— মােহাম্মদ আলী –
৪ অক্টোবর ২০০৬ বুধবার রাতে শহর থেকে বাড়িতে এসে যখন আমার স্ত্রীর মুখে হাসান দা’র মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাই তখন কেন জানি মনে হলাে আমি আমার একজন অত্যন্ত আপন জনকে হারালাম। আমার চারপাশে যেন ঘনিয়ে আসছিলাে গভীর অন্ধকার। সমাপ্তি হলাে একটি ইতিহাসে। হাসান সাহেব ছিলেন আমার কাছে একটি আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তাই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের ওপর কিছুটা আলােকপাত করে নতুন প্রজন্মের কাছে তার আসল পরিচয়টা তুলে ধরার দায়বােধ থেকেই আমার এ লেখাটির অবতারণা।

১৯৪০ সালের ১০ আগস্ট আকুবদন্ডির এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে হাসান সাহেবের জন্ম। তাঁঁর পিতার নাম এস.এম. আবদুল হক। সচ্ছল পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে তিনি ছিলেন আলালের ঘরের – দুলাল। মা বাবা তাঁকে আদর করে ডাকতেন `মিঞা সােনা’ বলে, তখন থেকে এ নামেই তিনি এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত। তিনি কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক এবং পরবর্তীতে গাছবাড়িয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পারিবারিক অবস্থা সচল হলেও তার জীবনটা ছিল অনেকটা বাঁধনহারা; তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গন্ডির মধ্যে তিনি বেশী দিন থাকতে পাড়লেন না। নাটক এবং খেলাধুলাই ছিল তাঁর প্রাণ। তাই তিনি এগুলি নিয়ে বেশীর ভাগ ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন। পেটের টানে নয় মাঠের টানেই তিনি ইস্পাহানী জুট মিলে (কালুরঘাট) একজন ফুটবলার হিসেবে চাকুরীতে যােগদান করেন। তিনি ইস্পাহানী ফুটবল টিমের পক্ষে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের এ ডিভিশনের টানা কয়েক বছর অংশগ্রহণ করে কৃতি ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের পক্ষে জোনের খেলার সারােয়াতলী মাঠে এবং আকুবদভী ক্রীড়া সমিতির সু-দক্ষ স্ট্রাইকার হিসেবে তাঁর গােল করার অসাধারণ ক্ষমতা তৎকালীন ফুটবল দর্শকদের কাছে এখনাে স্মরণীয় হয়ে আছে।

জনাব হাসানের বাঁধনহারা জীবন তাঁকে কখনাে এক জায়গায় স্থির থাকতে দেয়নি। আট বছর ইস্পাহানীতে চাকুরী করার পর তিনি পাড়ি জমান সুদূর কুয়েতে। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে ব্যবসা বাণিজ্য করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোথাও তিনি সফল হতে পারেননি। কারণ সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন। তিনি সব সময় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে তাদের পাশে থাকতে চাইতেন। তাই তাঁর নিজ সংসারকে তিনি সারাজীবনেও ঘুচিয়ে তুলতে পারেননি। তাঁর ভগ্নদশা বাসগৃহটি দেখলেই তার প্রমাণ মিলে।

তিনি একটি সুন্দর দেশ, সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন – দেখতেন। তাই সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষেই তিনি শেষ জীবনে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন এবং চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন।

জনাব হাসানের বর্ণাঢ্য জীবনকে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা যায়। সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও রাজনীতি। আমার কাছে তাঁর প্রধান পরিচয় হচ্ছে একজন সংস্কৃতি কর্মী ও ক্রীড়াবিদ হিসেবে। তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্যে স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে ষাটের দশকের প্রথমদিকে ইকবাল পাঠাগারের উদ্যোগে আয়েজিত সিরাজদৌল্লাহ নাটকে সিরাজের অভিনয় এবং টিপু সুলতান নাটকে টিপুর অভিনয়। এ নাটক দু’টিতে তাঁর অভিনয় দর্শকদের এতটা মুগ্ধ করে যে, সমগ্র বােয়ালখালীতে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন এলাকায় তাঁর নেতৃত্বে এ নাটক দলটিকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। এ দলে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় স্যার কাজী আবদুল গণি ছাবেরী, অধ্যাপক আবু নাছের, এস এম আবু নাছের(ব্যাংকার), সৈয়দ ওমর ফারুক এবং শহীদ মুক্তিযােদ্ধা ওসমান গণি প্রমুখ। সর্বকনিষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে এ নাটকে স্কুল ছাত্রদের মধ্য থেকে আমরা যে তিনজন অভিনয় করার সুযােগ পেয়েছিলাম তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন জাসদ নেতা সৈয়দুল আলম, আরেকজন শহীদ মুক্তিযােদ্ধা আবুল হাসান এবং আমি আয়ন (৮ম শ্রেনীর ছাত্র)। আমি এ নাটকে টিপু সুলতানের প্রহরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম। সে-সুবাধে হাসান দার সাথে আমার একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলাে এবং আজীবন তিনি আমাকে ছােট ভাই এর মতাে নেই করতেন আর আমিও তাকে বড় ভাই এর মতাে শ্রদ্ধা করতাম।

এস.এম হাসান একজন উদারপন্থী রাজনীতিক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং আমৃত্যু দক্ষিণ জেলা কৃষক দলের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া তিনি কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় ও হাওলা কুতুবিয়া মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের সহ সভাপতি এবং আকুবদন্ডী ক্রীড়া সমিতি ও ইকবাল পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের দায়িত্বে পালন করেন। তিনি আজীবন সুস্থ সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ক্রীড়ার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।

২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর সকাল ৫-১৫ মিনিটে এসএম হাসান তাঁঁর মেয়ের বাকলিয়া বাসায় হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জীবনে যেমন কাউকে কষ্ট দেননি; মরণেও কাউকে কষ্ট না দিয়ে তিনি নীরবে বিদায় নিলেন। এমন সুন্দর মৃত্যুই বা কয়জনের ভাগ্যে জোটে?

জনাব হাসান নিজ গ্রামের জয়নাব বেগমকে বিয়ে করে তার সংসার জীবনের সূচনা করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৫ কন্যা (বিবাহিত) ও তিন পুত্র রেখে যান। তাঁর এ শূন্যতা সহসা পুরণ হবার নয়। একজন সুস্থ মানুষ সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা।

তাই আসুন, আমরা সে সমাজ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে শপথ নিই; যে সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিলো হাসানের মতাে সৎ দক্ষ সমাজ কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী।
কবির ভাষায়- নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছে ঠাঁঁই ।

-এ নিবন্ধটি পাক্ষিক আলোকিত বোয়াালখালীতে ১মার্চ ২০০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here