ছোটবেলায় ইতিহাস পড়তে গিয়ে সবাই হয়তো একটি নাম মুখস্ত করেছেন, ‘ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী’। সুদীর্ঘ এই নাম যারা মুখস্ত করতে পেরেছেন বা মনে রাখতে পেরেছেন, তাদের স্মৃতিশক্তির প্রাখর্যের তারিফ করতেই হয়। বখতিয়ার সাহেবের বাংলা জয়ের মধ্য দিয়ে (১২০৪, মতান্তরে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা অঞ্চলে কেবল মুসলিম শাসনেরই সূচনা হলো না, বরং এ অঞ্চলের বাসিন্দারা পরিচিত হলো এক নতুন ধর্ম ও নতুন সংস্কৃতির সাথে।
এই ইসলাম ধর্ম, এই ইসলামি সংস্কৃতি জনপদের জীবনযাত্রা ও লোকাচারে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, দু’শো বছরের মধ্যে তা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক নতুন স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দিয়েছে। ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাসকে উপজীব্য করে রচিত হয় বাংলা গানের এক শক্তিশালী ধারা ‘ইসলামি গান।’ সপ্তম শতকে দূর আরব দেশে যে ধর্মের নবযাত্রা সূচিত হয়েছিলো, সেই ধর্মের উপাদান, আচার-বিশ্বাসকে ধারণ করেও বাংলা ভাষায় রচিত এসব গান আজ বাংলা গানের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
আজকের লেখায় আমরা বাংলা ইসলামি গান ও তাতে কাজী নজরুল ইসলাম অবশ্যম্ভাবী প্রাসংগিকতা নিয়ে আলোচনা করবো।
বাংলা গানের সম্ভার
ভাষা হিসেবে বাংলা যে খুব সমৃদ্ধ, তা সতত প্রমাণিত। আর খুব সম্ভবত পৃথিবীতে যতগুলো সমৃদ্ধ ভাষা আছে, সেসব ভাষার সংগীতের ক্ষেত্রটিও হয় দারুণ সমৃদ্ধ। বাংলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিপুল শব্দভাণ্ডার কিংবা ধ্বনিগত শ্রুতিমাধুর্যের পাশাপাশি বাংলার আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে এই ভাষায় রচিত বিভিন্ন রকমের গান, হরেক প্রজাতির সংগীত, যার মধ্যে একটি শাখা হচ্ছে ইসলামি গান। মধ্যযুগ থেকে বাংলায় ইসলামি গান রচনার প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়। তবে আধুনিক বাংলা ইসলামি গান রচনার সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটি হচ্ছে কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সৃষ্টিশীল হাতের ছোঁয়ায় বাংলা ইসলামি গান লোকগানের পর্যায় থেকে রাগ পর্যায়ের আধুনিক গানের মর্যাদা লাভ করে।
বাংলা গান ও ধর্মের প্রভাব
একটি সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বাংলা যেমন তার গতিধারায় অসংখ্য বিদেশি শব্দকে আলিঙ্গন করেছে, তেমনি বিভিন্ন দর্শন ও ধর্মমতকেও একীভূত করে নিয়েছে এই ভাষাটি। কবিতা ও সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীতেও এই একীভূতকরণের বিষয়টি লক্ষণীয়। বিভিন্ন ধর্মমতকে একীভূত করে নেওয়ার কথাটি কেন বললাম, তা একটু ব্যাখ্যা করে নিই।
বাংলা ভাষায় এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হলো চর্যাপদ। গবেষকরা একমত যে, এই চর্যাপদ ছিলো বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্মের সাধন গীতি। ১৯২৭ সালে ড মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ‘Buddhist Mystic Songs’ গ্রন্থে চর্যাপদের গানগুলো নিয়ে এমন মন্তব্যই করেছেন। [1]
এভাবেই বাংলা ভাষার ইতিহাসের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের একাত্মতা খুঁজে পাওয়া যায়। সনাতন হিন্দু ধর্মের শ্যামাসংগীত কিংবা ভজনগীতির খ্যাতিও অবিদিত নয়।
বাংলা ইসলামি গানের ইতিকথা
মধ্যযুগ থেকেই বাংলা কবিতায় ও গানে মুসলিম সাহিত্যিকদের সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষার প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কিংবা দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লায়লি-মজনু’ ইত্যাকার গল্পকাহিনী গ্রামে গ্রামে পালা আকারে গীত হতো কিংবা পুঁথি পাঠের আসর জমাতো। তখনকার যুগে এগুলোই ইসলামি গান হিসেবে পরিচিত ছিলো।
তবে মধ্যযুগের গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক যুগে এসে বাংলা গান তার সুর ও বাণীতে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি অর্জন করলেও বাংলা ইসলামি গান কিন্তু সেভাবে এগোতে পারেনি। গ্রামে-মহল্লায় কিছু লোকগীতি ধাচের ইসলামি গানের প্রচলন থাকলেও সুধীজনের কাছে তা সমাদৃত ছিলো না। না থাকার কারণও আছে বৈকি। তখনকার দিনের প্রচলিত ইসলামি বাংলা গানের ধর্মতাত্ত্বিক কদর থাকলেও গান হিসেবে এর মান কিংবা সুর-লয়ের অনেক ব্যত্যয় ছিলো।
তাই তো, বিংশ শতকে এসে বাঙালি মুসলিমরাও আধ্যাত্মিকতার চাহিদা মেটাতে উর্দু গজল কিংবা কাওয়ালি গান শুনে আত্মতৃপ্তি মেটাতেন। লোকগানের আদলে বেশ কিছু বাংলা ইসলামি গান সমাজে প্রচলিত ছিলো। সাংগীতিক মূল্যমান বিবেচনায় সেগুলো অভিজাত বাঙালি মুসলমানদের কাছে খুব একটা উচুদরের ছিলো না। বাজারে ইসলামি গান বলতে উর্দু গজল বা কাওয়ালি গানের রেকর্ড বিক্রি হতো দেদারসে। এগুলো শুনেই বাঙালি মুসলমানদের ভক্তিমূলক গানের তৃষ্ণা নিবারণ করতে হতো। এমনই বন্ধ্যাযুগে কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হলেন এক মহীরূহ হিসেবে। তাঁর অসাধারণ শিল্প কুশলতায় একের পর এক সৃষ্টি হতে লাগলো অনবদ্য সব ইসলামি গান। অচিরেই ইসলামি গান হয়ে উঠলো বাংলা গানের নতুন শাখারূপে।
ইসলামি গান রচনায় নজরুল
তবে নজরুলের ইসলামি গান রচনার শুরুটা একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট ছিলো না। প্রখ্যাত লোক-সংগীত শিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদের অনুরোধে তিনি ইসলামি গান লেখা শুরু করেন। নজরুল তখন এক গ্রামোফোন কোম্পানীর সাথে যুক্ত ছিলেন। আব্বাস উদ্দীন বললেন, “কাজীদা, একটা কথা মনে হয়, এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায়, এদের গান শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরেন বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? … আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন, তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।“
প্রস্তাবটি কবির ভালোই লাগলো। তবে বললেন, “আব্বাস, তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তার মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারি না।” এই ভগবতী ভট্টাচার্য ছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ। আব্বাস উদ্দীন ভগবতী বাবুকে কথাটা পাড়তেই তিনি সোজা ‘না’ করে দিলেন। এ ধরনের রেকর্ড বের করে তিনি লোকসান করতে চান না!
আব্বাস উদদীন ভগবতী বাবুর পেছনে লেগেই রইলেন। অবশেষে একদিন ভগবতী বাবুকে বললেন, “একটা এক্সপেরিমন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কী?” তিনি হেসে বললেন, “নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা করা যাবে।”
আব্বাস উদ্দীন নজরুল ইসলামকে ভগবতী বাবুর সম্মতির কথা জানাতেই নজরুল খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন ইসলামি গান লিখতে। নজরুলের সেই গান কোনটি আপনি কি জানেন?
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
এই সেই গান, যেটি ছাড়া বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসব যেন পূর্ণ হয় না। এই সেই গান, যা প্রতিটি বাঙালি মুসলমানকে আনন্দে উদ্বেল করে তোলে। এই সেই গান যা রচনার সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি সমান জনপ্রিয়। এই গানের পরদিনই নজরুল আরেকটি গান রচনা করে দেন, ‘ইসলামেরই ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।’
গান দুটো ১৯৩১ সালের নভেম্বরে রচিত ও সুরারোপিত হয়। পরের বছর রমজান মাসে ধারণ করা হয়। ঈদের আগে আগেই বাজারজাত করা হয়।
গান দুটি বাজারে এলে দেখা গেলো, রেকর্ডটি সুপার-ডুপার হিট করেছে। তরুণ, বৃদ্ধ, যুবা- সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে ‘এলো খুশির ঈদ’ গানটি। নজরুল আসলেই ইসলামি গানের রেকর্ড নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলেন। তাঁর অন্যান্য গানের মতো ইসলামি গানও সাফল্যের বৈতরণি পার হওয়ায় তাঁর চোখেমুখে সে কী আনন্দ! ওদিকে ভগবতী বাবুও খুশি। প্রকাশনার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়ে গেছে। যে ভগবতী বাবু ইসলামি গানের রেকর্ডের কথা শুনতেই চোখ-মুখ পাকিয়ে না করে দিয়েছিলেন, এবার তিনিই অনুরোধ করছেন এরকম আরো কয়েকটি ইসলামি গান রচনার জন্য! ব্যস, এভাবেই শুরু হলো নজরুলের ইসলামি গান রচনার অভিযাত্রা।
তবে নজরুল যে এবারই প্রথম ইসলামি গান লিখলেন তা কিন্তু নয়। অনেক ছোটবেলাতেই লেটো গানের দলে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল। সেখানে নানা ধরনের গানের পাশাপাশি ইসলামি ভাবাদর্শের সংগীতও তিনি রচনা করেছিলেন। এরকমই একটি গান,
নামাজী, তোর নামাজ হলো রে ভুল,
মসজিদে তুই রাখলি সিজদা ছাড়ি ঈমানের মূল।।
এছাড়া পরিণত জীবনে ‘বাজলো কী রে ভোরের সানাই’ শিরোনামের ইসলামি গানের মাধ্যমেই তিনি মূলত তাঁর সংগীত যাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন। লোকসংগীতের ধাচে রচিত তাঁর ‘সদা মন চাহে যাবো মদীনায়’ গানটি কিংবদন্তী শিল্পী আবদুল আলীমের কণ্ঠে গীত হয় ১৯২৯ সালেই।
শৈশবেই নজরুল ইসলাম ধর্মশিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ মানুষ। আট বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে নজরুল কিন্তু সেই বয়সেই মসজিদের মুয়াযযিন এবং মক্তবের উস্তাদ হিসেবে কাজ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মের শিক্ষা অত্যন্ত প্রগাঢ়ভাবে নজরুলের মানসপটে অংকিত হয়েছিলো, যার ছাপ পাওয়া যায় তাঁর ইসলামি সংগীতগুলোতে।
ইসলামি নজরুল সংগীতের বিষয় বৈচিত্র্য
ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনুষঙ্গগুলোর প্রায় সব বিষয়েই নজরুল ইসলামি গান লিখেছেন। তাওহীদ, রিসালাত, হামদ-নাত, আজান, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, শবে মিরাজ, শবে বরাত, শবে কদর, রমজান, ঈদ, মহররম, ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, জাগরণী গান, ইসলামের সাম্যের শিক্ষা, অমর ব্যক্তিত্ব, মুসলিম নারীর মর্যাদা- কী এমন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি সংগীত রচনা করেননি!
নজরুলের ইসলামি গানের সুর-বৈচিত্র্য
ইসলামি সংগীত রচনার ক্ষেত্রে ভাব ও সুরের সম্মিলন নজরুলের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি অসংখ্য ইসলামি গান রচনা করেছেন গজল আঙ্গিকে। [৩] দাদরা, কাহারবা, ঠুমরি কিংবা পল্লীর লোকসংগীতের ঢঙেও তিনি অনেক ইসলামি গান রচনা করেছেন। কিছু কিছু গানে তিনি বিদেশি সুরও অনুকরণ করেছেন। যেমন- তাঁর বিখ্যাত নাতে রাসূল,
ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়,
আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়।
এই গানে তুরস্কের বিখ্যাত ‘কাটিবিম ইশকাদার’ গানটির সুর অনুকরণ করা হয়েছে। মূল এই গানটি প্রায় পাঁচশ বছরের মতো পুরানো।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গানটির সুর অনুকরণ করে গান রচনা করা হয়েছে। একটি আরবি গানেও এই সুর চয়িত হয়েছে। খুব সম্ভবত, নজরুল এই আরবি সংস্করণ থেকেই দ্যোতিত হয়ে এই সুরে বাংলায় গান রচনা করেছেন। দ্রষ্টব্য, কবি এই সুরে আরো একটি গান রচনা করেছেন, সেটিও তুমুল শ্রোতাপ্রিয়- ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’। মূল তুর্কি গানটি শুনতে পারেন এখান থেকে,
ইসলামি গানের ভাষাশৈলী
বাংলা গানে গজলের পথিকৃৎ নজরুল। তাঁর সব গজল ইসলামি নয়; তবে তাঁর অপার্থিব প্রেম বিষয়ক ইসলামি গজলের সংখ্যাও কম নয়। [৫]। নজরুলের এসব গানে বাংলার পাশাপাশি আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের মিশেল সত্যিকার অর্থেই ইসলামি আবেশ সৃষ্টি করে। বহুভাষিকতা নজরুলের অপার সৃষ্টিশীলতার একটি মহত্তম দিক। এমনকি সংস্কৃতের নিগড়ে আবদ্ধ পৌরাণিক গল্প-গাঁথাতেও তিনি আরবি-ফারসি-উর্দুর ব্যবহার করে নতুনত্ব আনার প্রয়াস পেয়েছেন। এসব করতে গিয়ে তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমালোচিতও হয়েছেন বেশ।
তবে, ইসলামি সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর এই বহুভাষিক নৈপূণ্য বেশ প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে, সংগীতগুলোতে প্রকৃত ইসলামি আবহ সৃষ্টি করেছে, সর্বোপরি বাংলা সংগীতের জগতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কারণ, আরব-দেশ থেকে উদ্ভূত হওয়ায় ইসলামের অনেক পরিভাষাই আরবি। এছাড়া, তুর্কি-পারসিদের মাধ্যমে উপমহাদেশে ইসলামের বিস্তারণ বলে গানে আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি শব্দ কিংবা তুর্কি সুর আসলেই খুব মানানসই ঠেকে।
শাক্ত সংগীত রচনায় তুখোড় প্রতিভাবান নজরুল যখন ইসলামি সংগীত রচনায় মনোনিবেশ করলেন, তখন একটু একটু করে তাঁর ‘কাফের’ ‘হিন্দুয়ানী কবি’ তকমার গ্লানি কমতে লাগলো। কাজী আবদুল ওদুদ যথার্থই মন্তব্য করেছেন,
কবির নিজের কাছে এসব সঙ্গীত যথেষ্ট মূল্যবান, কেননা এসব সঙ্গীতের ভিতর দিয়েই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের চিত্তে তিনি প্রবেশপথ পেয়েছেন। মুসলিম জনসাধারণও যে এতে কিছু প্রীত না হয়েছে তা নয়।
ইসলামি সংগীতের বিশ্বজনীন ধারা ও বাংলা ইসলামি সংগীত
বাংলায় রচিত ইসলামি গান কেবল যে বাংলা গানের সম্পদ তা কিন্তু নয়। বরং সারা বিশ্বেই বিভিন্ন ভাষায় ইসলামের প্রশস্তি গেয়ে ইসলামি সংগীত রচিত হয়েছে। ফলে, বাংলা ইসলামি গান বিশ্ব-সম্পদ হিসেবেও পরিগণিত।
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) যেদিন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন, সেদিন মদিনার শিশুরা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যে ‘ত্বলাআল বাদরু আলাইনা…’ গানটি গেয়েছিলো, সম্ভবত সেদিন থেকেই ইসলামি গানের শুরু। সেই থেকে আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজিসহ বিশ্বের নানা ভাষায় ইসলামি সংগীত রচিত হয়েছে।
ইসলামি সংগীতের প্রধান দুটি প্রকার হলো- হামদ ও নাত। ‘হামদ-এ-বারী-তাআলা’ বা সংক্ষেপে ‘হামদ’ বলতে বোঝায় মহান আল্লাহ তাআলার প্রশস্তিসূচক গান। আর ‘নাত’ অর্থাৎ ‘নাত-এ-রাসূল (সা)’ বলতে মহানবী মুহাম্মাদ (সা) এর প্রশস্তিসূচক গানকে বোঝানো হয়। বিশ্বের অনেক প্রথিতযশা কবি ও সাহিত্যিক হামদ ও নাত রচনায় সাফল্য দেখিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ওমর খৈয়াম, হাফিজ, শেখ সাদী প্রমুখ পারসি কবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
‘নাতে রাসূল’ রচনায় নজরুলের সিদ্ধি
ইসলামি গানের কতকগুলো শাখার মধ্যে সম্ভবত ‘নাতে রাসূল (সা)’ রচনাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে, এই কথা থেকে পাঠকবর্গ যেন কোনোক্রমেই এটা ভেবে না বসেন যে, ইসলামি গানের অন্যান্য শাখায় বুঝি তাঁর দখল কিছুটা কম। মুসলমানদের জাগরণের জন্য তিনি অনবদ্য যেসব গান লিখেছেন, তাঁর প্রশংসা বলাই বাহুল্য। জাগরণমূলক ইসলামি গান রচনায় নজরুলের সমকক্ষ বাংলায় তো নয়ই, বিশ্বেও খুঁজে পাওয়া বিরল। এ অবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় রচিত ইসলামি গানের সাথে নজরুলের ইসলামি গানের তুলনা করতে গেলে আমাদেরকে প্রথাগত হামদ কিংবা নাতের আলোচনাই তুলে আনতে হয়।
বাংলা ভাষায় নজরুল কর্তৃক বিরচিত ইসলামি নাতগুলো ‘নাত-এ-রাসূল’ এর যে বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে, সেই অনুযায়ী অনেক উচ্চমানের। সুরের দিক থেকে বলুন, আর ভাব ও ভাষার গভীরতার দিক থেকে বলুন, সর্বদিক থেকেই গানগুলো উচ্চমানের। নিচের গানটির কথাই ধরুন না-
হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়।
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা ।।
নজরুলের নাতে রাসূল রচনার একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, তিনি তাঁর বেশিরভাগ গানেই মহানবী (সা)-কে দেখিয়েছেন একজন ‘মানবীয় চরিত্র’ হিসেবে, যিনি শিশুকালে মায়ের কোলে থেকে কখনো হেসে ওঠেন, কখনো কেঁদে ওঠেন, যিনি মেষ চরান রাখাল বালকের মতো। নবীজীর (সা) প্রশস্তি গাইবার জন্য তাঁর আধ্যাত্মিক সত্ত্বার তুলনায় তাঁর মানবীয় চরিত্রের পরিস্ফূটন নজরুলের রচনায় সতত দীপ্যমান। সুর ও বাণীতে নজরুলের গজল অনন্য। [৫]
নজরুলের ইসলামি গান রচনা ও সম্পাদনা
নজরুল রচিত যতগুলো ইসলামি গান পাওয়া গেছে, তার মোট সংখ্যা প্রায় ২৮০টি। প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হবে। তবে, যে কয়টি গান পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতেই বলা যায়, বাংলা ইসলামি গান রচনায় তিনি সর্বাধিক রচয়িতা হিসেবে আজতক অপ্রতিদ্বন্দ্বী। যদি তাঁর গানের সুর-মান নিয়ে বলা হয়, তবে নিঃসন্দেহে তিনিই একমাত্র। প্রায় ৮০ ভাগ গানের সুর সংযোজন করেছেন নজরুল নিজেই। ৪৬টি গান অন্যদের দ্বারা সুরারোপিত। এদের মধ্যে কমল দাশ গুপ্ত, কে মল্লিক, গিরীন চক্রবর্তী, পিয়ারু কাওয়াল, সুবল দাশগুপ্ত, দেলওয়ার হোসেন, আবদুল করিম খাঁ, আব্বাস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
নজরুলের ইসলামি গানের বাণীগুলো এতটাই ভাবাবেগপূর্ণ যে, এতে একজন বাঙালি মুসলিমের হৃদয়ের একেবারে মনের গহীন আকাঙ্ক্ষা এতে উদ্ভাসিত হয়েছে। যেমন-
দূর আরবের স্বপন দেখি বাংলাদেশের কুটির হতে…
গানটিতে এক হতদরিদ্র বাঙালির হজ্বব্রত পালনের মনোবাসনা অর্থাভাবে সেটা পালন করতে না পারার যে বেদনা গীত হয়েছে, তা প্রতিটি বাঙালি মুসলমানের একেবারে মনের কথা। অত্যন্ত চমৎকারভাবে প্রতিটি গানেই নজরুল এভাবে ইসলামি গান রচনায় সার্থকতার পরিচয় দিয়ে গেছেন।
এ কারণেই রেকর্ড রিলিজ হওয়া মাত্রই এর হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়ে যেতো। গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বেশ রমরমা ব্যবসা করতে লাগলো। দিন দিন চাহিদা এতই বেড়ে গেলো যে, গ্রামোফোন কোম্পানির অনুরোধে হিন্দু গায়ক-গায়িকাদেরকেই নাম বদলে মুসলমান সেজে ইসলামি গানের রেকর্ড বের করতে হলো। কারণ, আব্বাস উদ্দীন এবং আরো কয়েকজন সংগীতশিল্পী ছাড়া মুসলমান শিল্পী বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। এর ধারাবাহিকতায় ধীরেন দাস হলেন ‘গণি মিঞা’, ঊষারাণী হলেন ‘রওশন আরা বেগম’, সীতা দেবী হলেন ‘দুলি বিবি’, হরিমতী দেবী হলেন ‘সকিনা বেগম’, চিত্ত রায় নাম ধারণ করলেন ‘দেলওয়ার হোসেন’।
গিরীণ চক্রবর্ত্তী তো কয়েকবার নাম পাল্টালেন কয়েকটি রেকর্ডের জন্য। একবার ‘সোনা মিয়া’ নামে, একবার ‘সুজন মাঝি’ নামে, আর একবার ‘গোলাম হায়দার’ নামে! মুনশী মোহাম্মদ কাসেম তো ইতোপূর্বে হিন্দু গান গাইবার জন্য কে. মল্লিক ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। পরে ইসলামি নজরুল সংগীত গাইবার জন্য তিনি আবার নাম বদলালেন, তবে আসল নামে ফিরতে পারলেন না, নাম রাখলেন ‘মনু মিয়া’। আসল নাম ব্যবহার না করতে পারার একটা কারণ হলো, কে. মল্লিক তখন শ্যামাসংগীত গেয়ে বিখ্যাত, হিন্দু শ্রোতারা তার গানের রেকর্ড বেরুলেই লুফে নেন, তাকে হিন্দু হিসেবেও মনে করে নিয়েছেন। অথচ, তিনি মুসলিম হয়েও ইসলামি গান গাইবেন না- তা কী করে হয়? তাই, তিনি গিয়ে ধরলেন আব্বাস উদ্দীন আহমদকে। আর আব্বাস উদ্দীন গেলেন নজরুলের কাছে। নজরুল যথারীতি পাঠালেন ভগবতী বাবুর কাছে অনুমতির জন্য।
ভগবতী বাবু তো প্রস্তাব শুনে রেগে আগুন। কে. মল্লিক বাবুকে দিয়ে ইসলামি গান গাওয়ানো যাবে না, কারণ শ্রোতারা যদি একবার সেই কণ্ঠ চিনে ফেলেন আর বুঝে ফেলেন যে কে. মল্লিক আসলে মুসলমান, তবে তো শ্যামাসংগীতের রেকর্ড বিক্রিতে ভাটা পড়ে যাবে! তাই, কে মল্লিকের সেই স্বপ্ন আপাতত পূরণ হলো না। অবশ্য, ভগবতী বাবুর মৃত্যুর পর কে. মল্লিক নজরুলের ইসলামি গান বের করেছিলেন।
এভাবে ইসলামি গান গাইবার জন্য হিন্দু শিল্পীরা যেমন নাম বদলেছেন, তেমনি বিপরীতটিও কিন্তু ঘটেছে। অর্থাৎ নজরুলের হিন্দু ভাবাদর্শের গান গাইবার জন্যে মুসলিম শিল্পীরাও ছদ্মনাম নিয়েছেন। যেমন- তালাত মাহমুদ ‘তপন কুমার’ ছদ্মনামেই নজরুলের বিভিন্ন গান গেয়েছেন।
তবে কেবল যে রেকর্ড বের করবার তাগিদেই হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি নাম ধারণ করেছেন, সেটি বললে অবিচার হবে। ইসলামি সংগীত হলেও গানের তাল-লয়-সুর এত উচ্চমার্গের ছিলো যে, বিমুগ্ধ চিত্তে শিল্পীরা এসব তুলে নিয়েছেন স্ব-স্ব কণ্ঠে।
তবে এ পর্যন্ত মুসলিম-অমুসলিম অনেক শিল্পীই নিজ নামেই নজরুলের ইসলামি গান ধারণ করেছেন। ড. অনুপ ঘোষাল, অজয় রায়, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়সহ প্রবীণ-নবীন শত শিল্পীর নাম নেওয়া যাবে, যারা নিজেদের মূল নামেই ইসলামি গান গেয়েছেন। এমনকি, যেসব উর্দুভাষী শিল্পীদের কাওয়ালি গান শুনে ইসলামি সুরের স্বাদ মেটাতেন বাঙালিরা, সেই উর্দুভাষী কতক শিল্পীও ইসলামি নজরুল সংগীতের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে বাংলা ইসলামি গান রেকর্ড করেছেন।
ইসলামি গান রচনায় নজরুলের পারঙ্গমতা
নজরুল চিরায়তভাবেই সংগীত রচনায় যে ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন, ইসলামি সংগীত রচনায়ও তার কোনো ব্যত্যয় নেই। এ প্রসংগে এক মজার ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
একদা আব্বাস উদ্দীন আহমদ নজরুলের বাসায় গিয়ে দেখেন, আগে থেকেই কবি নজরুল গভীর মনোযোগে কী যেন লিখছেন। আব্বাস উদ্দীনকে বসতে ইঙ্গিত দিয়ে আবার মন দিলেন লেখায়। জোহরের সময় হলে আব্বাস তা কবিকে জানালেন, আর বললেন যে, কবিকে একটি গজল লিখে দিতে হবে। কবি তাড়াতাড়ি পরিষ্কার চাদর এনে বিছিয়ে দেন আব্বাস উদ্দীনকে নামাজ পড়ার জন্য। আব্বাস নামাজ পড়তে লাগলেন আর নজরুল গান লিখতে শুরু করে দিলেন।
আব্বাসের নামাজ শেষ হতে না হতেই নজরুল তার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন, নাও তোমার গজল। শিল্পী আব্বাস উদ্দীন অবাক হয়ে দেখলেন, এই অল্প সময়েই নজরুল চমৎকার ইসলামি গান লিখে ফেলেছেন; তা-ও আব্বাসের নামাজ পড়ার প্রসঙ্গ এনে। নজরুলের বিখ্যাত সেই গজলটি হলো-
হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড় আজ,
দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।’
কবি নজরুলের দেখানো পথে হেঁটে পরবর্তীতে আরো অনেকে বাংলায় ইসলামি গান রচনায় ব্রতী হন। এঁদের মধ্যে জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, মতিউর রহমান মল্লিক প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে বলাই বাহুল্য, গুণে বা গণনায় কেউই নজরুলকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
এই মহান কবি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। তাঁকে ঢাকায় সমাহিত করা হবে কোথায় তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ প্রসংগে কবির একটি গান প্রণিধানযোগ্য,
মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোর থেকেও মুয়াযযিনের আজান শুনতে পাই।
কবির সেই বিখ্যাত ইসলামি গানে ব্যক্ত হওয়া অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ীই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবরস্থ করা হয়।
এক নজরুলই যে পরিমাণ ও যে মানের ইসলামি গান উপহার দিয়ে গেলেন, তাতে বাংলা গানের এই রসদ পূর্ণ হয়ে রয়েছে। এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও এই শাখায় তিনি এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুলের ইসলামি গান রচনার আগে মুসলমানরা লোকসংগীত ধাঁচের ইসলামি সংগীত নিয়ে যে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, কবির এই অপূর্ব সৃষ্টিসম্ভার তা ঘুচিয়ে দিয়েছে। তাঁর এই সৃজন যে কেবল বাংলা গানে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছেন তা নয়, বরং বিশ্ব পরিমণ্ডলে ইসলামি গানের যে সুবৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, সেই ধারাকেও করে গেছে সমৃদ্ধ। কারণ, নজরুল রচিত ইসলামি সংগীতগুলো সুরে কিংবা বাণীতে বিশ্বের প্রথিতযশা ইসলামি সংগীতকারদের রচিত সংগীতের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।
References
1. Buddhist Mystic Songs; Dr Muhammad Shahidullah; Publishers: Mowla Brothers; First Publication: 1927
2. আব্বাসউদ্দীন আহমদ: আমার শিল্পী জীবনের কথা, হাসি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড, ঢাকা-১১০০, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০০২।
3. নজরুল-গীতি প্রসঙ্গ; করুণাময় গোস্বামী; প্রকাশক: বাংলা একাডেমী; প্রথম প্রকাশঃ ১৯৭৮।
4. বাংলা গানের পথচলা; অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়; আজকাল পাবলিশার্স প্রাইভেট লি.
5. নজরুলের ইসলামী গজল; গাজী আবদুল হাই; ছিদ্দিকিয়া লাইব্রেরি, ১৯৬২