মোহাম্মদ ইউনুছ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপম লীলাভূমি চট্টগ্রাম। যুগে যুগে কবি–সাহিত্যিকগণ এ জনপদের এ জনপদের বর্ণনা করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়-ইপমায়। শৈল-কিরীটিনী, নদী মালিনী/ বনানী কুন্তলা..। প্রকৃতি যেন অকৃপন হাতে ঢেলে দিয়েছে তার সব সৌন্দর্য। প্রাচ্যের রাণী এই চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থলের পাহাড়ের চূড়ায় চট্টগ্রা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র অবস্থিত। এটাকে তখন কালেক্টরেট বিল্ডিং বলা হতো। এখন কোর্ট হিল বা কোর্ট বির্ল্ডি বলা হয়। কেউ কেউ কাচারি পাহাড় নামেও অভিহিত করেন। তবে এই পাহাড়ের আদি নাম ‘পরীর পাহাড়’। সেই পরীর পাহাড় এখন বিচারাদালত ভবন। পাহাড় সমান দায়িত্ব ও কর্মচাঞ্চল্য নিয়ে শতাব্দীকাল ধরে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলার প্রশাসনিক ও বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে। চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যাবলি ও এখান থেকে পরিচালিত হতো।
১১৫বছর আগে, ১৮৯৩ খ্রিস্টব্দের দিকে ইংরেজ শাসনামলে শহরের উত্তর এলাকায় অবস্থিত ‘মাদ্রাসা পাহাড়’ থেকে আদালত ও প্রশাসনিক দপ্তরটি তৎকালীন এই পরীর পাহাড় স্থানান্তরিত করা হয়। ফলে এই ভবনের ভিত্তিভূম পাহাড়টি কাচারি পাহাড় বা কোট হিল নামে পরিচিতি লাভ করে।
মোগল আমলে চট্টগ্রাম শহর বলতে কাতালগঞ্জ কাপাসগোলা, চকবাজার, চন্দনপুরা ও আন্দরকিল্লা এলাকাকেই বুঝানো হতো। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি শাসন ও রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বকালে চকবাজারের দক্ষিণ পশ্চিম পাশ্বস্থ পাহাড় শীর্ষে চট্টগ্রাম প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। মাদ্রাসা পাহাড়ে ছিল চট্টগ্রামের আলা সদর আমিন আদালত। মাদ্রাসা পাহাড় সংলগ্ন পশ্চিমের পাহাড় ছিল মুন্সেফি ও অন্য আলাসদর আমিন আদালতটি।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে, কর্মব্যস্ততা ও নানা কারণে শহর আরও সম্প্রসারিত হয় এবং দক্ষিণে নতুন নতুন শহর গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার এই নতুন শহর এলাকাতেই সরকারি অফিস আদালত স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। এই লক্ষ্যে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে জমিদার অখিলচন্দ্র সেনের কাছ থেকে পরীর পাহাড়টি হুকুম দখল করে নিয়েছিল। ১৮৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে পরীর পাহাড়ের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে বিশাল-নান্দনিক দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করে এবং ওই সময়েই সরকারি অফিস-আদালতসমূহ নতুন ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তী পাকিস্তান আমলে তৃতীয় তলার কাজ। সেই থেকে পীর পাহাড় বিচার-আচার ও প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠায় কাচারি পাহাড় বা কাচারি ভবন বা কালেক্টরেট ভবন নামে অভিহিত হয়।
এই আদালত ভবনকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না জড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি ইটের ভাজে ভাজে। কিংবদন্তি এই আদালত ভবনকে নিয়ে আমার স্বপ্ন-সাধনা, জীবনকর্ম ও ঘরসংসার। বেলায় বেলায় এই ভবনে কেটে গেল দুই দশক। হাজারো স্মৃতি ঢেউ খেলে জীবন নদীর বাঁকে। এই লিখার অবতারণায় নষ্টালজিয়ায় হারিয়ে যায়। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে আনন্দ-বেদনার স্মৃতিময় মুহর্তগুলো। ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীর অনুপম নিদর্শন এই ভবন। মোগল আমলের স্থাপত্য ও পাশ্চাত্য রীতির অনুকরণে নান্দনিক গম্বুজ শোভিত হৃদয়গ্রাহী ভবনটি দেখলেই হৃদয়জ নেচে ওঠে। যেন ব্রিটিশ শাসকদের প্রখর ও পরিচ্ছন্ন রুচিবোধ ও আইন-আদালতের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা মমতাবোধের সাক্ষর বহন করে। শতাব্দীকাল পার করেও সগৌরবে সমুজ্বল নয়নাভিরাম এই ভবন। এখনো ব্যবহার অনুপযোগিতা হারায়নি সভ্যতার ঐতিক কিংবদন্তি সাক্ষী। এটিকে সংরক্ষণ এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।
ঐতিহাসিক স্থাপত্যকীর্তি দীঘদিন ধরে সংস্কারবিহীন অযতেœ-অবহেলায় পড়ে থাকার দরুণ জীর্ণশীর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৮৫ সালে গণপূর্ত বিভাগ এটিকে ব্যবহার অনুপযোগী ঘোষণা করে। এটির স্থায়িত্ব ও ব্যবহার নিয়ে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যায়। শেষতক সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে বিদ্যমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট পেশ করেছে। রিপোর্ট পেশের পর পুরোনো মূল ভবন অক্ষত রেখে পাশে নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হয়।
নতুন ভবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরোনো ভবনকে সংস্কার করে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। যা সরকারের দূরদর্শিতার পরিচায়ক। বিপুল অর্থ ব্যয়ে এর সংস্কার করে নবযৌবনা হৃদগৌরব ফিরে আনা হচ্ছে। এ ভবনকে ঘিরে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারপ্রার্থী ও দর্শনার্থীসহ হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। কিন্তু এমবিকাশের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা খুবই অপ্রতুল, যোগাযোগ ব্যবস্থার দৈন্যদশা। একটিমাত্র সড়ক পথেই শত শত যানবাহন ও হাজারো মানুষের পথচলা। যানজট ও জনজট নিত্যনৈমিত্তিক কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দূর্ভোগ উওরণে বিকল্প সড়ক নির্মাণ ও সুপরিসর পার্কিং এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
আদালত ভবনের সামনে স্থাপিত সুদৃশ্য স্মৃতিসৌধ আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু উম্মুক্ত হওয়ায় যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে যাচ্ছেতাই ব্যবহারের ফলে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। মহান শহীদের সম্মান রক্ষার্থে নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন আদালত ভবন নির্মাণ কাজ চলছে শম্বুকগতিতে। পুরোনো ভবনের সংস্কার কাজেরও একই হাল। এ পাহাড়ের রাতের পরিবেশ রহস্যময়ী হয়ে ওঠে। নষ্টমতিদের লাস্যময়ীতে পরিণত হয়। লালপরী-নীলপরীদের অশুভ তৎপরতায় পরীর পাহাড়ের পবিত্রতা বিনষ্ট হচ্ছে। ঝাক-ফুক করে এদের শিকড় উপড়িয়ে ফেলতে হবে এবং অবৈধ দোকানপাট উচ্ছেদ করে এ ভবন ও পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষা করা অত্যাবশ্যক। আমাদের সংস্কৃতি-পুরোনো ঐতিহ্য আজ কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস- পুরাকীর্তির কিংবদন্তি থেকে শিক্ষা নিতে পারছেন না- সংরক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের অভাবে। তবে দেশবাসী এখন সচেতন ও জাগ্রত হয়ে ওঠেছে। পুরাকীতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসছে। আসুন, শতবর্ষী কালেক্টরেট ভবন-কোর্টবিল্ডিং পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ এবং এ পাহাড়ের সৌন্দর্য রক্ষায় আমরা সচেতন হই।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, কে,সি,দে ইনস্টিটিউট (অফিসার্স ক্লাব)।
সূত্র-বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মিনিস্টেরিয়াল অফিসার্স সমন্বয়ে গঠিত ক,সি,দে ইনস্টিটিউট (অফিসার্স ক্লাব) এর প্রকাশনা “ প্রয়াস”-(প্রকাশ-১০নভেম্বর ২০০৮)।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here