নজরুলের অগ্নিঝরা বাণী,তার অনিরুদ্ধ যৌবন শক্তির গীতিময় প্রকাশ। তার বন্ধন অসহিঞ্চু চিত্তের আগ্নেয় দুর্দান্ততা সবাইকে অভিভূত করে। নজরুল অমেয় প্রাণময়তার বহ্নিমান প্রতিমূর্তি। তার ললাটে চির যৌবানের রাজটিকা।কবির কাব্যজগতে প্রবেশ করলে ঊর্ধ্বকাশে দেখি ঝাঞ্চার আলোড়ন। নিম্নদেশে মাটির শ্যামল কোমলতা । বাঙালির ললিত গীতের রাজ্যে তিনি আমাদের শোনালেন রণক্ষেত্রের ভূর্যধ্বনি। নজরলের রক্ত টগবগানো গান গেয়ে তরুণ-প্রাণ সকলে কেড়ে নিয়েছেন।

কবি নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে মে । ছেলেবেলাতেই পিতৃহারা হয়ে নিদারুণ দারিদ্র্য আর অভিভাবকহীনতার কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হন। এ সময়ে লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযোজনা করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুল প্রতিভার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কর্মজীবনের প্রতি বেশি ঝুকে পড়েন। প্রথম মহাযুদ্ধে সময়ে তিনি বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং সেনা বাহিনীতে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
বাংলাকাব্যে নজরুল :
বিদ্রোহের জয়ধ্বনা উড়িয়ে ধূমকেতুর মতো কাজী নজরুল ইসলাম আবর্ভূত হয়েছিলেন বাংলা কাব্যে। উদাত্ত কন্ঠে তিনি ঘোষণা করেছেন-
’ বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।’
কেবল এ ’বিদ্রোহী’ কবিতাতেই বাংলা কবিতার আসরে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। কবি নজরুল হলেন বাংলার ’বিদ্রোহী কবি’। কবির বিদ্রোহী আত্মার জন্মের মূলে সে অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল তা হলো কবির প্রেম।
কবি তার আত্মপ্রকাশে বলে গেলেন-
’মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর অন্য হাতে রণতুর্য।’
কবি কন্ঠে উচ্চরিত হয়েছে।’জগতে আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম’সেখানে আমি প্রেম পাইনি’সেখানেই বিদ্রোহ করেছি।’কবি সত্য,সুন্দর ও মানবতার পূজারী। সকল প্রকার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
নজরুলের আবির্ভাবকাল :
ভারত বর্ষের এক অস্থিতিশীল পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আরম্ভ হলে তিনি সেনাদলে যোগ দিলেন। স্কুলেন পড়া ছেড়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে করাচি চলে এলেন। যুদ্ব শেষ হলে(১৯১৮) নজরুল হাবিলদার হয়ে ফিরে এলেন। তখন তার বয়স আঠারো-উনিশ। এ সময়ে বিপ্লবী বীর বারীন ঘোষের সাথে ঘনিষ্ঠতার সুত্রে তিনি বাঁধা পড়লেন। মেতে গেলেন স্বদেশী হাঙ্গামায়,জেলে গেলেন,বেদুইন নজরুল অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিলেন,ভাঙার গান’ লেখার প্রেরণা পেলেন। এভাবে উদাম ’বিদ্রোহী’ কবি জীবনে তার নেমে পড়ার ক্ষেত্রটি প্রস্তুত হতে লাগল। নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ’অগ্নিবীণা’ বেরুল ১৯২২ সালে।

প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম ওঠে নজরুলের। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে রচিত তার কবিতা’মুক্তি’এরই মধ্যে একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছাটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসার অবতীর্ণ হলেন। কোরআন,ও গীতা ও মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি,ফারসি,সংস্কৃতি ও বাংলার শব্দভান্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তার হাতে। আর ছিল উদাত্ত কন্ঠ ও রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কীর্তন বাউল জারি-সারি-ভাওয়ালিয়ার প্রতি প্রাণের টান। সেই সাথে ফারসি গজলের প্রাণ মাতানো সুরবাহারের প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ।

বিদ্রোহ ও যৌবনের কবিঃ
নজরুল চিরযৌবনের কবি। দুর্বার প্রাণ-প্রাচুর্যই যৌবনের নিশ্চিত প্রাণ-স্পন্দন। সব ধরণের শোষণ-শাসন-শৃঙ্খল আর দুর্জয় সাধনায় কবি ছিলেন ব্রতচারী,প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল দেখলেন দেশ পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি। ধনিক শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শোষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে কঙ্কাল পরিকীর্ণ এক বিশাল শ্মশানভূূমি। তখন তিনি গাইলেন-
’কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লোপাট
রক্তজমাট শিকল-পূূজার পাষাণ বেদী।’
সামাজিক জড়তা ও ক্লান্তিকর নৈষ্কর্ম্যরে মধ্যে কালবৈশাখি ঝড়ের মতো তিনি আবেগ জড়িত কন্ঠে গাইলেন-
’মেনে শত বাধা টিকি হাঁচি
টিকে দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি,এবার সব্যসাচী।’
নজরুলের বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে,তেমনি তার বিদ্রোহ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও। তার দৃষ্টিতে সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদই কৃত্রিম ও মিথ্যে। তার কথায়-
’ও কি চন্ডাল! চমকাও কেন? নহেও ঘৃণ্যজীব
ও হতে পারে হরিচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।’
তার ’অগ্নিবীণা’ ’বিষের বাঁশী’ ’সর্বহারা’ ’ফনি-মনসা’ প্রভৃতি কাব্যগুলোতে মূলত বিদ্রোহেরই সোচ্চার জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হয়েছে।
শ্রেণিবৈষম্য,ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ দুর্বলের রক্ত শোষণ মানব প্রেমিক কবিকে একেবারে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। সমানাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সুস্থ মানব সমাজের প্রতিই তার দৃষ্টি ছিল স্থিরবদ্ধ। সমষ্টিক মানুষের কল্যাণই ছিল তার প্রার্থিতা সাম্প্রদায়িকতা কিংবা জাতিভেদ মূলক কোনো প্রশ্ন কবির চিত্তকে সংকীর্ণতার পথে পরিচালিত করেনি। তার কাছে স্বদেশ ও স্বজাতিই ছিল সবচেয়ে বড় সত্য। তিনি জানতেন,হিন্দু-মুসলমান একই বৃন্তে দুটি কুসুম। তাই ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হলে কবি ’কান্ডারি হুশিয়ার’ ধ্বনিতে বললেন-
’হিন্দু না ওরা মুসলিম ? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষে,সন্তান মোর মার।’
দোষে-গুণে নজরুলঃ
নজরুল ইসলাম কবিতা লিখেছেন প্রচুর। গান লিখেছেন অসংখ্য। এসব কবিতা ও গানের সুর বৈচিত্র্যও কম নয়। তার কবিতা গুলোকে স্বদেশী কবিতা,প্রেমের কবিতা,নিসর্গ মূলক কবিতা ইত্যাদি কয়েকটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যায়। তার লেখার দোষ গুণ দুই-ই আছে। কবিতাগুলোতে একদিকে দেখা যায় কবিত্ব শক্তির আশ্চর্য অজ¯্রতা, অন্যদিকে দেখা যায় ওই শক্তির উচ্ছৃঙ্খলা অপচয়।তার কারণ,কবি কখনো সতর্ক হয়ে লেখেননি,লেখার পরিমার্জনা কাকে বলে তা জানতেন না। তাই এ গুলোর মধ্যে শিল্প সংগত পারিপাট্যের অভাব লক্ষণীয় । গানগুলো অধিকাংশই ফরমায়েশী। কাজেই কবির বেশির ভাগ গানে ভক্তির গানে-সত্যিই তিনি নিবিষ্ট চিত্ত শিল্পী সাধক। কবিতার শিল্পগত অপরিচ্ছন্নতা এ সংগীতে তিনি অনিকটা কাটিয়ে উঠেছেন। এসব দোষ-গুণ নিয়েই নজরুলের কাব্য প্রতিভা।
খুব বড় হওয়ার বাসনা নজরুল পোষণ করতেন না। নিজের ক্ষমতার সীমা কোথায়,তা তার অজানা ছিল না। যুগের দাবিকে স্বীকার করে নিয়ে বিদ্রোহের সুরে গান বাঁধতে তিনি এসেছেন এবং তাই তার কাছে যথেষ্ট মনে হয়েছে। তিনি তো নিজেই আমাদের শুনিয়েছেন, ’বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী।’এতে সমালোচকদের কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে গেছে। নজুরলের এ উজ্জ্বল অনন্যতা সর্বজনস্বীকৃত।
নজরুল বিদ্রোহী কবি,ব্যথিত মানবতার কবি। আমাদের প্রিয় কবি। তিনি তো বিদ্রোহী যৌবনের কপালে জয়তিলক একে দিয়ে তাকে ’দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার উত্তরণের মন্ত্রে’ দীক্ষিত করেছেন। নজরুলের সৃজনশীল সৃষ্টি আজও আমাদের প্রাণে শক্তি জোগায়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। নজরুল গণজাগরণের কবি,নিপীড়িত মানুষের কবি এবং আমার প্রিয় কবি।
লেখক- শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত সকল লেখার দায়ভার লেখকের। আমরা লেখকের চিন্তা ও মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রকাশিত লেখার সঙ্গে মাধ্যমটির সম্পাদকীয় নীতির মিল তাই সব সময় নাও থাকতে পারে।