কেজিতে একদিনেই বাড়ল ৬০ টাকা কয়েক ঘন্টায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিল সিন্ডিকেট ।। চীন মিশর মিয়ানমার থেকে জাহাজে এসেছে বিপুল পেঁয়াজ ।। আজ জেলা প্রশাসনের জরুরি বৈঠক গুদামে গুদামে চলবে অভিযান

দেশে পেঁয়াজের বাজারে হঠাৎ করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের পর একটি সিন্ডিকেট কারসাজি করে এ পরিস্থিতি তৈরি করে। এর মাধ্যমে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই, বরং পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। প্রসঙ্গত, গত রোববারও খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। ভারতের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানার পর রোববার রাতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম উঠে যায় ৮০ টাকা। গতকাল সেঞ্চুরি পার হয়ে যায় পেঁয়াজের দাম। ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।

রাতারাতি লাগামহীনভাবে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা নজিরবিহীন। গতকাল চাক্তাই খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল করা হয়েছে। বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। প্রতিটি গুদামে রয়েছে পেঁয়াজ। অথচ ব্যবসায়ীরা আড়তে আড়তে মাত্র দু’চার বস্তা পেঁয়াজ নিয়ে বসে আছেন। দর বাড়ানোর জন্য সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট পর্যাপ্ত পেঁয়াজ থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে।

এ অপতৎপরতা ঠেকাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আজ জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। একই সাথে বাজার মনিটরিংও শুরু করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি গুদামে গুদামে র‌্যাবের অভিযান চলবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বাজারে কাজ শুরু করা হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়েছে। মিশর এবং চীন থেকে আসা সাড়ে তিন লাখ কেজি পেঁয়াজ নিয়ে জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। আজকালের মধ্যে মিয়ানমার চীন এবং মিশরের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে। তুরস্ক থেকেও আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। ভারতের উপর নির্ভরতা কমাতে বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ৩২ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে রোজা এবং কোরবানের ঈদকে সামনে রেখে পেঁয়াজের ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও বছরের অন্যান্য সময় প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ ২৫ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ লাগে। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। একই সময়ে ১০ লাখ ৯২ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানি প্রায় পুরোপুরি ভারত থেকে হয় বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত গত ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের অভ্যন্তরীণ পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ওই দিন ভারত সরকার পেঁয়াজের রপ্তানিমূল্য ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে দেয়। ২৫০ থেকে ৩০০ ডলারের পেঁয়াজ ৮৫০ ডলারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় টালমাটাল হয়ে ওঠে বাজার। ৩৫/৪০ টাকার পেঁয়াজের কেজি প্রতিদিনই বাড়তে শুরু করে। দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট না থাকলেও ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ঘটনাকে পুুঁজি করে দেশীয় বাজার অস্থির করে তোলা হয়।

বিষয়টিকে একেবারে অস্বাভাবিক এবং সংঘবদ্ধ চক্রের কারসাজি বলে আখ্যায়িত করে সূত্রগুলো বলেছে, পেঁয়াজ দ্রুত পচনশীল একটি পণ্য। ভারত থেকে স্বল্প সময়ে পেঁয়াজ নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে বলে প্রতিদিন শত শত টন পেঁয়াজ ট্রাকে বোঝাই করে দেশে আনা হয়। একটি ট্রাকে ২০ টন করে পেঁয়াজ আনা হয়। বাংলাদেশের বড় বড় কয়েকজন ব্যবসায়ী ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে যৌথ ব্যবসার মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি করে আবার বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। আমদানি এবং রপ্তানিকারক একই ব্যক্তি হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণ খুব সহজেই করতে পারে। আর প্রতি বছরই এভাবে পেঁয়াজের বাজারকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে দেশের চাহিদা পূরণের মতো সক্ষমতাও কৃষকদের রয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে পেঁয়াজের ব্যাপক চাষাবাদ হয় এবং পাবনা, ইশ্বরদী এবং রাজশাহী মোকাম থেকে প্রচুর দেশী পেঁয়াজ সারা দেশে সরবরাহ হয়ে থাকে। বীজ বোপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত দুই আড়াই মাস সময় লাগে। বর্তমানে দেশীয় পেঁয়াজের গত বছরের মজুদ ফুরিয়ে গেছে। নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। এখনো বেশির ভাগ পেঁয়াজ ক্ষেতে। এই অবস্থায় দেশীয় পেঁয়াজের একটি সংকট তৈরি হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পেঁয়াজের এই সংকটের মাঝে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। আর এর ফলেই কার্যত লাফিয়ে লাফিয়ে সর্বোচ্চ ৪০ টাকার পেঁয়াজে ৮০ টাকা বেড়ে একশ’ বিশ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি পেঁয়াজে ৮০ টাকা বাড়তি হাতিয়ে নেয়ার কাজটি করছে হাতে গোনা কিছু সিন্ডিকেট। সীমান্ত এলাকায় বসে এই সিন্ডিকেট দেশের পেঁয়াজের বাজার নিয়ে এ খেলা করছে।

বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানির সাথে জড়িত সর্বোচ্চ দশ বারোজন ব্যবসায়ী। বেনাপোল, হিলি, ভোমরা এবং তামাবিল সীমান্ত দিয়েই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকে। এমনও আছে, একই পরিবারের দুইটি প্রতিষ্ঠান একটি বাংলাদেশে এবং অপরটি ভারতে গড়ে তোলা হয়েছে। এরা ভারত থেকে এপারে পেঁয়াজ রপ্তানি করে। আর সীমান্ত এলাকার উক্ত আমদানিকারকই ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশের আড়তদারদের নিকট পেঁয়াজ সরবরাহ দেয়। পেঁয়াজের দরও তারা নির্ধারণ করে। উক্ত দরে পেঁয়াজ বিক্রির পর আবারো পেঁয়াজ পাঠানো হয় এবং নতুন দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়। আমদানিকারক এবং আড়তদারদের হাত ঘুরে পেঁয়াজ পাইকারী বাজার থেকে খুচরা বাজারে যায়। আর প্রতিটি ঘাটে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজ যখন বাজারে আসে তখন এদেশে-ওদেশের যৌথ ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টন পেঁয়াজ রপ্তানি ও আমদানি করে বাজার সয়লাব করে দেয়। পেঁয়াজের দাম নেমে আসে ১৫/১৬ টাকা কেজিতে। বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজ বিক্রি শেষ হলে আবারো সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ীদের কারসাজি শুরু হয়। তারা পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়ায়, রপ্তানি বন্ধ করে। আর এভাবে প্রতি বছরই সংঘবদ্ধ চক্রটি রাতারাতি কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। দেশের চাষীদের পেঁয়াজের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেলে পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, ২৪ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ যেখানে উৎপাদিত হচ্ছে সেখানে আর ৭/৮ লাখ টন উৎপাদন খুব একটি কঠিন কাজ নয়। কৃষকদের উৎসাহিত করা গেলে খাদ্য উৎপাদনের মতো পেঁয়াজ উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে দেশ। একই সাথে শুধু ভারত নির্ভরতা না রেখে বিকল্প উৎসগুলোও চালু রাখলে এভাবে দেশকে জিম্মি করা সম্ভব হতো না বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে।

সূত্র বলেছে, গতকাল বাজারে বিক্রি হওয়া পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে অন্তত এক সপ্তাহ আগে। ওই পেঁয়াজের আমদানি মূল্য এবং চট্টগ্রামে পৌঁছা পর্যন্ত খরচ পড়েছিল প্রতি কেজিতে ৪৫ টাকার মতো। অথচ সেই পেঁয়াজ গতকাল সকাল থেকে বিক্রি করা হয়েছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে।

খাতুনগঞ্জের হামিদ উল্ল্যাহ মিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেছেন, পাইকারী বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ ৯৫ টাকা এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৮৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে দাম বেশ চড়া বলে তিনি স্বীকার করেন।

এদিকে গতকাল টেকনাফ স্থল বন্দরে মিয়ানমারের পেঁয়াজ নিয়ে দুইটি ছোট জাহাজ ভিড়েছে। একটি জাহাজ থেকে পেঁয়াজ খালাস শুরু হয়েছে। অপর জাহাজ থেকে আজ পেঁয়াজ খালাস করা হবে। অপরদিকে মিশর এবং চীনের ৩ লাখ ৬৪ হাজার কেজি পেঁয়াজ বোঝাই চৌদ্দটি কন্টেনার চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। পৃথক তিনটি জাহাজ বোঝাই করে ৩৬৪ টন পেঁয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হচ্ছে। চট্টগ্রামের জেনি এন্টারপ্রাইজ, এন এস ইন্টারন্যাশনাল, হাফিজ করপোরেশন নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান এমভি কালা পাগুরো, এমভি জাকার্তা ব্রিজ ও এমভি কোটা ওয়াজার করে ১৪ টিইইউএস কন্টেনারে বোঝাই করে পেঁয়াজের চালানটি নিয়ে আসে। এরমধ্যে দুইটি জাহাজ থেকে কন্টেনার খালাস করা হচ্ছে। অপরটি থেকেও আজকালের মধ্যে খালাস করা হবে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার পরই এসব পেঁয়াজ বাজারে চলে আসবে বলে বন্দর সূত্র জানিয়েছে। চীন, তুরস্ক ও মিশর থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পেঁয়াজ বাজারে পৌঁছতে অন্তত ২৫ দিন সময় লাগে। ভারতের নির্ভরতা কমাতে নিয়মিত এসব বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি চালু রাখা উচিত বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

এদিকে পেঁয়াজের অস্থিতিশীল বাজার নিয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাজারে পেঁয়াজের সংকট তৈরি করার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমান আদালত চাক্তাই খাতুনগঞ্জে অভিযান চালাবে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার (আজ) বিকেল চারটায় ব্যবসায়ীদের সাথে জরুরি বৈঠকে বসবো। বৈঠকে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবেন। আমরা পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।

দৈনিক আজাদী

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here