সারাদেশে মহামারি করোনা সহ যে কোন দুর্যোগে জনসাধারণকে তথ্যসেবা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হলেও এ সেবায় নিবেদিত সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই উদাসীন ও নির্বিকার। ফলে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা উদ্বেগজনকহারে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। জীবনও দিচ্ছেন অকাতরে। ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ঘাটে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ৮ জন করোনা শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। বাকি ৮ জন নমুনা পরীক্ষা চলাকালে কিংবা করতে গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

সংবাদপত্রর আর্কাইভ ও গবেষণা সেল এ সংরক্ষিত তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে-১৬ জনের মধ্যে ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিক ৬ জন, ঢাকার বাইরে কর্মরত ৮ জন এবং বাকী ২জন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রবাসী। করোনা মহামারি সংক্রমন শুরুর পর মার্চ মাসে একজন, এপ্রিল মাসে ২ জন, মে মাসে ৫ জন এবং চলতি জুন মাসে বাকি ৯জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পাননি, বঞ্চিত হয়েছেন ন্যুনতম চিকিৎসা সুবিধা থেকেও। দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ পেশেও ব্যতিক্রম দেখা গেছে কেবল সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে। মৃত্যুবরণকারী ৫/৬ জন ছাড়া বাকিরা তেমন একটা আলোচনায়ও আসেননি। সংবাদমাধ্যমে ১৬ জনের সংবাদই প্রকাশিত হলেও অনেকের বেলায় মূলধারার গণমাধ্যমে হেলাফেলা ছিল চোখে পড়ার মতমৃত্যুর তলিকার বাইরে ৮০টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিনশ’ সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার দু’জন সম্পাদকসহ নবীন-প্রবীণ অনেক সাংবাদিক রয়েছেন। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাকিরা এখনো ভুগছেন।

জীবনের মায়া তুচ্ছ করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য কোন পক্ষ থেকেই প্রণোদনা বা মৃত্যুবরণকারী সাংবাদিকদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে না। সরকার কিংবা মালিক পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন নেই, তেমনি আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা বা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না।

আর করোনাকালে দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা, অসুস্থ হলে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত এব মৃত্যুবরণ করলে ৫০ লাখ পর্যন্ত অনুদানের ব্যবস্থা করলেও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। করোনায় আক্রান্ত যেসব সংবাদকর্মী মারা গেছেন তাদের পরিবারকে অনুদান দেওয়ার জন্য সাংবাবাদিক সংগঠনগুলো থেক দাবি তোলা হলেও সরকার কিংবা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন সাড়া মেলেনি।করোনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সাংবাদিকরা হলেন- ১. দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সিনিয়র ফটো সাংবাদিক স্বপন হাই। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ মার্চ মারা যান। ২. দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবির খোকন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৮ এপ্রিল উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খোকনের মৃত্যুতে গণমাধ্যমজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসার পাশাপাশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার করে। ৩. ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার ও ক্র্যাবের সাবেক সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক আসলাম রহমান গত ৭ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৪. সিলেট বাণীর বিশেষ প্রতিনিধি স্বপন কুমার দাস গত ৫ জুন আমেরিকার নিইউর্কের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৫. দৈনিক উত্তোরকোণের উপদেষ্টা সম্পাদক, বগুড়া প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোজাম্মেল হক তালুকদার গত ৪ জুন ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ৬. ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের কক্সবাজার প্রতিনিধি আবদুল মোনায়েম খান গত ৭ জুন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ৭. দৈনিক একুশে বাণীর সহ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হয় গত ২ জুন কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। ৮. সিলেটের বালাগঞ্জের সাংবাদিক লিটন দাস করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসাপতােল আনার পথে ১৫ জুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার আগেই করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে রয়েছেন- ১. দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র সহসম্পাদক মাহমুদুল হাকিম অপু (৬ মে নিজ বাসায়), ২. দৈনিক বাংলাদেশের পত্রিকার ফটো সাংবাদিক ও ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান (২০ মে ডিআরইউতে টেস্ট করাতে গিয়ে), ৩. ভোরের কাগজের সাবেক সহকারী সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা সুমন মাহমুদ ( ২২ মে আজগর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে), ৪. আমার প্রাণের বাংলাদেশ পত্রিকার সাতক্ষীরার তালা প্রতিনিধি আবদুস সালাম (২৯ এপ্রিল খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান), ৫. দৈনিক সমাচার ও চাঁদপুর জমিনের ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি এবং ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবের দপ্তর সম্পাদক আবুল হাসনাত ( ২৯ মে চাঁদপুর সদর হাসপাতালের আইসুলেশন ওয়ার্ডে), ৬. বিটিভির ক্যামেরা পার্সন আবু বকর (৫ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামের বাড়িতে), ৭. দৈনিক বগুড়ার বার্তা সম্পাদক ওয়াসিউর রহমান রতন ( ১১ জুন করোনা পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পর) এবং ৮. ভোরের কাগজের কুমিল্লার চান্দিনা প্রতিনিধি গোলাম মোস্তফা (১১ জুন নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়)।

সাংবাদিক নেতারা বলছেন-করোনাকালে দেশ ও মানুষের জন্য দায়িত্ব পালন করে যেসব সংবাদকর্মী করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন ও মারা যাচ্ছেন তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার দাবি জানিয়েছেন। এনিয়ে সরকার ও মালিক পক্ষের সঙ্গে তারা কথা বলছেন।

বিষয়ে কথা বললে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার সংবাদপত্রের কালো দিবস উপলক্ষে আমাদের একটা ভার্চুয়াল আলোচনা সভা ছিল। সেখানে আমরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সংবাদকর্মীদের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা দেয়ার জন্য সরকার ও মালিক পক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছি। আমরা খুব দ্রুতই এনিয়ে সরকার ও গণমাধ্যম মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। তিনি বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকরা কাজ করলেও তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করছে না মালিক পক্ষ। যার কারণে সংবাদকর্মীরা সব সময় আক্রান্ত হওয়ার ভয়-আতঙ্কে থাকেন। তাদের যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেও আমরা দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) অপরাংশের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম তপু বলেন, প্রথম থেকেই আমরা মালিক পক্ষকে বলে আসছি করোনাকালে যারা কাজ করছেন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা উদাসীন আচরণ করছেন। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ গণমাধ্যম মালিক তাদের কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি। যাতায়াতের জন্য গাড়ির ব্যবস্থাও করেনি। আমাদের সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা দেয়ার জন্যও আমরা মালিক পক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কিছুই বলেনি। তবে, দাবি আদায়ে আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here