ইসলামে নামাজের পরই জাকাতের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। জাকাত শব্দটি কোরআনে আছে ৩২ বার, নামাজের সূত্রে আছে ২৬ বার, স্বতন্ত্রভাবে ৪ বার এবং পবিত্রতা অর্থে আছে ২ বার। কোরআনে ১৯টি সুরায় জাকাতের আলোচনা এসেছে।

 

আহমেদ ফাইয়াদ

জাকাত আরবি শব্দটির অর্থ পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। ইসলামে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় দান অর্থেই জাকাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কোনো মুসলমানের ধনসম্পদ থেকে তাঁর নিজের ও পরিবারের সারা বছরের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর নির্ধারিত পরিমাণে অবশিষ্ট থাকলে এবং ওই ধনসম্পদ তাঁর মালিকানায় এক বছর মেয়াদে স্থায়ী থাকলে বছর পূর্ণ হওয়ার পর সেই সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশ শরিয়াহ-নির্ধারিত খাতগুলোয় প্রদান করাকে জাকাত বলা হয়। যে পরিমাণ ধনসম্পদ থাকলে জাকাত দান ফরজ হয়, ইসলামি পরিভাষায় তাকে নিসাব বলা হয়।

নিসাব হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর এক বছরের জন্য কমপক্ষে ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রুপা অথবা এর কোনো একটির সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা অন্য কোনো বস্তু ব্যক্তির মালিকানায় থাকা। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সম্পদ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে জাকাত আদায় করা তাঁর ওপর ফরজ।

পবিত্র কোরআনে জাকাত: জাকাত শব্দটি কোরআনে আছে ৩২ বার, নামাজের সূত্রে আছে ২৬ বার, স্বতন্ত্রভাবে ৪ বার এবং পবিত্রতা অর্থে আছে ২ বার। কোরআনে ১৯টি সুরায় জাকাতের আলোচনা এসেছে।

জাকাতের গুরুত্ব

ইসলামে নামাজের পরই জাকাতের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে। জাকাতদাতার মনকে ধনসম্পদের লোভ থেকে মুক্ত ও পবিত্র করে। ধনীদের ধনসম্পদে যে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে, এই সত্যকেও তা প্রতিষ্ঠিত করে। কোরআনে আছে, ‘তাদের সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ১৯) এভাবে জাকাতের মাধ্যমে সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ধনসম্পদের কিছু অংশ ব্যয়ের ফলে তাঁদের অবশিষ্ট ধনসম্পদ পবিত্র হয়। সুরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তুমি ওদের ধনসম্পদ থেকে সদকা আদায় করো। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করে দেবে।’

জাকাত শব্দের অপর অর্থ বৃদ্ধি। বস্তুত, জাকাত প্রদান করলে ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়।

কোরআনের সুরা রুমের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ধনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য তোমরা যা সুদ দিয়ে থাকো, তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না; কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জাকাত দাও, তাদের ধনসম্পদ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।’ (সূত্র: যার যা ধর্ম, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪)

জাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত

কোনো ব্যক্তির মালিকানায় নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পূর্ণ করার ফলে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। জাকাত প্রযোজ্য হয় এমন সম্পদগুলো হলো টাকা, সোনা, রুপা, সব ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য, গবাদিপশু ও নির্দিষ্ট কৃষিপণ্য।

জাকাত দেবেন কাকে

কোরআনে বলা হয়েছে, ফকির, মিসকিন, জাকাত আদায়কারী কর্মী, নও মুসলিম ও অনুরাগী, দাস-দাসী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, মুজাহিদ ও বিপদগ্রস্ত মুসাফিরকে জাকাত দিতে হবে। জাকাতের অর্থ বা সম্পদ বিতরণের বিষয়ে কোরআনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াত অনুযায়ী তাঁরা হলেন:

ফকির: যাঁর বেঁচে থাকার মতো খুব সামান্য সহায়সম্বল রয়েছে বা আদৌ নেই।

মিসকিন: এমন অভাবী, যাঁর রোজগার তাঁর নিজের ও নির্ভরশীল সদস্যদের অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণকাজে নিয়োজিত কর্মচারী, যাঁদের আমিলিন বলে।

নও মুসলিম, যাঁর ইমান এখনো পরিণত হয়নি; অথবা ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, এমন কোনো অমুসলিম, যাঁদের অন্তর ইসলামের প্রতি, তাঁদের জন্য। শরিয়তের ভাষায় মুয়াল্লাফাতিল কুলুব বলে।

মুক্তিপণ ধার্যকৃত দাস বা রিকাব।

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের জন্য।

আল্লাহর পথে (মুজাহিদ) ব্যক্তিরা, বিশেষত যাঁরা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত এবং বিপদগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য।

যাঁদের জাকাত দেওয়া যায় না

নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক, যে ব্যক্তি অন্যূন ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রুপার সমপরিমাণ নগদ অর্থ বা সমমূল্যের দ্রব্যসামগ্রী বা বাণিজ্যিক পণ্যের মালিক, তাঁকে জাকাত দেওয়া যায় না। এমন ব্যক্তির জাকাত গ্রহণ নিষেধ। নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারীকে জাকাত দিলে আদায় হবে না।

নির্দিষ্ট আত্মীয়: ব্যক্তি তাঁর আপন মা, বাবা, মাতামহ, মাতামহী, পিতামহ ও পিতামহী এবং তাঁদের পিতা-মাতাকে জাকাত দিতে পারবেন না। তেমনিভাবে নিজের পুত্র, কন্যা, দৌহিত্র ও দৌহিত্রীরা এবং তাঁদের সন্তানকে জাকাত দেওয়া যায় না। আবার স্বামী তাঁর স্ত্রীকে জাকাত দিতে পারবেন না। স্ত্রীও স্বামীকে জাকাত দিতে পারবেন না।

সেবার প্রতিদান: পারিশ্রমিক হিসেবে জাকাত দেওয়া যায় না।

কর্মচারীকে মজুরি প্রদান: গৃহভৃত্য বা অন্য কোনো কর্মচারীকে মজুরি হিসেবে জাকাত দেওয়া যায় না। অবশ্য মজুরি ছাড়া উপহার হিসেবে তাঁদের জাকাত দেওয়া যায়। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here