খৎনা করার বিধান : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পুরুষের জন্য খৎনা করা সুন্নত, আর নারীদের জন্য উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ-৫/৭৫) ১৩ থেকে ১৪ জন নবী-রাসুল খৎনা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছেন। যেমন : ১. হজরত আদম (আ.), ২. শীশ (আ.), ৩. ইদ্রিস (আ.), ৪. নুহ (আ.), ৫. সাম (আ.), ৬. জাকারিয়া (আ.), ৭. লুত (আ.), ৮. ইউসুফ (আ.), ৯. মুসা (আ.), ১০. শুয়াইব (আ.), ১১. সুলায়মান (আ.), ১২. ইয়াহহিয়া (আ.), ১৩. ঈসা (আ.) ও ১৪. হজরত মুহাম্মদ (সা.)। (তাফসিরে কুরতুবি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৬)
খৎনা করার বয়স : হজরত ইবরাহিম (আ.) নিজ পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর খৎনা করান ১৩ বছরের সময়, আর ইসহাক (আ.)-এর খৎনা করান সাত বছরের সময়। হজরত লাইস ইবনে সাদ বলেন, সন্তানের খৎনা করাতে হবে সাত থেকে ১০ বছরের মধ্যে।
গোঁফ ও দাড়ির বিধান : হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করো। গোঁফ খাটো করো এবং দাড়ি লম্বা করো।’ (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস নং- ৯৪৭) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে সুন্দর করে দাড়ি রেখেছেন। (তিরমিযি, হাদিস নং-২৭৬২)। হজরত ইবনে ওমর (রা.) গোঁফ এরূপ খাটো করতেন যে চামড়া দেখা যেত। তিনি দাড়ি ধরতেন এবং এক মুষ্টির অধিক হলে হজ ও ওমরার সময় কেটে ফেলতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস-৫৮৯২) দাড়ি কামানো, দাড়ি এক মুষ্টির কম রাখা, ফ্রেন্স কাটিং বা অন্য কাটিংয়ের দাড়ি রাখা এবং গোঁফ লম্বা রাখা কুসংস্কার। দাড়ি কামানো এবং এক মুষ্টি হওয়ার আগে কেটে ফেলা ও ছাঁটা উভয়ই হারাম ও কবিরাহ গুনাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা গোঁফ ছোট করো এবং দাড়ি ছেড়ে দাও।’ (বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৭৫)
চুলে খেজাবের বিধান : চুলে কালো খেজাব দেওয়া মাকরুহ, অন্য রঙের খেজাব দেওয়া জায়েজ। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মেহেদির খেজাব ব্যবহার করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) খেজাব ব্যবহার করতেন না, কারণ তাঁর মাত্র ১৮ থেকে ২০টি চুল পেকেছিল। রাসুল (সা.) আবু কুয়াফার দাড়িতে খেজাব দেখে বলেছেন, চুলে সাদা ছাড়া অন্য রং করো, তবে কালো রং করা থেকে সতর্ক থাকো। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২১০২)
মিসওয়াক করা : মিসওয়াক করা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব সময় এ সুন্নত পালন করতেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্টকর হবে বলে মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাজে (অজুুতে) মিসওয়াক আবশ্যিক করে দিতাম। (সহিহ বুখারি, মুসলিম, মিশকাত; পৃষ্ঠা নম্বর-৪৪) হজরত হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠলে মিসওয়াক করতেন। (মিশকাত, পৃষ্ঠা নং- ৪০) হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মিসওয়াক মুখ পরিচ্ছন্নকারী, আল্লাহতায়ালাকে সন্তুষ্টকারী (দারেমি, নাসায়ি, মিশকাত; পৃষ্ঠা নম্বর-৪৪)। মিসওয়াক করার মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার হয় এবং পাকস্থলীর হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়, রোগ প্রতিরোধ করে ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়।
কুলি করা : অজু করার সময় কুলি করা সুন্নত। ফরজ গোসলের জন্য গড়গড়া করে কুলি করা ফরজ। তবে রোজার সময় গড়গড়া করা যাবে না। কারণ এতে ভেতরে পানি প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, উম্মুল মুমিনিন হজরত মাইমুনা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর জন্য গোসলের পানি এনে একটি কাপড় দিয়ে পর্দা করলাম, তিনি পানি দিয়ে উভয় হাত ধৌত করেন, তারপর বাঁ হাতে পানি নিয়ে গুপ্তাঙ্গ ধৌত করে মাটিতে হাত মাসেহ করে পানি দ্বারা হাত ধৌত করেন। এরপর তিনি কুলি করেন, নাকে পানি দেন এবং চেহারা ও হস্তদ্বয় কনুই পর্যন্ত ধৌত করেন। অতঃপর গোটা শরীরে পানি ঢালেন, নাক সাফ করেন এবং উভয় পা ধৌত করেন। আমি তাঁর জন্য একটি কাপড় আনলে তিনি তা গ্রহণ না করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেলেন।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত; পৃষ্ঠা-৪৮)
নাকে পানি দেওয়া : অজু করার সময় নাকে পানি দেওয়া সুন্নত। ফরজ গোসলে নাকে পানি দেওয়া ফরজ। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়, অতঃপর অজু করে, সে যেন তিনবার নাক পরিষ্কার করে। কেননা শয়তান নাকের ছিদ্রে রাত যাপন করে (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত; পৃষ্ঠা নম্বর-৪৫)
ইসতেনজার বিধান : প্রস্রাব ও পায়খানা করার পর মলদ্বার ও মূত্রদ্বার পরিষ্কার করা আবশ্যক। আর এ জন্য পানি ও ঢিলা উভয়ই ব্যবহার করা হয়। পানি দ্বারা ইসতেনজা করা উত্তম। আর ঢিলা ব্যবহার করা মুস্তাহাব। নাপাকি স্থান অতিক্রম করলে পানি ব্যবহার করা ওয়াজিব।
বগল ও নাভির নিচের পশমের বিধান : রাসুলুল্লাহ (সা.) বগলের পশম উপড়ে ফেলার এবং নাভির নিচের পশম মুণ্ডানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা বগলের পশম সহজে উপড়ানো যায়। পক্ষান্তরে নাভির নিচের পশম সহজে উপড়ানো যায় না। এ বিধান পরিচ্ছন্নতার জন্য। যদি কেউ বগলের পশম মুণ্ডায় এবং নাভির নিচের পশম উপড়ে ফেলে, এতেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে।
নখ কাটার বিধান : রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার নামাজে যাওয়ার আগে গোঁফ ও নখ কাটতেন। (আল মাজমাহ-২৫/১৮০) রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের নখ কাটো, কর্তিত অংশ পুঁতে রাখো, হাত ও পায়ের গিরাগুলো ধৌত করো, মুখে লেগে থাকা খাদ্য দূর করো ও মিসওয়াক করো। দুর্গন্ধ অবস্থায় আমার কাছে এসো না। (নাওয়াদেরুল উসুল, পৃষ্ঠা নম্বর-১১৫) অন্য হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আকাশের খবর জানতে এলে রাসুল (সা.) বলেন, সে আকাশের খবর জানতে এসেছে অথচ তার নখ পাখির নখের মতো, তাতে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকে। (আল কামেল : ৩/৩১৫) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের গোঁফ খাটো করার, নখ কাটার, নাভির নিচের পশম মুণ্ডানোর এবং বগলের পশম উপড়ানোর মেয়াদ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, তা হলো ঊর্ধ্বে ৪০ দিন। (মুসলিম, হাদিস নং-২৫৮, আবু দাউদ, হাদিস নং-৪২০০)
মাথায় চুল রাখার বিধান : রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো কান পর্যন্ত, আবার কখনো ছোট করে চুল রাখতেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.)-এর কেশ মুবারক অর্ধকর্ণ পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি ও মহানবী (সা.) একই পাত্রে গোসল করতাম। তাঁর কেশরাজি কর্ণলতি পর্যন্ত প্রলম্বিত চুল থেকে দীর্ঘ এবং স্কন্ধ পর্যন্ত প্রলম্বিত চুল থেকে খাটো ছিল। অর্থাৎ অতি দীর্ঘও ছিল না, আবার অতি খাটোও ছিল না; বরং মধ্যমপর্যায়ের ছিল। হজরত উম্মেহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.)-এর চুলকে চার ঝুঁটিবিশিষ্ট দেখেছি। হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, তাঁর পাগড়ি দুই কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত প্রশস্ত ছিল। তাঁর মাথার কেশ কর্ণলতি পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। হজরত আনাস (রা.)-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.)-এর কেশ মুবারক সম্পূর্ণ বক্রও ছিল না, আবার সম্পূর্ণ সোজাও ছিল না; বরং ঈষৎ ঢেউ খেলানো ছিল। আর ওই কেশ মুবারক কর্ণলতি পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল। হজরত ইবনে আব্বাস ও আয়েশা (রা.) প্রমুখ থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) চুলে চিরুনি ব্যবহার করতেন। (শামায়েলে তিরমিযি, হাদিস নং- ২৩-৩০)
লেখক : খতীব, কাজীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা