আবো. ডেক্স:

মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুদরতী শক্তি দ্বারা অলৌকীক ভাবে এ বিশ্ব জগৎ ও ইহার মধ্যকার বস্তু সমূহ সৃষ্টি করেন। মানুষকে করেন সৃষ্টির সেরা জীব। অতঃপর নবী মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিকট পবিত্র কোরআন মাজীদ নাজীল করে তাঁর কুদরতের নানাবিধ রহস্য প্রকাশ করেছেন। (১০ই মহররম) এমনি এক রহস্যময় ও ঘটনা বাহুল্য দিবস। সুতরাং এই দিবসটি যেমনি ইবাদতের তেমনি শিক্ষা গ্রহন করার মত তাৎপর্যপূর্ণ।

এ দিবসে মহান আল্লাহ এ বিশ্ব জগৎ সৃষ্টি করেন। এ দিবসে হযরত আদম (আঃ) এর প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়। এ দিবসে হযরত নূহ (আঃ) এর কিস্তি মহা প্লাবন শেষে জমিনে লাগে। নবী আইয়ুব (আঃ) রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন, এ দিনে ইউনূছ (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান, এই দিবসে হযরত মূছা (আঃ) তাঁর অনুসারীদের কে নিয়ে ১২টি অলৌকিক ভাবে তৈরী হওয়া রাস্তা দিয়ে নীল নদ পার হন এবং ফেরাউন তাঁকে তাড়া করতে গিয়ে নদীতে স্ব-দলবলে ডুবে মারা যায়। এ দিবসে হযরত ইসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। সর্বশেষ ইসলামের ইতিহাসে কারবালার ঘটনা এক গুরুত্ব পূর্ন অধ্যায়ের সৃষ্টি করে এই দিনে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রাঃ) অবৈধ ভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার না করে এক অসম যুদ্ধের মাধ্যমে ৬১হিঃ ১০ই মহররম আত্মবিসর্জন দিয়ে শাহাদাৎ বরন করেন। যাহা এক বিরল দৃষ্টান্ত। সেদিন ফোরাত নদীর পারে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) তার শিশু পুত্রসহ ৭২ জন সাথীকে নির্দয়ভাবে শহীদ করেছিল ইয়াজিদের সিমারের দল। পাষন্ডরা সেদিন ইসলামের উপর কলঙ্কজনক ইতিহাস রচনা করেছে। সত্য ও ন্যায়ের অতন্ত্র প্রহরী ইমাম হোসাইন (রা.) এর পরিবারবর্গ সেদিন অকাতরে রক্তের সাগর প্রবাহিত করে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিজয়ের লক্ষ্যে বীজবপন করে গেল। তাদের উৎস্বর্গীকৃত জীবন ইসলামের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ১০ই মহরম সেদিন কারবালায় যে ইতিহাস রচিত হল তার পটভূমিকাও ব্যাপক, মহান রাববুল আলামিনের এই রহস্যময় সৃষ্টিকল্পের সৃষ্টির লগ্ন থেকেই ১০ই মহররম ছিল তদানিন্তন ইতিহাসের স্বাক্ষর।

সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই মহরাম আল্লাহপাক ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ রুপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন…

* আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করা হয়েছে ১০ই মহররম।
* ১০ই মহররম আদম (আঃ) কে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে ।
* আশুরাতেই আদম (আ.) কে বেহেশত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছে।
* আদম (আ.) এ তওবা কবুল করা হয় এই আশুরাতেই।
* মা হাওয়া (আ.) এর সাথে আদম (আ.) পুনরায় সাক্ষাত হয় এই ১০ই মহররম।
* আসমান-জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে মহররম মাসেই।
* আরবের জাহেলরাও মহররম মাসটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিত।
* চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মাহাসাগর সৃষ্টি করা হয় এই মহররম মাসেই।
* আশুরাতেই জন্ম গ্রহণ করেন ইব্রাহীম (আ.)।
* আশুরাতেই হযরত মূসা (আ.) এবং আল্লাহপাকের মধ্যে কথোপকথোন হয়েছিল।
* হযরত মূসা (আ.) এর উপর তৌরাত কিতাব নাজিল হয়েছিল এই আশুরাতেই।
* আশুরাতেই মূসা (আ.) তার সাথীদের নিয়ে নীল নদ পার হন এবং ফেরাউন বাহিনী পানিতে ডুবে মরে।
* হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগের পর সুস্থ হয়ে উঠেন এই আশুরাতেই।
* হযরত সোলায়মান (আ.) পুনঃ বাদশাহী লাভ করেন আশুরাতেই।
* আশুরাতেই দাউদ (আ.) এর তওবা কবুল করা হয়।
* হযরত ইউছুফ (আ.) তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব (আ.) এর সাথে মিলিত হন এই আশুরাতেই।
* হযরত ইসা (আ.) জন্ম গ্রহণ করেন আশুরাতেই।
* হযরত ইসা (আ.) কে আল্লাহপাক সশরীরে আসমানে তুলে নেন এই আশুরাতেই।
* আশুরাতেই আল্লাহপাক হযরত ইদ্রিস (আ.) কে জীবিত করেন এবং তাকে জান্নাতে উঠিয়ে নেয়া হয়।
* হযরত নূহ (আ.) এর জাহাজ চল্লিশ দিন পর পাহাড়ের কিনারে ভিড়ে আশুরাতেই।
* আশুরাতেই হযরত নূহ (আ.) জমিনে অবতরণ করেন।
* আশুরাতেই উম্মতে মুহাম্মদীর গুনাহ মাফ হয়।
* জিব্রাইল (আ.) আশুরাতেই দুনিয়াতে আগমন করেন।
* আল্লাহপাক দুনিয়াতে প্রথমবার রহমত নাজিল করেন ও রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন আশুরাতেই।
* হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসেন আশুরাতেই।

কারবালার ঘটনা:

ইয়াজিদ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় ইমাম হুসাইন (আ.) মত ইমামের পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইনের (আ.) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসীগন ইয়াজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাচার জন্যে বারংবার ইমাম হুসাইন-এর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হুসাইন (আ.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন। কিন্তু এর মধ্যে ইয়াজিদের অধিনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিমকে খুঁজে বের করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাকে সহায়তাকারীদেরও খুঁজে হত্যা করে। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা হুসাইন (আ.) এর সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেলো না। কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইন (আ.) কে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইলেও ইমাম হুসাইন (আ.) এর জন্য প্রাণ বিসর্জণ দিতে রাজি ছিল না।

ইয়াজিদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (আ.) এর সঙ্গীরা যে জেনে শুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমাম (আ.) কে ভালোবেসে, তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তাঁরা ইমামের (আ.) সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারীর সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সেজন্যেই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটাই ছিল তাদেঁর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।মুসলিম প্রেরিত পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন স্ত্রী, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, অনুচর সহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইন (আ.) কে ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহনের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দর্ন্ডায়মান হলো এবং হুসাইন (আ.) শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো।

তাসূয়ার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের (আ.) সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ইমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তাঁরা ইমামের সাথে কৃত তাদেঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এই অনড় ইমানের অধিকারী একজন ছিলেন হযরত আব্বাস (আ.)। তিনি ছিলেন হযরত আলি (আ.) এর ছেলে। তাঁর মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হযরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তাঁর ইমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন ইমাম (আ.) পক্ষের প্রধান সিপাহসালার। ইমামের প্রতিরক্ষায়,নারী ও শিশুদের তাঁবুর প্রতিরক্ষায় এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর সন্তানদের জন্যে পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।

অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইনকে (আ.) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। গুটি কজন মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের (আ.) কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস (আ.) ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন (আ.) এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা। পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রু পক্ষের আঘাতে তাঁর এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের (আ.) তাঁবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি। এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর (আ.) শহীদ হয়ে যান।
কারবালায় আরো যাঁরা শহিদ হন তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের,মুসলিম ইবনে আওসাজা,নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন (আ.) ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটা গ্রহনের অনুরোধ জানান। তাহলো-হয় তাকে মদীনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, বা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনটাই মানলো না। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন (আ.) এর শিবিরে হাহাকার পড়ে গেলো। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে লাগলো। নিরুপায় হুসাইন শেষবারের মত অনুরোধ করলেও,পাষান্ডদের মন গলেনি। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হুসাইনের (আ.) ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন। তৃষ্ণার্ত হুসাইন (আ.) এর শিশুপুত্র আসগর (আ.) কে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশু পুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন (আ.) তাবুর সামনে বসে পড়লেন। সীমার নামীয় ইয়াজিদের এক সৈন্য তরবারীর আঘাতে হুসাইনের (আ.) নামাজ রত অবস্থায় মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এই ভয়ন্কর দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো। হুসাইন (আ.) পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট পাঠানো হয়। এদিকে হুসাইনের (আ.) মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেলো। ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এবং জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভুমিকায় সে বন্দিদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু তারপরেও থেমে থাকেনি বণি উমাইয়ার অত্যাচার তারা একের পর এক ইমাম (আ.) কে শাহাতদের মুখে ঢেলে দেয়।

এবার আসুন আরো বিস্তারীতঃ

বর্তমানে দেখা যায় প্রায় সর্ব মহল থেকে আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়।

ইসলামের আগমনের পূর্বে আশুরা ছিল। যেমন আমরা হাদীস দ্বারা জানতে পেরেছি। তখন মক্কার মুশরিকরা যেমন আশুরার সওম পালন করত তেমনি ইহুদীরা মুছা আ. এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সওম পালন করত।

আল্লাহর রসূল (সা:) আশুরার সওম পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম রা. আশুরা পালন করেছেন। রসূলুল্লাহ (সা:) এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরী ৬১ সালে কারবালার ময়দানে জান্নাতী যুবকদের নেতা, রসূলুল্লাহ (সা:) এর প্রিয় নাতী সাইয়েদুনা হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। ঘটনাক্রমে এ মর্মান্তিক ইতিহাস এ আশুরার দিনে সংঘঠিত হয়েছিল।

আল্লাহর রসূল (সা:) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোন ভূমিকা ছিলনা। থাকার প্রশ্নই আসতে পারেনা। কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর আল্লাহর রসূল (সা:) এর সাহবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. আব্দুল্লাহ বিন উমার রা. আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. আনাস বিন মালেক রা. আবু সাঈদ খুদরী রা. জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. সাহল বিন সায়াদ রা. যায়েদ বিন আরকাম রা. সালামাতা ইবনুল আওকা রা. সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রসূলুল্লাহ (সা:) ও তার পরিবারবর্গকে অনেক বেশী ভালবাসতেন। তারা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার কারণে কোন কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম,তাযিয়া মিছিল, আলোচনা সভা কোন কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আল্লাহর রসূল (সা:) যেভাবে আশুরা পালন করেছেন তারা সেভাবেই তা অনুসরণ করেছেন।

অতএব আমরা কারবালা কেন্দ্রিক যে আশুরা পালন করে থাকি, এ ধরণের আশুরা না রসুলুল্লাহ (সা:) পালন করেছেন, না তার সাহাবায়ে কেরাম। যদি এ পদ্ধতিতে আশুরা পালন আল্লাহর রসূলের মুহব্বাতের পরিচয় হয়ে থাকত, তাহলে এ সকল বিজ্ঞ সাহাবাগণ তা পালন থেকে বিরত থাকতেন না, তারা সাহসী ছিলেন। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। কিন্তু তারা তা করেননি। তাই যে সত্য কথাটি আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি, তা হলো আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার স্মরণে যা কিছু করা হয় তাতে আল্লাহর রসূল (সা:) ও তার সাহাবাদের রেখে যাওয়া আশুরাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক বিকৃত নতুন আশুরা প্রচলনের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

আশুরার দিনে সাইয়েদুনা হুসাইন বিন আলী রা. এর শাহাদাত স্মরণে যে তাযিয়া মিছিল করা হয়, যে মাতম করা হয়, আলোচনা সভার ব্যবস্থাসহ যা কিছু করা হয় এর সাথে ইসলামী শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই।

কারণ:

রসূলে কারীম (সা:) কারো জন্ম বা মৃত্যু দিবস অথবা শাহাদত দিবস পালন করেননি। তারপরে তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এ ধরনের কোন আমল করেননি। কেহ বলতে পারেন কারবালার ঘটনা যদি রসূলে কারীম (সা:)এর জীবদ্দশায় হত তাহলে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে এর স্মরনে শোক ও মাতম ইত্যাদির ব্যবস্থা করে যেতেন।

আসলে এ ধারনা একেবারেই বাতিল। কারণ রসূলুল্লাহ (সা:) এর জীবনে অনেক মর্মান্তিক ও হ্রদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে। তাঁর প্রিয়তমা সহধর্মীনি খাদিজা রা. র ইন্তেকাল তাকে সহ্য করতে হয়েছে। সাহাবীয়া সুমাইয়া রা. শাহাদত বরণ প্রতক্ষ করতে হয়েছে। তাঁর সামনে তাঁর একাধিক সন্তান ইন্তেকাল করেছেন। উহুদের যুদ্ধে তার প্রিয় চাচা ও দুধ ভাই হামযা রা. শাহাদত বরণ করেছেন। তিনি তার যে কত প্রিয় ছিলেন ও তার শাহাদতে তিনি যে কতখানি মর্মাহত হয়েছিলেন সীরাত পাঠক মাত্রই তা অবগত আছেন। তেমনি মুস‘আব বিন উমায়ের রা. সহ অনেক প্রিয় সাহাবী শহীদ হয়েছেন। তিনি তাদের জন্য অনেক ক্রন্দন করেছেনে। এমনকি ইন্তেকালের কয়েকদিন পূর্বে তিনি উহুদের ময়দানে তাদের কবর যিয়ারত করতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। সেখানে তাদের জন্য দু‘আ করেছেন। কিন্তু তাদের কারো জন্য তিনি শোক দিবস পালন করেননি।

উহুদ যুদ্ধের পর তিনি এক অঞ্চলের অধিবাসীদের দাবীর কারণে তাদেরই দ্বীনে ইসলাম শিক্ষা দেয়ার জন্য তাঁর প্রিয় সাহাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করে শিক্ষিত সত্তর জন সাহাবীকে সে অঞ্চলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু ‘বিরে মাউনা’ নামক স্থানে শক্ররা আক্রমন করে তাদের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের মাত্র একজন জীবন নিয়ে মদীনায় ফিরে এসে এ নির্মম ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। এ ঘটনায় রসূলুল্লাহ (সা:) এত ব্যথিত ও মর্মাহত হলেন যে, রাহমাতুললিল আলামীন হয়েও হত্যাকারীদের শাস্তি ও ধ্বংশ কামনা করে তিনি বহু দিন যাবত তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে থাকলেন। কোথায়! তিনি তো এ সকল মহান শহীদানের জন্য কোন দিবস পালন করতে নির্দেশ দিলেন না। প্রতি বছর শোক দিবস পালন করতে বললেন না।

মুতার যুদ্ধে তার তিনজন প্রিয় সেনাপতি সাহাবী শাহাদত বরণ করলেন। যায়েদ বিন হারিসা রা. জা‘ফর বিন আবি তালিব রা. ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা.। আরো অনেকে। যায়েদ বিন হারেসা রা. কে আল্লাহর রসূল (সা:) অত্যন্ত ভালবাসতেন। রসূলুল্লাহর ভালবাসার স্বীকৃতি হিসেবে সকলে তার উপাধি দিয়েছিল ‘হিব্বু রসূলিল্লাহ’। ইসলামের দাওয়াতের শুরু থেকে তিনি সর্বদা আল্লাহর রসূল (সা:) এর সাথে ছায়ার মত থাকতেন। আর জা‘ফর বিন আবি তালিব রসূলুল্লাহর চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি আলী রা. এর আপন ভাই ও সাইয়েদুনা হুসাইন (রা.) এর আপন চাচা ছিলেন। আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা রা. রসূলের ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের একজন ছিলেন। তাদের শাহাদাতের খবর মদীনাতে পৌছার পর রসূলে কারীম (সা:)কতখানি শোকাবিভূত হয়ে পড়েছিলেন সীরাত ও ইসলামী ইতিহাসের পাঠক তা ভালভাবে জানেন। রসূলে কারীম (সা:) কি তাদের জন্য শোক দিবস চালু করেছিলেন? না প্রচলন করতে বলেছিলেন? কখনো তা করেননি।

তারা তো ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই যুদ্ধ করেই জীবন দিয়েছিলেন। এ সকল মহাপ্রাণ সাহাবীদের সাথে তাঁর যেমন ছিল আতত্নীয়তার সম্পর্ক তেমনি ছিল দ্বীনে ইসলামের সম্পর্ক। কেহ বলতে পারবেন না যে তিনি তাদের কম ভালবাসতেন। তারপরও তিনি তাদের জন্য প্রতি বছর শোক পালনের ব্যবস্থা করলেন না।

এমনিভাবে রসূলে কারীম (সা:) এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম কতখানি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন তা হাদীস ও ইতিহাসের কিতাবে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। তারা তো প্রতি বছর দিবস পালনের প্রথা প্রচলন করলেন না।
এরপরে উমার রা. শহীদ হলেন, উসমান রা. শহীদ হলেন, শাহাদত বরণ করলেন হযরত আলী (রা.)। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম কারো জন্য শোক দিবস পালন করলেন না।

কারো জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস অথবা শাহাদত দিবস পালন ইসলাম অনুমোদন করে না। ইসলামের কথা হল মানুষ মানুষের হ্রদয়ে বেঁচে থাকবে, ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার আমল বা কর্মের মাধ্যমে। বছরে একবার দিবস পালন করে কাউকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই।

তাইতো দেখবেন কত নবী-রসূল, সাহাবা, ইমামগন, আওলিয়া, ন্যায় পরায়ন বাদশা, মনীষি রয়েছেন যাদের জন্য জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালিত হয় না। কিন্তু তারা কি মানুষের হৃদয় থেকে বা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গেছেন? না, তারা মানুষের হৃদয় দখল করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন।

হিজরী সনের সূচনা করেছিলেন খোদ রসূলুল্লাহ (সা.)

ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গ শাহাদাতের পরপরই নেপথ্য নায়কদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here