শ্রী শ্রীমৎ স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজের সমাধি পীঠে নবনির্মিত শ্রী মন্দিরের উদ্বোধন ও কধুরখীল জগদানন্দ মিশন (আশ্রম) প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে দুইদিনব্যাপী মহোৎসব আগামী কাল বৃহস্পতিবার ভোরে শুরু হবে।

এ উপলক্ষে কধুরখীল জগদানন্দ মিশনের উদ্যােগে দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা, শত মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, ধর্ম সম্মেলন, মহানাম সংকীর্তন, শ্রী মন্দির উদ্বোধন, মহাত্মা সম্মেলন ও সংগীতানুষ্ঠান।

বৃহস্পতিবার ঊষালগ্নে বাল্যভোগ ও পূজারতির মধ্য দিয়ে মহোৎসবে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। এরপর সকাল ১০টায় মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন করবেন উত্তম কুমার চন্দ ঝুনু। এইদিন দুপুরে প্রসাদ বিতরণ, বিকেল ৩টায় সংগীতানুষ্ঠান, সন্ধ্যায় শত মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও মহতী ধর্ম সম্মেলনে উদ্বোধন করবেন তুলসী ধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ দেবদীপ মিত্র চৌধুরী।

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তথ্যমন্ত্রী ড.হাসান মাহমুদ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের এমপি মুক্তিযোদ্ধা মোছলেম উদ্দিন আহমদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অরজিৎ চৌধুরী। প্রধান আলোচক হিসেবে থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রফেসর ড. গনেশ চন্দ্র রায়, আলোচক হিসেবে থাকবেন চণ্ডী তীর্থ মেধস আশ্রম পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক সচ্চিদানন্দ রায় ও অধ্যাপক স্বদেশ চক্রবর্তী।

ধর্ম সম্মেলনে ‘শ্রী শ্রী জগদানন্দ লীলা প্রসঙ্গ’ ও স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করবেন অতিথিবৃন্দ। এছাড়া রাত সাড়ে ৮টায় রয়েছে সংগীতানুষ্ঠান ও রাত ১০টায় প্রসাদ বিতরণ।

মহোৎসবের ২য়দিন শুক্রবার সকাল ৮টায় নবনির্মিত শ্রী মন্দিরের উদ্বোধন করবেন শঙ্কর মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ তপনানন্দ গিরি মহারাজ। ওইদিন অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে সকাল ৯টায় যজ্ঞানুষ্ঠান, দুপুর ১টায় প্রসাদ বিতরণ, বিকেল ৩টায় মহাত্মা সম্মেলন, সন্ধ্যায় সংবর্ধনা, মহানাম সংকীর্তন, রাত ৯টায় সংগীতানুষ্ঠান ও রাত ১০টায় প্রসাদ বিতরণ।

সংক্ষিপ্ত জীবনী:
শ্রী শ্রীমৎ স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজ ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১জানুয়ারী পটিয়া থানার অখ্যাত পল্লী মেলঘর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শশীরাম সরকার ও মা ব্রজেশ্বরী দেবী। তাঁর পিতৃ পদত্ত নাম ছিলো জগদবন্ধু সরকার। এই পরিবার চক্রশালা গ্রাম থেকে মেলঘরে এসে বসতি স্থাপন করেন। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যেই দিব্যভাবের স্ফুরন ঘটে। ১২ বছর বয়সে তিনি শ্রীগুরু শঙ্কর পুরী মহারাজের কাছে দীক্ষা লাভ করেন।তখন তিনি পটিয়া বঙ্গ বিদ্যালয়ের ছাত্র।

প্রবেশিকা পরীক্ষার পর ভাটিখাইন গ্রামের কৃষ্ণকান্তের প্রথমা কন্যা যোগমায়া দেবীর সঙ্গে তিনি পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স সতেরো। অতঃপর তিনি সরকারি বনবিভাগে ফরেস্টার এর পদে চাকুরী গ্রহন করেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল চন্দনাইশের কাঞ্চননগর ও বাড়বকুন্ডের বনভূমি।

যোগমায়া ১০ বছর ধরে প্রায়ই অসুস্থ থাকার পর পরলোক গমন করলে তাঁর ছোটবোনকে বিয়ে করেন জগদ্বন্ধু। মহামায়ার গর্ভে জগদ্বন্ধুর তিন পুত্র ও দুই কন্যা জন্মগ্রহন করেন। কনিষ্ঠপুত্র রেবতী গর্ভে থাকা অবস্থায় জগদ্বন্ধু গৃহত্যাগ করেন।

গুরু মহারাজের অন্বেষণে তিনি তীর্থে তীর্থে পরিব্রাজক রূপে ভ্রমণ করেছেন। হিমালয়ের গভীর অরণ্যসঙ্কুল পর্বতে তিনি গুরুকৃপায় হর-পার্বতীর দর্শন পান। তাঁদেরই কৃপায় তিনি নৈমিষারণ্যে শ্রীগুরু শঙ্কর পুরী মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করেন। এখানে তাঁর অনেকদিন কাটে। গুরু সান্নিধ্যে ও নির্দেশে ‍তিনি যোগসিদ্ধি লাভ করেন। গুরুর কাছে আ্জীবন থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে লোকালয়ে তার কর্ম রয়েছে বলে গুরুর ইচ্ছায় তাঁকে আশ্রম ত্যাগ করতে হয়। গুরু তাঁর নামকরণ করে জগদানন্দ।

অতঃপর তিনি তিব্বতের মানস সরোবরের তীরে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটান। শিবচর্তুদশীর মহালগ্নে তিনি সুক্ষ্মদেহে শিবভূমি কৈলাসপর্বত শৃঙ্গে আরোহণ করেন এবং ভগবান পশুপতি ও জননী পার্বতীর দর্শন লাভে ধন্য হন।কৈলাস থেকে তিনি আসামের দেবীতীর্থ কামাখ্যায় এসে যোনিপীঠ দর্শন করেন। ত্রিপুরার পর্বতমালার ভিতর দিয়ে আরাকান হয়ে তিনি ব্রহ্মদেশ তথা মায়ানমারের রেঙ্গুনে উপনীত হন এবং বিষ প্রয়োগে মৃত মাদ্রাজের ব্যায়ামবীর প্রফেসর রামমূর্তিকে বাঁচিয়ে তোলেন। শিষ্য রামমূর্তিই তাঁকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে। সতীর্থ মহেন্দ্র ঘোষাল জগদানন্দকে পাহাড়তলীর বনভূমিতে আশ্রম গড়ার আহ্বান জানান। এখানে তিনি বেশকিছুদিন কাটান। মহাযোগী জগদানন্দের সেই আশ্রম বর্তমানে “কৈবল্যধাম‘’নামে অভিহিত। ধনাট্য মহেন্দ্র ঘোষাল অত‍ঃপর তাঁকে কর্ণফুলী তটে গঙ্গাবাড়ী আশ্রমে এসে থাকার অনুরোধ জানান। পাথর ঘাটার গঙ্গাবাড়ী আশ্রম ‍ছিল শিষ্য বাক্ সিদ্ধ সাধক নগেশানন্দ ব্রহ্মচারীর। ইতোমধ্যে মহাযোগীর দেহের বয়স সত্তর হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় বাঁশখালী থানার পুণ্যভূমি বাণীগ্রামে পরমভাগবত প্রতাপচন্দ্রের গৃহে অতিথি হয়ে এলেন। আয়ুর্বেদাচার্য প্রতাপচন্দ্রের ব্রহ্মনিষ্ঠ পুত্র অদ্বৈতই যেন তাঁকে এখানে আকর্ষণ করে এনেছেন।অদ্বৈতের বয়স তখন ষোল। গুরুর মানসপুত্র শিষ্য। অদ্বৈতকে দীক্ষা দিয়ে তিনি শিষ্যত্বে বরণ করে নিলেন। তারপর থেকে স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজ বারবার বাণীগ্রামে ছুটে আসেন, অকাতরে ঢেলে দেন ব্রহ্মানুভূতি লাভের যোগকৌশল। শিষ্যকে আপ্তকাম করে তুলতে মহান গুরুর কি অতুলনীয়া প্রচেষ্টা!

স্বামী জগদানন্দ একাধারে ঋতম্ভরা প্রভার অধিকারী, ত্রিকালদর্শী ঋষি, আত্মভাবে পরিপূর্ণ মহাত্মা, চিদানন্দস্বরূপ শিব, মরমী কবি, চিরানন্দ ভাবরাজ্যের অমর প্রতীক, চিত্তবিমোহন সঙ্গীতের স্রষ্টা, ব্রহ্মবিদ বরিষ্ঠ শিবকল্পতরু অদ্বৈতানন্দ জগদানন্দের মানস সরোবরে প্রস্ফুটিত অম্লান ব্রহ্ম কমল। স্বামী জগদানন্দ পুরী মহারাজ সুগভীর অধ্যাত্মভাব ‘সমৃদ্ধ’ ‍ভাবকুসুম, ‘ভাবমুকুল’ ও “ জগদানন্দ লহরী’’ নামে কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। ১৯৩৮ সালের ১৫ জুলাই গঙ্গাবাড়ী আশ্রমে ৮৮ বছর বয়সে তিনি মহাসমাধিতে মগ্ন হন।
তখন ঘনঘোর বর্ষা। অঝোর ধারে বৃষ্টি ঝরছে। মেলঘরবাসীর সঙ্কল্প ব্রহ্মলীন মহাযোগীর জ্যোতি বিভাসিত দিব্যদেহ স্বগ্রামেই সমাহিত করা হবে। তিন পুত্র শৈলেন্দ্রনাথ, যতীন্দ্রনাথ ও রেবতীরমণের ইচ্ছাও তাই। কিন্ত সকলের অগোচরে অলৌকিকভাবে সেদিন সন্ধ্যায় সা্ম্পানগুলো গোমদন্ডীর লাগোয়া ছনদন্ডী খালে গিয়ে ঠেকল। কধুরখীল গ্র‍ামের স্কুলের পাশে প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরীর পৈতৃক ভূমিতে তিনদিন পর তাঁর পবিত্র যোগাগ্নিময় দেহটিকে সমাহিত করা হয় শিষ্য শিবকল্পতরু অদ্বৈতানন্দের উদ্যোগে। সেদিন অগণিত শিষ্য-ভক্ত-অনুরাগী জনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন গোমদন্ডী যোগাশ্রমের স্বামী হরিকৃপানন্দ বা মুনিবাবা, তমিজউদ্দিন ফকির, শিষ্য স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ প্রমুখ পরমার্থ পথিকবৃন্দ।

গুরুনিষ্ঠ সাধনসিদ্ধ শ্রীমৎ স্বামী অদ্বৈতানন্দ পুরী মহারাজ ছাড়াও মহাযোগী শ্রীমৎ স্বামী জগদানন্দ পুরী পরমহংসদেবের অন্যান্য কৃতি সন্তানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-সিদ্ধসাধকগণ হলেন লক্ষ্ণো নগরীর শ্রীশ্রী যোগেশ্বর মঠের মঠাধীশ স্বামী যোগানন্দ, পুরীধামস্থ স্বামী রামানন্দ, হিমালয়ে ব্রহ্মলীন স্বামী পরমানন্দ, স্বামী শীতলানন্দ, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, স্বামী নগেশানন্দ, স্বামী বিমলানন্দ পুরী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here