আকবর হোসেন রবিন 

১. উপরোক্ত উক্তিটি যার, তিনি কবিয়াল ফণী ভূষণ বড়ুয়া। জন্ম চট্টগ্রাম জেলার পাঁচখাইন গ্রামে। ১৩২২ সালের ১৭ শ্রাবণ তারিখে। শৈশবে মাতৃহারা। লেখাপড়া প্রাইমারির গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দেন বর্মায়। সেখানে গিয়ে পরিচয় হলো মতিলাল বড়ুয়ার সাথে। মতিলাল বড়ুয়া কবিগান গাইতেন। প্রতিপক্ষ হতেন কখনও এজহার মিঞা কখনো নিবারণ শীল। তাদের কবিগান শুনে তাঁর মনেও কবিয়াল হবার প্রেরণা জাগে। সুরে ছন্দে কথা বলার একপ্রকার নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। কিন্তু রাতারাতি তো আর কেউ কবিয়াল হতে পারে না। কবিয়াল হয়ে উঠার পেছনে থাকে তার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও সাধনা। ফণী বড়ুয়া তাই হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ শাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত-বাংলাসাহিত্যের ধারা ইত্যাদি বিষয়ে স্বচ্ছজ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সজাগ  থাকতেন মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকে শুরু করে স্বদেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে। এছাড়াও কবিয়াল রমেশ শীলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ঘুরে বেড়াতেন প্রতিটি গানের পালায়। যেখানে কবিগান সেখানেই ফণী বড়ুয়া উপস্থিত থাকতেন নিয়মিত। ধীরে ধীরে আয়ত্ত করতে থাকেন কবিতা, ছড়ার ছন্দ, সুর, ব্যাপ্তি ও বিষয়বস্তু। এইভাবে দুই বছর কেটে গেল। তখনও স্বাধীন সত্তা নিয়ে কবিয়ালরূপে ফণী বড়ুয়ার পরিচিতি হয়নি। ঘটনাচক্রে সে সুযোগ একদিন লাভ করলেন তিনি।

সেদিন ছিলো দোল পূর্ণিমা। কবিগান হবে শাকপুরায়। নোয়াখালীর মোহনবাঁশিকে নিয়ে গান করবেন রমেশ শীল। উভয় পক্ষে বায়না গ্রহণ করেছেন তিনিই। কিন্তু রাত দশটা বেজে যায়, তবুও মোহনবাসীর দেখা নেই। দূরদূরান্ত থেকে সমাগত শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। গান হবে না জানলে ক্ষিপ্ত শ্রোতারা বায়নাদাতার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। তখন রমেশ শীল বায়নাদাতাকে আশ্বস্ত করলেন, ‘ভয় নেই। আমার শিষ্য ফণী আছে। ওকে নিয়েই আমি গান চালিয়ে যাবো।’ ওদিকে আসরে চারদিক থেকে হৈ-চৈ শুরু হয়ে গেছে। নিরুপায় গুরু নির্দেশ দিলেন ফণী বড়ুয়াকে,‘তুই আসরে যা, গান আরম্ভ কর। এছাড়া আর কোন উপায় নেই।’ দ্বিরুক্তি না করে গুরুকে প্রণাম করে আসরে উঠে পড়লেন ফণী বড়ুয়া। শুরু হলো তার নতুন পথচলা। ভাবীকালের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল – এর আবির্ভাব হলো আকস্মিক এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।

২. কবিয়ালদের রচিত গানগুলি সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। কিছু গান আসরে আয়োজকদের নির্দেশমতো উপস্থিত রচনা। আর কিছু গান অবসরে ভেবে চিন্তে রচিত। উপস্থিত রচনার গান গুলো লিপিবদ্ধ করে রাখার কোনও সুযোগ সেকালে ছিল না, তবে অবসর সময়ে রচিত গানগুলিই কবিয়ালদের ভাবনা-চিন্তার ফসল এবং ব্যক্তিগত জীবনাদর্শের পরিচয় প্রদান করে। ফণী বড়ুয়া তাঁর দীর্ঘ কবি জীবনে অসংখ্য গান গেয়েছেন, লিখেছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তাঁর পাঁচটি গানের বই এবং এখানে সেখানে কিছু বিক্ষিপ্ত সংকলন ও উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এসবে তিনি জনজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনা, হাসি-কান্নার ঘটনা ও সংগ্রামী ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। গানকে সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে শান্তির পক্ষে গেয়েছেন-

কাঁদে আকাশ কাঁদে বাতাস

সোনার সংসার জ্বলি ছাই

ঘর ছাড়িয়া বাহিরে হৈলাম

পেটে দানা পানি নাই।

কিসের রাবণ, কিসের লক্ষণ

কিসের রামের রামায়ণ?

যুদ্ধ যদি ধ্বংস আনে

সে সব গ্রন্থ অকারণ

রাজায় রাজায যুদ্ধ তাহা মরে জনসাধারণ।

……………………

দেহে যুদ্ধ, মনে যুদ্ধ, যুদ্ধ নাই যে বিবেকে

শান্তি বিরাজ না করিলে

প্রাণের বাতি জ্বালাবে কে?

৩.

পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন- শোষণের প্রথম আগ্রাসন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে আন্দোলনের মাঠে নামে লেখক, কবি, সাংবাদিকসহ শিল্পী সম্প্রদায়। এই সময় আন্দোলনরত ছাত্র জনতাকে রমেশ-ফণীর কবিগান ব্যাপক উৎসাহ যোগায়। তখন ভাষা আন্দোলন নিয়ে ফণী বড়ুয়া রচনা করেন-

বাঙালিদের বাংলা ভাষা রাখি ইজ্জত মান

হাসি মুখে শফিক, বরকত করে জীবন দান।

রমনার মাটি লাল হইলো তাজা বুকের খুনে

বাঙালির মন জ্বলে উঠে বিদ্রোহের আগুনে

মিটিং মিছিল হরতালের ছুটিল তুফান

বজ্রকন্ঠে আওয়াজ উঠে বাংলা মোদের প্রাণ

কাঁপি উঠে স্বৈরাচারী জালেম শাহির দল

গুলি লাঠি গেরেফতারি হইল অচল।

৪. বিশ শতকের চল্লিশ দশকের শেষভাগের আগেও কবিগান ছিলো দেব-বন্দনা, শাস্ত্র-পুরাণের চিরাচরিত বিষয়বস্তু ও অশ্লীলতাশ্রয়ী পারস্পরিক ব্যক্তিগত আক্রমণ। কবিগানের এই ধারা থেকে মুক্ত করে গণমুখী পালাবদলে কবিয়াল ফণী বড়ুয়া পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন।  ধর্মের আবর্ত থেকে দূরে এসে দেশমাতৃকার সেবায় সমকালীন রাজনীতিকে কবিগানের বিষয়বস্তুতে পরিণত করেছেন। গানের মাধ্যমে সংযোগ করেছিলেন রাজনীতিবীদ ও জনসাধারণের মাঝে। এখানে উদাহারণস্বরূপ একটা ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে- দেশে তখন ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন চলে। সেসময় একবার চট্টগ্রামের  লালদিঘির ময়দানে মাওলানা ভাসানী এসেছিলেন। তখন ফণি বড়ুয়াকে ডাকা হলো গান গাইতে। তিনি গাইলেন-

মরি হায় রে হায় দুঃখে পরাণ যায়-

পাকিস্তানের আজব কথা শুনবি যদি আয়।

কেন পাকিস্তানের নদীর গতি হলো একপ্রকার

পূর্ব দিকে ভাটা শুধু পশ্চিমে জোয়ার।

টাকায় চৌদ্দ আনা পশ্চিমে যায়, দুই আনা পূর্বেতে

তুমি আমি মুসলমান ভাই টুপি আর দাড়িতে।

সেদিন ভাসানী তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন- আমি যা বলতে চেয়েছি, তা ফণী বড়ুয়া অতি সহজে সরল ভাষায় আপনাদের কাছে পোঁছে দিয়েছে।

৫. কবি- লেখকদের একধরনের ক্ষমতা থাকে, তাঁরা সমসাময়িক ঘটনার সাথে সাথে পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতও বলে যেতে পারে। যেমন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় ফণী বড়ুয়া যা রচনা করেছেন তা এখনকার সময়ের জন্যও খাটে।

ভোট দিয়ো ভাই, গরীব দরদি চাই,

আমার দেশের ভাই,

ভোট দিয়ো গরীব দরদি চাই,

ভোটের সময় দেশের মাঝে

মুরগির বন্ধু শৃগাল সাজে

দোষ ঢাকিয়া নিজের গুণ দেখাই

আমার দেশের ভাই………

৬. দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তানি স্বৈর শাসকের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করলো। কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ, কৃষকশ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তি বাস্তবে অর্জিত না হওয়ায় কবি ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন:

…………………….

(যারা) তাজা বুকের রক্ত দিল স্বাধীন বাংলা গড়িতে,

তাদের ভাই-ভগিনী কেন ভিক্ষা মাগে ফুটপাতে।

দুঃখীজনের নয়নজলে যাহারা আজ সাঁতার খেলে,

টাকার পাহাড় গড়ে তোলে চালিয়ে শোষণের কলে।।

৭. ফণী বড়ুয়া একসময় জীবিকার তাগিদে যেমন এক চোখে ঘোলা আতশি কাচের ঠুলি পরে, আরেক চোখ কুঁচকে ঘড়ি ঠিক করেছেন, তেমনি তিনি জীবনকে সময় দিয়েছেন। কবিগান থেকে অশ্লীলতা মুক্ত করে জীবনের সমান্তরালে চলার গতি দিয়েছেন। তাঁর গুরু কবিয়াল রমেশ শীলকে সাথে নিয়ে কবিগানে এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্যবোধ ও চারিত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও তিনি সময়ের সদ্ব্যবহারে ছিলেন সর্বদা সজাগ। ছোট ছেলে প্রিয়তোষ হেলাফেলা করে সময় নষ্ট করায় ম্যাট্রিক ফেল করেছিল। তাই মনের দুঃখে লিখেছেন-

সময়ের কী মূল্য আছে বুঝস্ না

এই জীবনের সময় সুযোগ

হারাইলে আর পাবি না।

যখন তোমার শিশু বেলা

করিয়াছ কতো খেলা

ভালোমন্দ না বুঝিলে

এই জীবনের ঘটনা।

যখন তোমার যৌবন এল

বসন্তকাল দেখা দিল

কত সময় নষ্ট হল

করি মিথ্যা কামনা।

আছে দেহনদীর জোয়ার ভাটা

আয়ু তোমার ঘড়ির কাঁটা

কোন সময়ে বাজে বারোটা

তুমি সেটা জান না।

যারা বুঝে না সময়ের মূল্য

জীবন তার পশুর তুল্য

যেদিন গেছে গতকল্য সেদিন ফিরে আসবে না।

সত্তুর বছর আয়ু পাইলে

তাহারে তিন ভাগ করলে

কাজের সময় একভাগ মিলে

হিসাব করে দেখলি না।

একভাগ গেছে ঘুমের ঘোরে

গময় কাঁদে তোমার তরে

জীবন গঠন করিবারে

করলি না তো সাধনা।

সময়ের কী মূল্য আছে বুঝ না।

৮. ফণী বড়ুয়া আমাদের অনেক দিয়েছেন- তার গান, কবিতা, উপস্থিতিতে। সেই মেধা ও দীপ্তির প্রকাশ বিধৃত হয়ে আছে তার রচনায়। জনপ্রিয়তার অনন্য ছন্দে শুধু নয়; ফণী বড়ুয়া তার বিচিত্র সব ইচ্ছে, আকাঙ্খা, অপূর্ণতা, স্বপ্ন তার গান কবিতার মধ্য দিয়ে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সে সব স্বপ্নের আভা তার অগণিত পাঠক-শ্রোতার হৃদয়ে চির-অমিলন হয়ে থাকবে। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হল, ফণী বড়ুয়ার প্রত্যেকটি কবিতা, ছড়ায় সুর সংযোজন করার জন্য সুরশিল্পী, ছন্দ শিল্পী। সুর ছন্দ ও স্বরারোপ করে ফণী বড়ুয়ার প্রত্যেকটি কবিতা গানের মোহন ছন্দে বিশ্ব পরিক্রমায় ছড়িয়ে দেওয়া।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কবিয়াল ফণী বড়ুয়াকে সঙ্গীত ক্ষেত্রে তাঁর গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতি স্বরুপ একুশে পদক পুরুষ্কারে ভূষিত করেছে। সে বছর ২২ জুন মহান এই কবিয়াল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন 

নির্দেশিকা:

১। কবিয়াল ফণী বড়ুয়া স্মারকগ্রন্থ,  সম্পাদনায়: শিমুল বড়ুয়া

৩। অধ্যাপক বাদল বরণ বড়ুয়া ও অধ্যাপক শিমুল বড়ুয়া গৃহীত ফণী বড়ুয়ার স্বাক্ষাৎকার।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here