কাজী আয়েশা ফারজানা

kalerkanthoভূমি অফিসের কাজ নিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের অনেকেই দুশ্চিন্তায় থাকেন। দালালদের হয়রানি, অবৈধ লেনদেনসহ নানা ধরনের অনিয়ম এই দুশ্চিন্তার নেপথ্যে। এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি গণমুখী সেবা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন বোয়ালখালীর উপজেলা সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) মো. আলা উদ্দিন। পরিচ্ছন্ন অফিসের খোলা বারান্দায় চেয়ার-টেবিল পেতে নাগরিকদের সেবা দিচ্ছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলা ভূমি অফিসের ভবনের নিচে খোলা বারান্দায় চেয়ার-টেবিল পাতা। সেখানে এক সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলছেন এসি ল্যান্ড আলা উদ্দিন। তাঁর সামনে সারিবদ্ধ চেয়ারে বসা অন্য সেবাপ্রার্থীরা। সামনেই ব্যানারে লেখা, ‘দালালের কাছে যাবেন না, প্রতারিত হবেন না। নামজারির জন্য অনলাইনে আবেদন করে সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা গ্রহণ করুন। কোনো অভিযোগ বা অনিয়মের বিষয়ে সরাসরি এসি ল্যান্ডকে অবহিত করুন। ’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন আলা উদ্দিন তিনতলা থেকে নেমে আসেন নিচের খোলা বারান্দায়। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে ভূমিসংক্রান্ত শুনানি। শুনানিতে উঠে আসে সেবাপ্রার্থীর নানা সমস্যা, হয় সমাধানও। উৎপাত বন্ধে দালালদের ডাটাবেইস বানানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, অফিসকক্ষে সিসিটিভির মনিটরে কাউকে ফাইলপত্র নিয়ে বাইরে বসে থাকতে অথবা ঘুরতে দেখলেই নিজে এসে তাদের কক্ষে নিয়ে যান। নামজারির আগে নিজে গিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখে আসেন। সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে বাড়তি ফি আদায় না করতে সব কম্পিউটারের দোকানে মূল্যতালিকা দিয়েছেন। সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি ও দালাল প্রতিরোধে অফিসের বাইরে-ভেতরে বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। বন্ধ করেছেন ঘুষ ছাড়া ফাইল না নড়ার প্রচলিত রীতি। উপজেলার ৩৮টি মৌজাকে ডিজিটাইজ করার কাজও চলছে।

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভূমি অফিসের প্রধান ফটক পেরিয়ে বাঁ পাশে সেবাপ্রার্থীদের জন্য অপেক্ষা কক্ষ। সামনে মূল ভূমি অফিসের ভবন। ভবনের খোলা জায়গার দুই পাশে নানা ধরনের ফুলের বাগান। পেছনে নানা প্রজাতির সবজির বাগান। এক পাশে রয়েছে ফলের গাছ। সামনে ফুলের বাগানের বাহারি রং সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। মাঝখানে সাদা ভবনটি সবার নজর কাড়ছে। ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই হাতের বাঁ পাশে তথ্যসেবা (হেল্প ডেস্ক)। সেখানে একজন কর্মকর্তা আগত ব্যক্তিদের তথ্যসেবা দিচ্ছেন। কয়েক সিঁড়ি উঠলে হাতের ডানের দেয়ালে টাঙানো সিটিজেন চার্টার, যেখানে লেখা ভূমিসংক্রান্ত নানা ধরনের তথ্য। দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে একটি অভিযোগ বাক্স। শ্রেণীকরণ করা কক্ষে কাজ করছেন কর্মকর্তারা।

ভবনের নিচে বসে আছেন সেবাপ্রার্থীরা। সামনে এসি ল্যান্ড। সেবাপ্রার্থীরা সরাসরি তাঁদের সমস্যা এসি ল্যান্ডকে জানাচ্ছেন। টোকেনের মাধ্যমে সিরিয়াল ধরে সেবাগ্রহীতাদের ডাকছেন এসি ল্যান্ড। ধৈর্যসহকারে সেবাপ্রার্থীর কথা শুনে সমাধান দিচ্ছেন।

উপজেলার শাকপুরা থেকে আসা জানে আলম বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আমার জায়গা আরেকজনের নামে নামজারি হয়ে যায়। মাসের পর মাস ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি। এই এসি ল্যান্ড আসার পর খোলা বারান্দায় গণশুনানিতে অংশ নিয়েছি। এসি ল্যান্ড আমার সমস্যার কথা শুনে সহযোগিতা করেছেন। এখন ভুয়া নামজারিটি বাতিল হবে। তিনি কাউকে টাকা দিতে নিষেধ করেছেন। ’

কালুরঘাট থেকে জমির খাজনা দিতে আসা বৃদ্ধা ফাতেমা বেগম বসে ছিলেন বাইরে। এসি ল্যান্ড সিসি ক্যামরায় তাঁকে দেখে নিজে নিচে নেমে এসে সমস্যা সম্পর্কে জানতে চান। এরপর তাঁকে ওপরে নিয়ে খাজনা দিতে সহায়তা করেন।

নামজারি করতে আসা পোপাদিয়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকার বাসিন্দা মুনছুর আলম বলেন, ‘আগে এলে অনেক ঘোরাঘুরি করতে হতো। দালাল ধরতে হতো। দালাল ছাড়া কোনো কাজ করা প্রায় অসম্ভ ছিল। কিন্তু এখন এসি ল্যান্ড আলা উদ্দিনের আন্তরিকতা দেখে আমি অবাক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা প্রতিদিন মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। প্রকৃত দেশপ্রেম না থাকলে এটা অসম্ভব। ’

দলিল লেখক মাসুদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এই এসি ল্যান্ড আসার পর দালালরা সুযোগ পাচ্ছে না। ভূমি অফিসের পুরো চিত্রই তিনি বদলে দিয়েছেন। ’

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আলা উদ্দিন বলেন, ‘অনেক সময় সেবাপ্রার্থীরা এসি ল্যান্ডের কক্ষে যেতে সংকোচ বোধ করে। তাই আমি প্রতিদিন নিচের খোলা বারান্দায় বসি, যাতে মানুষ সরাসরি তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারে। মানুষের হয়রানি রোধে ভূমি অফিসে পরিবর্তন আনতে চাই। সে জন্য সবার সহযোগিতা চাই। আমি চাই সেবাপ্রার্থীরা নিঃসংকোচে কোনো মাধ্যম ছাড়া ভূমি অফিসে আসুক, তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলুক। আমি চেষ্টা করছি জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে। ’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here