পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত পাঁচ বছর ধরে এক নারী কর্মকর্তাকে নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। ওই নারী কর্মকর্তার অভিযোগ সহকর্মীদের দ্বারা নিপীড়নের ফলে  ২০১৫ সালে তার গর্ভস্থ সন্তানের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়। নিপীড়ন অব্যাহত থাকার মধ্যে ওই কর্মকর্তা’র ২০১৬ সালে প্রিম্যাচিউরড সন্তানের জন্ম হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিপীড়নের শিকার ওই নারী কর্মকর্তা গত ২০১৫ সালে লিখিত অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি। উল্টো ওই নারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়, ভুয়া চিকিৎসা সনদ দেখিয়ে ওই নারীকে মানসিক ভারসাম্যহীন (সাইকোলজিকেল ডিসঅর্ডার) রোগী বানিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্তের চেষ্টা চলছে।

মজার তথ্য হচ্ছে, যে নারী কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানসিক ভারসাম্যহীন বলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে তাকে দিয়েই আবার ‘বঙ্গবন্ধু: দ্য গ্লোবাল লিডার’ শীর্ষক একটি আর্ন্তজাতিক প্রকাশনার কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এ সংক্রান্ত সকল তথ্য-উপাত্ত সারাবাংলা’র হাতে এসেছে।

সারাবাংলা’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুক্তভোগী ওই নারীর নাম মিজ মঞ্জু মনোয়ারা। তিনি বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তা (ক্যাডার পরিচিতি ০২৩৫)। তিনি ২০১৫ সালে বাংলাদেশ দূতাবাস টোকিওতে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তারই সহকর্মী দূতাবাসের কাউন্সেলর মোহাম্মদ নুরে আলম (বর্তমানে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের কাউন্সিলর) এর বিরুদ্ধে নারী নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ করেন।

গত ২০১৫ সালের ১৫ জুন পররাষ্ট্র সচিবের কাছে দাখিল করা অভিযোগপত্রে মিজ মঞ্জু মনোয়ারা বলেন, ‘দূতাবাসের কাউন্সিলর মোহাম্মদ নুরে আলম ধারাবাহিকভাবে তাকে নিপীড়ন করছেন। নুরে আলমের নিপীড়নের ৭টি উদাহরণ মঞ্জু মনোয়ারা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন। এগুলো হচ্ছে—, ‘যাও যাও বাসায় গিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে ঘুমাও, তুমি তো আর আমার কাছে আসব না’, ‘আজ তো তোমার মহাবিপদ। মহুয়া সুন্দরী তার সখী নিয়ে তোমার বাসায় থাকবে। তোমার জামাই তো আর তোমার সঙ্গে আজকে রাতে ঘুমাবে না’, ‘মঞ্জু কি তোমার বাসায় মেয়েদেরকে রাখা নিরাপদ মনে করছ না? নাকি এইবার নিজের ব্যবস্থা করে নিলা? আজকে রাতে তোমার জামাই খুব কষ্টে থাকবে’, ‘তুমি কি আমার ঘরের বউ নাকি যে তোমাকে আমার গাড়ি দেওয়া লাগবে’, ‘তোমার জামাইয়ের তোমার ড্রাইভার হওয়া ছাড়া আর কী ঘোড়ার ডিমের কাজ আছে যে, তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে না’, ‘ওইখানে বসে বসে লোম ফেলতেসিস ক্যান’, ‘ওরে আমি লাথি মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে মেরে দিব।’

ওই অভিযোগপত্রে মঞ্জু মনোয়ারা বলেন, ‘নিপীড়নের ভয়াবহতা চরম আকার ধারণ করে যখন ২০১৫ সালের ১২ জুন মোহাম্মদ নুরে আলম আমাকে গর্ভকালীন অবস্থায় শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেন। এতে আমি প্রচণ্ড ভয় এবং মানসিক আঘাত পাই। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৯ জুলাই আমার গর্ভস্থ সন্তানের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।’

অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, মিজ মঞ্জু মনোয়ারার অভিযোগ বিষয়ে মন্ত্রণালয় কোনো তদন্ত না করে মঞ্জু মনোয়ারাকে টোকিও থেকে ভারতের মুম্বাই মিশনে বদলি করে। কিন্তু মঞ্জু মনোয়ারা যাতে মুম্বাই মিশনে যোগ না দেন এ জন্য ওই সময়ে মুম্বাই মিশনের কাউন্সেলর (বর্তমানে এফএসও) অব্যাহত হুমকি দেন এবং ওই বছরের অক্টোবরে মঞ্জু মনোয়ারা কাজে যোগ দেয়ার জন্য মুম্বাই গেলে প্রথমে তাকে মিশন ভবনে ঢুকতে দেওয়া হয় না। পরবর্তী সময়ে মঞ্জু মনোয়ারাকে মুম্বাই মিশনের একটি কক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে বোম্বে হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসা নেন।

এরপর ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর মঞ্জু মনোয়ারাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগে সংযুক্ত করা হয়।

দেশে ফেরার পর তিনি আবার গর্ভধারণ করেন এবং ২০১৬ সালের ২২ মে বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেন। এমন অবস্থায় ওই বছরের ২১ জুন দুপুরের আগে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক স্বাক্ষর করা এক ই-মেইল বার্তায় মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ উল্লেখ করে কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, ১০ দিনের মধ্যে তার কারণ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। আবার একইদিন দুপুরের পর আরেকটি ই-মেইল বার্তায় আগের ই-মেইলটি প্রত্যাহার করা হয়। এতে মানসিক আঘাত পাওয়ায় ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই মঞ্জু মনোয়ারার প্রি-ম্যাচিউরড সন্তান হয়।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এরপর মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক বিভাগীয় মামলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তাকে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পারিবারিক জীবন ধ্বংস, অপ্রাসঙ্গিক সাক্ষী এনে হয়রানি, পদোন্নতি বন্ধ, এসিআর না দেওয়াসহ মঞ্জু মনোয়ারাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।

মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে দায়ের করা বিভাগীয় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, তদন্তে মঞ্জু মনোয়ারার পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩৪ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী সাক্ষী দেন। অন্যদিকে, তার বিরুদ্ধে ১৭ জন সাক্ষীকে তদন্ত কর্মকর্তার সামনে হাজির করে মন্ত্রণালয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না হলেও মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র কর্মকর্তা, পিয়ন, ড্রাইভারসহ অনেককেই মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তারা বিপক্ষে সাক্ষী দিতে এসেও বেশিরভাগই মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কথা বলেননি। বেশিরভাগ সাক্ষীরই মন্তব্য ছিল, ‘জানি না’, ‘মনে নেই’, এমন ধরনের।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে মানসিক (সাইকোলজিকেল ডিসঅর্ডার) রোগীর অভিযোগ আনে। এ জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে ৬ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিক্যাল বোর্ড পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মঞ্জু মনোয়ারাকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক (ফাউন্ড নো ফিজিক্যাল গায়নোলজিক্যাল অ্যান্ড মেন্টাল অ্যাবনরমালিটি) বলে সনদ দেয়।

শুধু তাই নয়, মঞ্জু মনোয়ারাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মুম্বাই হাসপাতালের নকল সনদও (সারাবাংলা’র হাতে তথ্য প্রমাণ রয়েছে) জোগাড় করে। অথচ ইন্ডিয়া মেডিক্যাল এথিকস ২০০২ এর ৭ এর ১৪ ধারা মতে, একমাত্র হাইকোর্ট ছাড়া তৃতীয় পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা সেবা নেওয়া কোনো রোগীর সনদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেয় না।

এর মধ্যে গত ২৩ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয়ে ‘নারী নিপীড়ন এবং যৌন নির্যাতন বিরোধী অভিযোগ কমিটি’ গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে প্রতিকার চেয়ে মঞ্জু মনোয়ারা আবেদন করেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন দোষীদের বাঁচাতে এবং মঞ্জু মনোয়ারাকে হয়রানি করতে ২৩ এপ্রিল গঠন করা ‘নারী নিপীড়ন এবং যৌন নির্যাতন বিরোধী অভিযোগ কমিটি’ বাতিল করে গত ২৭ জুন নতুন কমিটি গঠন করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে আরও জানা গেছে, মোহাম্মদ নুরে আলম গত বছরের মাঝামাঝি মন্ত্রণালয়ের একজন পরিচালকের মাধ্যমে মঞ্জু মনোয়ারাকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়ে আপস করার প্রস্তাব দেন। মঞ্জু মনোয়ারাকে বলা হয় যে, তিনি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিলে তার ভালো পোস্টিং হবে এবং পদোন্নতিও হবে। কিন্তু মঞ্জু মনোয়ারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মঞ্জু মনোয়ারার কিছু সহকর্মী তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়েছে যে মঞ্জু মনোয়ারা মানসিক ভারসাম্যহীন। অথচ সরকারি আচরণ বিধিমালা ১৯৭৯ এর ২৭ এর বি ধারা অনুযায়ী, কোনো নারী কর্মকর্তা সম্পর্কে গুজব ছড়ানো অসদাচরণ।

মঞ্জু মনোয়ারার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাটি তদন্ত করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম) ও সাবেক নৌ কর্মকর্তা মো. খুরশেদ আলম। এই বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য এই প্রতিবেদক গত রবিবার, বুধবার এবং বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের সচিবের (মেরিটাইম) দপ্তরে যোগাযোগ করলেও সচিব ব্যস্ত থাকায় কোনো মন্তব্য করতে পারেননি।

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সারাবাংলা’কে বলেন, ‘বিষয়টি অনেক পুরনো ঘটনা এবং লিগ্যাল মেটার। তাই মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

ভুক্তভোগী মঞ্জু মনোয়ারার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘আইনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। আমি ন্যায়বিচার চাই এবং পাবো বলেও আশাবাদী। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

সারাবাংলা/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here