যক্ত হয় এবং তৎস্থলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে টোল-চতুষ্পাঠীর আবির্ভাব হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলি যাঁরা পরিচালনা করতেন তাঁরা আচার্য, অধ্যাপক, গুরু, পণ্ডিত মহাশয় ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত হতেন। তাঁরা হয় নিজেদের আবাসস্থলকে (গুরুগৃহ) টোল-চতুষ্পাঠীতে রূপান্তর করতেন নয়তো গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টোল চতুষ্পাঠী নির্মাণ করতেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের বাসস্থান থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতেন। শিক্ষার প্রধান পাঠ্যসূচি ছিল স্মৃতি, ন্যায়, তর্ক, বেদান্ত, ব্যাকরণ, কাব্য, কলাপ, গণিত, জ্যোতিষ ইত্যাদি।
চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন। চট্টগ্রামে কখন প্রথম ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হয়েছিল কিংবা প্রথম ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তি কে ছিলেন তা সঠিক বলা যায় না। তবে এ বিষয়ে অনুমান করা যায়। চট্টগ্রামে (শহরে) প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে। সে সময়ে প্রাইমারি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল। সুতরাং ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দান আরম্ভ হয়। যতদূর জানা যায় চট্টগ্রামে প্রথম ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করেন ডা. রামকিনু দত্ত (১৮০১-১৮৯৪)। তিনি যে শুধু অনর্গল ইংরেজি কথা বলতে পারতেন তা নয়, তিনি ইংরেজিতে কাব্যও রচনা করতে পারতেন। তাঁর রচিত (The Sweet scented armpit of Commissioner & wife) প্রভৃতি কবিতা ইংরেজ শ্রোতৃমণ্ডলীতে তুমুল হাস্যরোল সৃষ্টি করত। ১৮৯১ সালে ইংরেজগণ কর্তৃক মনিপুর দখলের প্রতিবাদে তিনি ১৮৯২ সালে গধহরঢ়ঁৎ ঞৎধমবফু নামে একটি ক্ষুদ্র ইংরেজি কাব্য রচনাও প্রকাশ করেন। ভারতের ভাইসরয় সমেত অনেক ইংরেজ উচ্চপদস্থ রাজপুরুষদের নিকট তিনি ইংরেজিতে স্বরচিত কবিতা উপহার পাঠাতেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের নববর্ষের দিনে তিনি চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার জন বীম্‌স্‌-এর নিকট কয়েকশ পংক্তির একটি কবিতা গ্রন্থ লিখে তাঁর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেন। ফ্রাঙ্কো প্রাশিয়ান যুদ্ধের ওপর তিনি কয়েক হাজার পংক্তির একটি বৃহদাকারের কাব্য লিখে বীম্‌স্‌ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে কাব্যটি তাঁকে পড়তে অনুরোধ করেন। চট্টগ্রামে ইংরেজি শিক্ষার পথিকৃৎ ছিলেন ডা. রামকিনু দত্ত।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর এবং কবি নবীন চন্দ্র সেনের যৌথ প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম কলেজ এফ. এ. কলেজে উন্নীত হয়।
নারী শিক্ষা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন কমলেশ দাশগুপ্ত (পৃ. ১৪৮-১৫২)। সে সঙ্গে তিনি নারীর সামাজিক অবস্থানের ওপরও আলোকপাত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে স্ত্রী শিক্ষার দাবি আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৮৫০ সালে ‘সর্ব শুভকরী’ পত্রিকায় নারী শিক্ষা নিয়ে মদনমোহন তর্কালংকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা ছাপা হয় (পৃ. ১৪৮)। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আর্য নারী সমাজ ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ফিমেল বিদ্যালয়ের পরিচালন ভার গ্রহণ করে (পৃ. ১৪৯)।
১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিখ্যাত বেথুন কলেজ। নারী শিক্ষা বিস্তারে বেথুন কলেজের ভূমিকা একরূপ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। মহিলাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (পৃ. ১৪৯)। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন ১২টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে তিনটি চট্টগ্রামে অবস্থিত (পৃ. ১৫১)।
বহুদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামে মেয়েদের জন্য উচ্চতর কোন স্কুল ছিল না। স্কুলে পড়তে হলে মেয়েদের কলকাতা যেতে হত। সেখানে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়, নিবেদিতা স্কুল প্রভৃতি স্বল্প সংখ্যক স্কুলে তাদের পড়তে হত। অভিজাত পরিবারের মেয়েরা লরেটো, ডাইওসেশন প্রভৃতি ইংরেজি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করতেন। কলেজের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটো, বেথুন কলেজ ও ভিক্টোরিয়া কলেজ। অন্নদাচরণ খাস্তগীরের কনিষ্ঠা কন্যা কুমুদিনী খাস্তগীর চট্টগ্রামে প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। তিনি বেথুন কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেন এবং বেথুন কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস এবং আরো অনেকে বেথুন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি. এ. পাস করেন। চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা সংবাদ সাময়িকীর পরিচালিকা ছিলেন অন্নদাচরণের দ্বিতীয় কন্যা মোহিনী সেন (খাস্তগীর)। তিনি প্রায় সাত বছর ‘পরিচারিকা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। অন্নদাচরণের জ্যেষ্ঠ কন্যা সৌদামিনী গুপ্তা (খাস্তগীর) ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছিলেন।
চট্টগ্রামের মহিলা সমাজ বিশেষ করে ব্রাহ্ম মতাবলম্বীরা যথেষ্ট প্রগতিশীল হয়ে ওঠেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভগিনী সমাজ’। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতেন। কিছুদিন পর চট্টগ্রামে ‘মহিলা সম্মিলনী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সম্মিলনীর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন চপলা বালা গুহ এবং কবি হেমন্ত বালা দত্ত। উভয় সংস্থায়ই নারীর অগ্রযাত্রায় অবদান রেখেছে।
১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে অক্লান্ত সমাজকর্মী যাত্রামোহন সেনগুপ্ত তাঁর শ্বশুর অন্নদাচরণ খাস্তগীরের স্মৃতি রক্ষার্থে মধ্য ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়টিকে উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করেন। বিদ্যালয়টির নামকরণ করেন খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়। প্রায় একই সময়ে তিনি নিজ গ্রাম বরমাতে প্রতিষ্ঠা করেন বরমা ত্রাহি মেনকা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ত্রিশের দশকে (১৯৩২) চট্টগ্রামের অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট অপর্ণাচরণ রায়ের সহযোগিতায় অপর্ণাচরণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৮ সালে রেবতীরমন দত্ত কর্তৃক নিজের গ্রামে নিজের মায়ের নামে মুক্তকেশী উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর পরই চট্টগ্রামের বিভিন্নস্থানে উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
চট্টগ্রামে একমাত্র উচ্চ ইংরেজি সহশিক্ষা বিদ্যালয় সারোয়াতলী গ্রামে অবস্থিত। কমলেশ দাশগুপ্ত আধুনিক যুগের কয়েকজন কৃতী ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ উল্লেখ করেছেন। নিম্নে তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা গেল। অন্নদাচরণ খাস্তগীর (সমাজ সংস্কারক, চট্টগ্রাম কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা), বেণীমাধব দাশ (শিক্ষাবিদ, সমাজহিতৈষী), রেবতীরমন দত্ত (জেলা প্রশাসক, বহু শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠাতা), ড. প্রিয়দা রঞ্জন রায় (নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), ড. বিভূতি ভূষণ দত্ত, বিদ্যারণ্য স্বামী (গণিত বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, দার্শনিক ও ভাগবৎ ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ প্রণেতা), বিনোদ বিহারী দত্ত (বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মচারী), প্রফেসর হীরেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত (শিক্ষাবিদ), ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো (ঐতিহাসিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), কুমুদিনী দাস খাস্তগীর (চট্টগ্রামের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট ও বেথুন কলেজের অধ্যক্ষা), ড. বিভূতি ভূষণ সেন (গণিত বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), ড. সতীশ চন্দ্র খাস্তগীর (পদার্থ বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), ড. নৃপেন্দ্র নাথ সেন (গণিতজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), সুবিমল দত্ত (জেলা প্রশাসক ও রাষ্ট্রদূত) (পৃ. ১৫৪-২০২)
গ্রন্থের পঞ্চম পর্বে কমলেশ দাশগুপ্ত রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। কমলেশ দাশগুপ্ত ঠিকই বলেছেন যে চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন (স্থাপিত ১৮৭৫) চট্টগ্রামে স্বদেশ প্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে (পৃ.২২৯)
ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকে আরম্ভ হলো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। স্বদেশী আন্দোলনকারীরা বঙ্গ ব্যবচ্ছেদকে দেশ মাতৃকার অঙ্গচ্ছেদ বলে মনে করতেন। স্বদেশকে মাতারূপে কল্পনা করা এবং দেশমাতৃকার বন্দনা বঙ্কিমচন্দ্রই সূচনা করেছেন তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতের মাধ্যমে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সভা সমিতি শোভাযাত্রায় দেশ ভরে গেল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি কংগ্রেসের উদ্যোগে প্যারেড ময়দানে এক বিশাল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তৃতা করেন জননায়ক যাত্রামোহন সেন, সমাজ সংস্কারক কমলাকান্ত সেন, কবি শশাঙ্কমোহন সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
১৯০৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর মি. ব্যামফিল্ড ফুলারের চট্টগ্রাম আগমনের প্রতিবাদে শহরের সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল সংঘটিত হয়।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই আরম্ভ হলো স্বদেশী আন্দোলন। ১৮৯০ এর দশকের গোড়াতেই এই আন্দোলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আন্দোলন শুরু হয়েছিল কলকাতাতে। সেখান থেকে এই আন্দোলন দ্রুতগতিতে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যতদূর সম্ভব নিজে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহার করা এবং অপরকে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা। দৈনিক জ্যোতির মতে (৫ আগস্ট, ১৯২৯) ‘১৮৯৪ ইংরেজিতে চট্টগ্রামের কয়েকজন শিক্ষিত যুবক স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের জন্য বদ্ধপরিকর হন।’ স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারে প্রভুত উৎসাহ দেখিয়েছেন নলিনীকান্ত সেন এবং কেদারনাথ দাশগুপ্ত।
জাতীয় বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বদেশী যুগের উল্লেখযোগ্য বিদ্যায়তন হলো ন্যাশনাল স্কুল বা জাতীয় বিদ্যালয়। যাত্রামোহন সেন ও রঞ্জন লাল সেন এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেছিলেন। কমলেশ দাশগুপ্ত এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (পৃ. ২৩০)।
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন দুই দিনের সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চট্টগ্রামে আসেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পরদিন ১৮ জুন সদরঘাটে কমল বাবুর থিয়েটার হলে বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ও দেশবাসীর কর্তব্য বিষয়ে এক সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফর সম্বন্ধে কমলেশ বাবু বিস্তারিত আলোচনা করেছেন (পৃ. ২৩৪-২৩৬)।
শেষ পর্যন্ত প্রবল গণরোষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রহিত করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। আদর্শ, কর্মপন্থা, নেতৃত্ব, জনগণের অংশগ্রহণ প্রভৃতি আন্দোলনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলনকারীরা যে উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তাই পরবর্তী যুগে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ প্রদর্শন করেছে।
জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের (১৩ এপ্রিল, ১৯১৯) নিন্দা জানিয়ে গান্ধীজী সমগ্র ভারতব্যাপী আন্দোলনের আহ্বান জানান।
১৯১৯ সালের ৩০ এপ্রিল ময়মনসিং এ বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতির গৌরবান্বিত পদ অলঙ্কৃত করেন যাত্রামোহন সেনগুপ্ত। সভাপতির ভাষণে যাত্রামোহন মন্টেগু চেমসফোর্ড আইন, রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর এই বক্তব্য সমবেত প্রতিনিধিরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বক্তব্যকে স্বাগত জানান। শারীরিক অসুস্থতাবশত যাত্রামোহন নিজে ভাষণটি পড়তে পারেন নি। তাঁর পক্ষ হয়ে তাঁর সুযোগ্য পুত্র যতীন্দ্রমোহন সম্মেলনে ভাষণটি পড়ে শোনান।
বিক্ষুব্ধ ভারতবাসীরা ১৯১৯ সালের সংস্কার আইন প্রত্যাখ্যান করে। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বায়ত্ত শাসন বা স্বরাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া দেশবাসীরা কোন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী জোর আন্দোলন শুরু হয়। ইংরেজ সরকারের সাথে সর্বপ্রকারে অসহযোগিতা করাই এই আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল। এ জন্য এ আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলন (Non Co-operation Movement) নামে পরিচিত হয়। কালক্রমে অসহযোগিতা বিরোধিতার (resistance) রূপ গ্রহণ করে।
১৯১৯ সালের ২ নভেম্বর কোলকাতায় যাত্রামোহন সেনগেুপ্তের জীবনাবসান হয়। তিনি চট্টগ্রামে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করে গেলেন, পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তাঁরই উপযুক্ত পুত্র যতীন্দ্রমোহনের উপর। অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফৎ আন্দোলনকে একই পথে পরিচালিত করার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেন যতীন্দ্র মোহন।
এই পর্বে কমলেশ দাশগুপ্ত সংক্ষেপে অস্ত্রাগার আক্রমণ এবং জালালাবাদ যুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন। এ সাথে বিপ্লবীদের প্রতিকৃতিসহ জীবনপঞ্জীও সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত হলেও বিষয়সমূহ মূল্যবান হয়েছে।
গ্রন্থের ষষ্ঠ পর্বে বাংলাভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
মধ্যযুগের চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বাংলা সাহিত্যের চর্চা হতো। হিন্দুরাই সাহিত্য চর্চায় অগ্রণী ছিল। এ যুগের সাহিত্যকৃতির বৈশিষ্ট্য হলো মহাভারতের বাংলা কাব্যানুবাদ, শাক্ত দেবদেবীর লীলা বর্ণনা এবং বৈষ্ণব কাব্য বিশেষ করে চৈতন্য চরিত বিষয়ক।
মুসলমান কবিদের বাংলা সাহিত্য চর্চা আরম্ভ হয়েছিল ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। সপ্তদশ শতাব্দীর দু’জন প্রতিভাশালী মুসলমান কবি হলেন ‘নবীবংশ’ রচয়িতা সৈয়দ সুলতান এবং ‘মক্তুল হোসেন’ রচয়িতা মোহাম্মদ খান। উভয় রচনাই মহাকাব্য লক্ষণযুক্ত।
মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তাঁদের অনেকেই বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। মুসলমান বৈষ্ণব পদ রচয়িতাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন চম্পাগাজী, কাজী দানেশ, সৈয়দ সুলতান, আলী রাজা, আলাওল ইত্যাদি।
ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের রচনাশৈলীর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁরা সংস্কৃতি ঘেঁষা বিশুদ্ধ বাংলায় কাব্য রচনা করতেন।
আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্য চর্চা আলোচনা করতে গিয়ে লেখক কমলেশ দাশগুপ্ত নিম্নোক্ত কবি সাহিত্যিকদের জীবনেতিহাস বর্ণনা করেছেন।
বঙ্গীয় রেনেসাঁস যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে রাউজান উপজিলার অন্তর্গত নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এ. পাস করবার পর তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে যোগদান করেন। তেইশ বৎসর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ অবকাশ রঞ্জিনী প্রকাশিত হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ পলাশীর যুদ্ধ প্রকাশিত হয়। অত:পর তাঁর বিখ্যাত কাব্য ত্রয়ী কুরুক্ষেত্র, রৈবতক, প্রভাস রচিত হয়। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ তাঁর জীবনের শেষ প্রান্তে রচিত হয়। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের অনেক কৃতী ব্যক্তির সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
কবি ভাস্কর শশাঙ্ক মোহন সেন (১৮৭২-১৯২৮) ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া উপজিলার অন্তর্গত ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত সাহিত্যে অনার্সসহ বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্র নাথ কলেজ থেকে বি.এল. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের একাদশ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক মোহন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গোপাল দাস চৌধুরী অধ্যাপকের পদে যোগদান করেন। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হলো ‘সিন্দু সঙ্গীত’ (১৮৯৬); শৈল সঙ্গীত (১৮৯৬) স্বর্গে ও মর্ত্যে (১৯২২) বিমানিকা (১৯২৪) কাব্যনাট্য ‘সাবিত্রী’ (১৯০৯) সমালোচনা সাহিত্য ‘বঙ্গবাণী’ (১৯১৫), মধুসূদন অন্তর্জীবন ও প্রতিভা’ (১৯২৮)।
কবি গুণাকর নবীন চন্দ্র দাশ (১৮৫৩-১৯১৪) ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত আলামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৭৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বি.এল. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদান করেন।
প্রধানত সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদক হিসাবে নবীন চন্দ্র দাশ খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশ কুসুম’ ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। ১৮৯১ সালে মহাকবি কালিদাস রচিত কাব্য ‘রঘুবংশম’ এর কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয়। কবি মাঘ এর ‘শিশুপাল বধ’ এরও তিনি কাব্যানুবাদ করেন। কবি ভারবি রচিত ‘কিরাতার্জুনীয়ম’ কাব্যের অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯০৬ সালে। কবি ক্ষেমেন্দ্র রচিত ‘চারুচর্যাশতক’ এর বাংলায় কাব্যানুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে।
তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলির মধ্যে Miracles of Buddha (১৮৯৫), Ancient geography of Asia (১৮৯৬), Antiquity of Ramayana (১৮৯৯) অন্যতম।
উপরিউক্ত গ্রন্থ সমূহ ছাড়া ইংরেজিতে কয়েকটি দীর্ঘ কবিতাও (Long Poem) তিনি রচনা করেছেন।
কবিগুণাকর নবীন চন্দ্র দাশের অবিস্মরণীয় কীর্তি হলো চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘প্রভাত’ এর প্রকাশনা। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ। সম্পাদক ছিলেন পরিষদ এর সভাপতি কবিগুণাকর নবীন চন্দ্র দাশ। পত্রিকাটির প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যার ফ্যাক্সিমিলি ছাপানো হয়েছে কমলেশ দাশগুপ্ত রচিত ‘প্রাচীন চট্টগ্রাম ও সেকালের হিন্দু সমাজ’ শীর্ষক গ্রন্থে।
সুকবি জীবেন্দ্র কুমার দত্ত (১৮৮৩-১৯৩১) ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে আনোয়ারা উপজেলার অন্তর্গত আনোয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি পঙ্গুত্ব প্রাপ্ত হন। তরুণ বয়স থেকেই তাঁর কাব্যচর্চা আরম্ভ হয়। ‘ভাণ্ডার’ ‘নারায়ণ’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘সাহিত্য’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’, ‘বামাবোধিনী’, পত্রিকায় তাঁর রচিত কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর লিখিত প্রধান কাব্যগুলি হলো ‘তপোবন’ (১৯১২), ‘ধ্যানলোক’ (১৯১২) ও ‘অঞ্জলি’। জীবেন্দ্র কুমার তাঁর কাব্য রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
কবি হেমন্ত বালা দত্ত (১৮৮৯-১৯১৬) চট্টগ্রাম শহরে তাঁর জন্ম। তিনি অনঙ্গ চন্দ্র দত্তের কন্যা, সাহিত্য সেবী ডাঃ রামকিনু দত্তের পৌত্রী এবং কবি জীবেন্দ্র কুমার দত্তের অনুজা ছিলেন। তিনি দ্বারভাঙ্গায় মিস রেমাসবটনের নিকট ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। ১৯০১ সালে পিতার কর্মোপলক্ষে ঢাকায় অবস্থানকালে ব্যাপটিস্ট মিশন পরিচালিত জেনানা মিশন স্কুল থেকে তিনি চতুর্থ স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। অত:পর ইডেন ফিমেল স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু পাঠ শেষ হবার পূর্বেই পিতার সঙ্গে তাঁকে চট্টগ্রামে চলে আসতে হয়। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে তিনি খ্যাতনামা সমাজকর্মী কমলাকান্ত সেনের কন্যা চপলাবালা গুহ এর সহযোগে চট্টগ্রামে মহিলা সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনের প্রথম দিনে তাঁর রচিত ‘মাঙ্গলিক শীর্ষক কবিতা পঠিত হয়। চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের মুখপত্র ‘প্রভাত’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তাঁর কবিতা ‘প্রার্থনা’ প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত কবিতার সংখ্যা দুই শতের কাছাকাছি। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘শিশির’ প্রকাশিত হবার অল্প সময়ের মধ্যেই পাঠক সমাজের প্রশংসা অর্জন করে। হেমন্তবালা দীর্ঘজীবী ছিলেন না, সুতরাং তিনি দীর্ঘদিন সাহিত্যসেবা করতে পারেন নি। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এত অধিক সংখ্যক কবিতা রচনা করা বাংলা সাহিত্যে আর কোন মহিলা কবির পক্ষে সম্ভব হয় নি।
গ্রন্থকার কমলেশ দাশগুপ্ত বিগত শতাব্দীতে চট্টগ্রামে সঙ্গীত চর্চা সম্বন্ধে বিস্তারিত ও মূল্যবান আলোচনা করেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে স্বদেশী সঙ্গীত শিক্ষাদানের জন্য ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আর্য সঙ্গীত সমিতি। আর্য সঙ্গীত সমিতির প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে ত্রিপুরা চৌধুরী ও যোগেন্দ্রলাল দত্ত। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গীতাচার্য সুরেন দাশ আর্য সঙ্গীতের পরিচালনার দায়িত্ব নেবার পরেই চট্টগ্রামে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা এবং যন্ত্র সঙ্গীতে পদ্ধতিগত শিক্ষণ শুরু হয়। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আচার্য সুরেন্দ্র লাল দাশ আর্য সঙ্গীত সমিতিতে মেয়েদের জন্য সঙ্গীত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেন। সুরেন দাশের সময়েই আর্য সঙ্গীত সমিতির খ্যাতি কোলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
কমলেশ দাশগুপ্ত ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে চট্টগ্রামের অধুনা বিস্মৃত বেশ কয়েকজন সঙ্গীত শিল্পীর উল্লেখ করেছেন। এঁরা হলেন হরিপ্রসন্ন দাশ, ড. সুবোধ রঞ্জন রায়, প্রিয়দা রঞ্জন সেন, ধীরেন সেন, ধ্যানেন্দ্র নাথ সেন, অলকা দাশ, পরিতোষ হাজারী, মানবেন্দ্র বড়ুয়া, চিরঞ্জীব দাশশর্মা; এবং যন্ত্র সঙ্গীতে যতীন কানুনগো, সৌরীন্দ্র লাল দাশগুপ্ত (চুলুবাবু), সুচরিত চৌধুরী, অজিত রায় গঙ্গাপদ আচার্য প্রমুখ। (পৃ. ৪৬৮)
এই বৃহদাকারের গ্রন্থটি প্রণয়ন করতে লেখক কমলেশ দাশগুপ্তকে প্রভূত পরিশ্রম করতে হয়েছে। আলোচনার উৎস খুঁজতে গিয়ে অবিভক্ত বাংলার বহু স্থানে তাঁকে ভ্রমণ করতে হয়েছে, বহু ব্যক্তির সাথে আলাপ আলোচনা করতে হয়েছে, গ্রন্থাগার ও আর্কাইভ্‌্‌স্‌্‌ এর সাহায্য নিতে হয়েছে। গ্রন্থটিতে প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সমগ্র সময়ে চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজের সামাজিক বিবর্তন, অভিবাসন, বিভিন্ন যুগে রাজনৈতিক অবস্থা, ধর্মীয় অবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি কৃতী ব্যক্তিদের জীবনী আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন দিলীপ দাশগুপ্ত, প্রচ্ছদ অংকিত করেছেন মইনুল আলম, মুদ্রণ করেছেন ফিউচার নামে সংস্থা। পাঠকের সুবিধার কথা মনে রেখে বহু সংখ্যক মানচিত্র সংযুক্ত করা হয়েছে। অধুনা বিস্মৃত বহু কীর্তিমান ব্যক্তির ফটোগ্রাফ দেওয়া হয়েছে। মন্দির এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের রঙিন ফটোর আধিক্য গ্রন্থটিকে এলবামের রূপ দিয়েছে। ফটো ছাপানোর বিষয়ে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। বইটির কাগজ, মুদ্রণ, বাঁধাই উন্নত মানের। এই গ্রন্থটি গবেষকদের খুব কাজে লাগবে। আমি এই গ্রন্থটি পড়ে নিজেও উপকৃত হয়েছি। এরূপ একটি গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য আমরা গ্রন্থকার কমলেশ দাশগুপ্তকে অভিনন্দন জানাই। আমরা গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।

-দৈনিক আজাদীর সৌজন‌্যে

আত্মশুদ্ধি ছাড়া সিদ্ধি লাভ অসম্ভব

For The Roots BY Dr. Ashish Kumar Chowdhury (MBBS, PhD)

মাওলানা আমিনুল হক হারবাংগিরী রচিত ‘ফকির উল্লাস ও ওফাতনামা’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here