বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই সংবাদ সম্মেলন করছেন।

শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার সবাইকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সূচনা বক্তব্য রাখতে বললে তিনি বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনের সূচনা বক্তব্য শুরু করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছি, যা দেশের মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য প্রবৃদ্ধি উচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়া। সেই লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যবসাবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, আর্থিক খাতের সংস্কার ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি। এছাড়া সরকারের গৃহীত মেগা প্রকল্প ছাড়াও অবকাঠামো খাতে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী তার সূচনা বক্তব্যে প্রতিটি খাত ধরেই বাজেটে বরাদ্দ ও এর পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা তুলে ধরেন।

শিক্ষা খাতের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা খাতে সরকারে সামগ্রিক লক্ষ্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে জ্ঞান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদেরও আধুনিক বিশ্বের সমতুল্য করে তোলা হবে। এছাড়া মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করা ও শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করাও সরকারের লক্ষ্য।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয়ের দাবির পরিপ্রোক্ষিতে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান রাখা হয়েছে। এই খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি যা, মোট বাজেটের বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ ও জিডিপি’র ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। কেবল শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, মোট ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে।

স্বাস্থ্য খাতকেও সরকার অন্যতম গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন করে সেবা নিয়ে থাকে, এর ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবাও নিশ্চিত করা হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা বর্তমান অর্থবছরে ছিল ২২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্য খাতেও কেবল স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় নয়, মোট ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এই খাতে মোট বরাদ্দ ২৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ০২ শতাংশ ও বাজেটের ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রী জানান, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জন্য একশ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করতে স্টার্টআপের জন্যও একশ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।

পরে একে একে প্রতিটি খাত ঘিরেই সরকারের পরিকল্পনা এবং বাজেটে খাতগুলোর বরাদ্দ ও অন্যান্য তথ্য তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রীর আশা ব্যবসায়ীরা খুশি মনে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করবেন

২০১২ সালের ভ্যাট আইনে কিছু পরিমার্জন আনা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় খুশি মনে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট আইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে জিনিসপত্রের দাম না বাড়ে। রাজস্ব আদায় নিশ্চিত ও সহজ করতে অনলাইন সিস্টেম চালু করা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে ইএফডি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বিশেষ বিশেষ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে যাতে সবার ওপর চাপ না বাড়ে। তামাক ও তামাকজাত মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবহার হ্রাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে একদিকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, অন্যদিকে রাজস্ব বাড়বে। গ্রামীন মানুষের কথা বিবেচনা করে বিড়ির মূল্য শুল্কহার সহনীয় পর্যায়ে রাখা হয়েছে। জর্দা ও গুলের মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

সুদের হার নিয়ে বাজেটের সিদ্ধান্ত মানতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

ব্যাংকের সুদের হার নিয়ে সিংগেল ডিজিটের কথা বলা হয়েছে বাজেটে। এই সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি, সিংগেল ডিজিটে থাকে। কতগুলো সুবিধাও দিলাম। মানেনি। বাজেটে বলা আছে, নির্দেশনা আছে, কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। নিয়মটা মেনে চলতে হবে, যেন ঋণ সিংগেল ডিজিটে হয়। ডাবল না হয়। তাতে বিনিয়োগ বেশি হবে। অনেক আইন সংশোধন করব। সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো হবে। ব্যাংক কোম্পানী আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। যেসব ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে পরিশোধ না করার জন্যই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপী হয়ে যান, সেই সমস্ত ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রতিযোগীতা সক্ষম করতে আমরা ব্যাংক ঋণের উপর সুদের হার এক অংকের উপর অর্থ্যাৎ সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখব।

বৃহৎ ঋণগুলোকে আরও নিবিড়ভাবে পরীবিক্ষণ ও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ মনিটরিং ব্যবস্থাকে জোরদার করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমরা শেয়ার বাজারে সুশাসন দেখতে চাই। আমাদের দেশের জন্য একটি শক্তিশালী অর্থনীতির পাশাপাশি আমরা দেখতে চাই একটি বিকশিত পুঁজিবাজার। শিল্প বিনিয়োগে দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ সংগ্রহের আদর্শ মধ্যম হচ্ছে পুঁজিবাজার। এ বিষয়ে আমরা সর্বাত্মক উদ্যোগ নিচ্ছি।

‘বেশি চিনি খেলে ডায়াবেটিস হয়, তাই চিনি আমদানিতে শুল্ক’

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে চিনি আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। পরদিন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খানিকটা রসিকতা করেই বললেন, চিনি খেলে ডায়াবেটিস হতে পারে বিধায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্যে বাজেটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। একে একে প্রতিটি খাত নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা, উদ্যোগ ও বাজেটে খাতগুলোর বরাদ্দ তুলে ধরেন তিনি।

বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক হার পুননির্ধারণের অংশে এসে প্রধানমন্ত্রী চিনি শিল্পের অংশটি পাঠ করে শোনান। বাজেটে চিনি আমদানিতে র-সুগারের ক্ষেত্রে প্রতি মেট্রিক টন ২ হাজার টাকা ও রিফাইন্ড সুগারের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ হাজার টাকা হারে স্পেসিফিক ডিউটিসহ ২০ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি বিদ্যমান রয়েছে। স্থানীয় চিনি শিল্পের সুরক্ষায় আমদানি করা র-সুগারের স্পেসিফিক ডিউটি ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা এবং রিফাইন্ড সুগারের স্পেসিফিক ডিউটি সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। দুই ধরনের সুগারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই অংশটি পাঠ করে প্রধানমন্ত্রী হাসতে হাসতে বলে ওঠেন, চিনি বেশি খেলে ডায়াবেটিস হয়। তাই এই ব্যবস্থা।

এর আগে, বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিকেলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। মূল বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রীর জন্য দোয়া চাইলেন প্রধানমন্ত্রী

সংসদে বাজেট উত্থাপনের পরদিন অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বাজেট সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন, এটাই এতদিনের রেওয়াজ। কিন্তু অর্থমন্ত্রী অসুস্থ থাকায় এবার সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, শুক্রবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন। বাজেটের পর প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি দেওয়া হলে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, অর্থমন্ত্রী অসুস্থ হওয়ায় ওই সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রীই করবেন।

নিজের প্রথম বাজেট উত্থাপন করতে বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদে এসেছিলেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বক্তৃতার মাঝপথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বাকি বক্তৃতা পড়ে শোনান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণ নিয়ে মন্ত্রণালয়, পরিবার বা অ্যাপোলো হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।

সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েকদিন যাবৎ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সোনালি যুদ্ধ মানে জনগণের সোনালি দিন: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাজেটের লক্ষ্য সোনার বাংলা গড়ে তোলা। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। অর্থাৎ ও মঙ্গলের জন্য যা করা। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে শুক্রবার (১৪ জুন) সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

ওই সাংবাদিক জানতে চান বাজেটে সোনালি যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এই সোনালি যুদ্ধ কী?

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ যেন সোনালি দিন দেখতে পায়, সেটিকেই সোনালি যুদ্ধ বলা হয়েছে। এটি অকল্যাণ, ধ্বংস নয়, সৃষ্টির যুদ্ধ।’

এর আগে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করা হয়। যা দেশের মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here