কাজী রোজী
অনেক অনেক দিন আগের কথা, আমার ছোটবেলার কথা, আমার মেয়েবেলার কথা। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে তখন মাটির চুলায় কাঠের আগুনে রান্নাবান্না করা হতো। আমার নানি রান্না করতেন, আমি পাশে বসে দেখতাম। দিনেও দেখেছি, রাতেও দেখেছি। হাটের দিনে তরিতরকারি, মাছ— সব আনার পরে নানি মাছগুলো রান্নায় বসে যেতেন সন্ধ্যারাতে। তারপর আমরা সেই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।
মুসলিম সমাজে দুটি ঈদের পর্ব আছে। একটি ঈদ-উল-ফিতর আর একটি ঈদ-উল-আযহা। বলা হতো রোজার ঈদ এবং কোরবানির ঈদ। দুটোরই ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ মেজাজ থাকত। মনে পড়ে নতুন জামাকাপড় পরে নানির পাশে গিয়ে যখন বসতাম, দেখতাম ফিরনি, পোলাও, কোরমা, জর্দা, সেমাই কতটা রান্না হয়েছে, কিভাবে রান্না হচ্ছে। মাটির চুলোয় কাঠের আগুনে রান্না করা ফিরনি-পায়েস অসম্ভব সুস্বাদু হতো। পাড়ার ছোট ছোট আমার মতো ভাইবোনেরা সবাই নানির পাশে জড়ো হয়ে যেত। নানি পেট ভরে খাওয়াতেন না কিন্তু তৃপ্তিসহকারে খাওয়াতেন। আসলে মাটির চুলোয় কাঠের আগুন অসম্ভব উপাদেয় খাবার তৈরি করতে পারে।
আমি মায়ের হাতেও একই ধরনের রান্না খেয়েছি। ঈদের দিনের বহুমাত্রিক খাবার মা সমাদর করে খাওয়াতেন। বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-পরিজন সবাইরে মনের তৃপ্তিসহকারে খাওয়াতেন। আজকাল সেই মাটির চুলোর প্রচলন অনেক কমে গেছে। ভুসির আগুনের চুলো, কেরোসিনের চুলো, স্টোভ এবং তারপর গ্যাসের চুলো, বিদ্যুতের চুলো, সৌরশক্তির চুলো আমাদের ভিন্ন ধারার সাথে পরিচিত করেছে। ঈদের দিনের রকমারি স্বাদের রান্নাগুলো মনপ্রাণ ভরিয়ে রাখত বলে সেদিন আর এদিন তফাত করে খুঁজতে চাই না। স্বাদের ভিন্নতা আনতে চাই না। ভূরিভোজের প্রয়োজনে খিচুড়ি রাখতে হতো।
রোজার ঈদের তরিকা আলাদা। খেলাধুলা, নাগরদোলায় চড়া, মেলার আয়োজন— সবই এক মাস সিয়াম সাধনের পরে অত্যন্ত আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি করে দিত। সকাল হলেই ঈদের দিনে বড়দের প্রতি সালাম এবং ভক্তি প্রদর্শন করে ছোটরা আন্তরিকভাবে সালামি পেত। সেটা দিয়ে তারা সারাটা দিনের চাহিদা মেটাত। আমি নিজেও আমার ভাইবোনদের নিয়ে একইভাবে রোজার ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করতাম। বলতাম, কোরমা, পোলাও, ফিরনি খাব যার যা মনে ধরে। সবার দোয়ার খোলা, কোথাও নাহি মানা। দু হাত তুলে খোদার কাছে করব মোনাজাত। জীবন ভরে ঈদের খুশি বইবে দিবস রাত।
ফিতরার প্রচলনটা সেদিন থেকে আজ অব্দি চলে আসছে। দেয়ার মধ্যে যে আনন্দ এবং তৃপ্তি তা ঈদের দিন বোঝা যায়। রমজানের সারা মাসের পবিত্রতা মনে ধরে নিয়ে দু হাতে বিলিয়ে দিতে কি যে স্বচ্ছন্দ বোধ করা যায় তা বলে বোঝানো যায় না। ছোটরা নতুন কাপড় এবং খাওয়া পেয়ে যতটা উত্ফুল্ল হতে পারে, বড়রা ফিতরা দান করে ততটাই আনন্দ পেতে পারেন। সিয়াম সাধনার পর সন্ধ্যায় ইফতারের যে আনন্দ পাওয়া যায় তাও ঈদকে কাছে টানতে শুরু করে। শক্তি এবং পবিত্রতা ইসলাম ধর্মের আধার হয়ে সমস্ত মুসলিম সমাজকে আপ্লুত করে। আমি নিজেকেও একজন গর্বিত মুসলিম নাগরিক মনে করি তখন। সেরা মানুষ নিজেকে ভাবতে শিখি তখন।
কোরবানির ঈদ প্রসঙ্গে দু-চারটে কথা বলতেই হয়। পবিত্র এদিনে আমাদের ছোট ছোট হাতে মাংসের টুকরো প্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছে দিতে অসম্ভব ভালো লাগে। হূদয় মন ভরে যায়। আত্মীয়-কুটুম এবং বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলেমিশে মাংস বিলানো একটি প্রথা হয়েছিল। ভালো লাগার মধ্য দিয়ে দানখয়রাত না হলেও মাংস এবং ঈদের আনন্দ বিলিয়ে দেবার জন্য ফিরনি-পায়েস, জর্দা সবার ঘরে থাকত। জবাইকৃত পশুর মাংস ঘরে আনার পরে নানি একই মাটির চুলোয় কাঠের আগুনে রান্না করতেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে আমরা পিঁড়ি পেতে বসে যেতাম নানির পাশে। সুগন্ধে রসনা নিবৃত্ত করতে পারতাম না। নানি আমাদের পাতে পাতে পৌঁছে দিতেন ভাত এবং মাংস। আমরা তা খেয়ে অতিশয় আনন্দিত হতাম। আমি মাকেও দেখেছি একইভাবে পরিবেশন করতে। সব নানি, সব মা যেন একই আঁচলের পতাকায় আমাদের বড় করতেন, খাবার দিতেন, জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতেন। সেই নানি আজ আর নেই, সেই মাও অনেকের আজ নেই, ঈদের দিনে বড্ড বেশি মনে পড়ে মায়ের কথা। দুচোখ তার গভীর আনন্দ-উচ্ছলে থাকত। এখন আমি আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে একই ধারা কতটুক মানতে পারি। কোথায় মাটির চুলো, কোথায় কাঠের আগুন, কোথায় মাটির হাঁড়ি। এখনো হাতড়িয়ে ফিরি, পেয়ে যাই গ্যাসের চুলো। তাতে করে যা রান্না করতে পারি, মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের তৃপ্তিটাই তো আসে না। তবুও উন্নয়ন চাই, অগ্রগতি চাই, সমগ্র বাংলাদেশজুড়ে গ্যাসের চুলার সুবিধা সবাই ভোগ করুক।
ঈদের কথা আমাদের জীবনের কথা, আমাদের ধর্মীয় ঐহিহ্যের কথা। আকাশের চাঁদের ভালোবাসার কথা। পশুপাখির নিবেদনের কথা। সবকিছু আমাদের খোলা দরজায় এসে দাঁড়ায়। চাঁদ দেখার আনন্দের কথা, পবিত্র আত্মা নিয়ে ঘরে ফেরার কথা আমাদের বৈশিষ্ট্যগুলোকে উজ্জ্বল করে দেয়। ঈদ-পার্বণের কথাই শুধু আজ বললাম। অন্যান্য শত পার্বণের কথা আরেক দিন বলব। তবে আমার হিন্দু বন্ধুদের আমি কাছে ডাকি ঈদের দিনে, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বন্ধুদেরও ডাকি ঈদের দিনে।
মানবপ্রেমের বন্ধনে আমরা আমাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করি। জয় হোক মানবতার, জয় হোক ঈদ উত্সবের, জয় হোক আমার সেকাল-একালজুড়ে প্রতিদিনকার, প্রতিনিয়ত ঈদের আনন্দ-উত্সব।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here