আলোকিত ডেস্ক: নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মাসেতু নির্মাণে পিলার বসাতে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। সাড়ে তিন বছরের মাথায় পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ এখন শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রমত্তা পদ্মায় সেতুর মোট ২৯৪টি পাইলের মধ্যে এখন বাকি আছে কেবল দু’টি পাইল ড্রাইভিং। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩০ জুলাই এই কাজ শেষ করার তারিখ নির্ধারণ করে থাকলেও কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে ১৫ জুলাই। সেজন্য দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীদের মাঝে এখন বইছে আনন্দের জোয়ার। পদ্মার তলদেশে পিলারের ভিত তৈরি করা (পাইল ড্রাইভিং) সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে বিবেচিত হলেও সেই কঠিন কাজটিই শেষের পথে হওয়ায় এই আনন্দের ঢেউ লেগেছে।
সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, মূল পদ্মাসেতুর ৮১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৫৯ শতাংশ। আর গোটা প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৭১ শতাংশ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হচ্ছে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর কাজ করা হচ্ছে সাতটি মডিউলে ভাগ করে। সপ্তম মডিউলে পাঁচটি স্প্যান, বাকি ছয়টি মডিউলে ছয়টি করে স্প্যান। মূলসেতুতে অর্থাৎ নদীতে ২৬২টি পাইলের ওপর বসবে ৪২টি পিলার, তার ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পানির মধ্যেই থাকছে ৪০টি পিলার। সেতুতে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৩১টি। আর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৫৯টি।
পদ্মাসেতুর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল সূত্র জানায়, বর্তমানে সেতুর ২৬ ও ২৭ নম্বর পিলারের পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ চলছে। দুইটি স্ক্রিন গ্রাউটিং পাইল বাকি আছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এই দুইটি পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এর মাধ্যমেই শেষ হবে সেতুর পাইল ড্রাইভিং যজ্ঞ। পাইল ড্রাইভিং শেষ হলে পদ্মার বুকে পিলার দাঁড়াতে আর কোনো বেগ পেতে হবে না।
মাওয়া কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডে চীন থেকে আসা স্টিল প্লেট দিয়ে পাইল তৈরি করা হয়েছে। ৩ মিটার পরিধির একেকটি পাইল ১২০ মিটার পর্যন্ত নদীর তলদেশে গিয়েছে। এক লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রতি সেকেন্ডে প্রবাহিত হয়ে থাকে পদ্মা দিয়ে। কিন্তু পাইল ড্রাইভ এমনভাবে করা হয়েছে, যেন পাইলের ওপর পিলার টিকে থাকে শতবছর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, ৪২টি পিলারের মধ্যে ৩০টি পিলারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এগুলো হলো ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৯, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২। চলতি বছরের মধ্যে বাকি ১২টি পিলারের কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। নদীতে ১৮টি পিলারের জন্য ছয়টি করে পাইল ড্রাইভিং হয়েছে এবং ২২টি পিলারে সাতটি করে পাইল হয়েছে। ডাঙ্গায় দুইটি পিলারে ১৬টি করে পাইল ড্রাইভিং হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, এরই মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশে আসা ২৪টি স্প্যানের মধ্যে ১৪টি স্প্যান পিলারের ওপর বসানো হয়েছে। এতে পদ্মাসেতু দৃশ্যমান হয়েছে ২ কিলোমিটারেরও বেশি। বাকি ১০টি স্প্যান মাওয়া কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড ও জাজিরা প্রান্তে রাখা হয়েছে। এছাড়া, সেতুর জাজিরা প্রান্তে রেলওয়ে স্ল্যাব বসেছে ৩২০টি এবং রোডওয়ে স্ল্যাব বসেছে ২৮টি।
পদ্মাসেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে। আর সেতুর নকশা প্রণয়ন করা হয় তারও দুই বছর আগে। নকশা প্রণয়নের সময় প্রতিটি পিলারের গোড়ার মাটি পরীক্ষা করা হয়নি। ৫টির পরপর ১টি করে পিলারের মাটি পরীক্ষা করা হয়, আবার তুলনামূলক কম গভীর মাটি পরীক্ষা করা হয়। ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাটি পরীক্ষা করার ফলে এর নিচে মাটি কী অবস্থায় রয়েছে তা তখন জানা যায়নি।
প্রকৌশল সূত্রে জানা যায়, মাটির গঠনগত বৈচিত্র্য ও গভীরতার তারতম্যের কারণে পদ্মাসেতুর মাঝনদী ও মাওয়া প্রান্তের এসব পিলার নিয়ে তখন বেশ জটিলতায় পড়ে এ প্রকল্প। তবে শেষতক চূড়ান্ত নকশা অনুযায়ী পিলারে স্ক্রিন গ্রাউটিং করে সমাধান মিলেছে। পিডিএ (পাইল ড্রাইভিং অ্যানালাইসিস) টেস্টে যেসব পাইল উত্তীর্ণ হতে পারে না সেগুলোর জন্য করা হয় স্ক্রিন গ্রাউটিংয়ের ব্যবস্থা। হাতেগোনা বিশ্বের কয়েকটি সেতুতে এটি ব্যবহার করা হয়েছে।
পদ্মাসেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, চলতি বছর ৫-৬টি স্প্যান বসানোর পরিকল্পনা আছে। সেতুর কাজ শুরু দিকে পদ্মানদীর মাটির গঠনগত বৈচিত্র্য ও তারতম্যের কারণে নকশা পুনরায় তৈরি করা হয়। যার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বেশি সময় লেগে যায়। মধ্য জুলাইয়ে মধ্যে পাইলিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। আর নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
সুত্র: বাংলানিউজ