ইউনুস কানন : চট্টগ্রামের অলি-গলিতে মাজার। মাজারকে স্থানীয়রা দরবার বলে। আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ, মানত, আরোগ্য কামনাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষের সমাগম হয় এসব দরবারে। কয়েক শত বছর ধরে টিকে থাকা দরবারগুলো চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে।

চট্টগ্রামের লোকেরা নিজেদের চাটগাঁইয়া বলে দাবি করে। ভৌগোলিকভাবে স্থায়ী বাসিন্দার পরিচয় ও ঐতিহ্য লালনের দিককে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই এই দাবি। তা ভালো এবং প্রশংসার দাবিদার। তবে চাটগাঁইয়াদের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে পীর-আউলিয়া ও বুজুর্গরা। তাদের প্রভাবেই চাটগাঁইয়াদের ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও সামাজিক রীতিনীতি দেশের মূল সংস্কৃতি থেকে অনেকটাই আলাদা। আর দরবারগুলো এখানকার মানুষের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশার উপলক্ষকে কেন্দ্র করে যেন তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। চাটগাঁইয়াদের মধ্যে দরবার-ভক্তি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও যখন দরবারে ভক্তরা চোখের জল ফেলে ফরিয়াদ জানায়, তখন তার গুরুত্ব কেমন হয়, তা সহজে অনুমান করা যায়।

আজকের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যাত্রাটা শুরু হয়েছে অনেক আগে। সমুদ্রপথে যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর থেকে চট্টগ্রাম ভারতবর্ষের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দরের মর্যাদা পায়। আরব ব্যবসায়ী ও মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এখানে। ইবনে বতুতার মতো পরিব্রাজকও পানিপথে এদেশে আসেন।
তবে বড় দাগে ধরতে গেলে সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়ার সুফি-দরবেশ ও দার্শনিকদের আগমন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের আগমনে মূল বাংলা থেকে অনেকটাই বদলে গেছে চাটগাঁইয়াদের ভাষা ও সংস্কৃতি। যা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বেশ মিলে যায়। লোকসংস্কৃতিতে শক্তপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে সুফি-দরবেশদের জীবনাচরণ ও তাদের নামে স্থাপিত দরবারগুলো।

জনশ্রুতি আছে, ১২ আউলিয়ার ভূমি চট্টগ্রাম। বায়েজিদ বোস্তামি, মাইজ ভান্ডারি, মোহসেন আউলিয়া, গরিবুল্লাহ শাহ- এর মতো বিখ্যাত সুফি সাধকরা এখানে এসেছেন ধর্ম প্রচারের জন্য। তাদের অনেক ভক্ত ও শিষ্যদের মাজার অবস্থিত এখানে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, চট্টগ্রামের অধিকাংশ জামে মসজিদের ভেতরে অথবা বাইরে দেয়াল ঘেঁষে বহু মাজার রয়েছে। এই মাজারগুলোতে অসংখ্য খাদেম রয়েছেন। প্রতিবছর মাজারগুলোতে ওরশ হয়। যদিও খাদেমপ্রথা এবং ওরশ উদযাপন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে তা চলছে। এসব এখন চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চাটগাঁইয়ারা মসজিদেও যায়, মাজারেও যায়। মাজার বা দরবারগুলো এখন চট্ট্রগ্রামের ঐতিহ্য। ইচ্ছা করলেই কেউ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবে না।
              ‘মাজার শরিফে সেজদা করা শরিয়ত মতে নিষেধ’ হলেও অনেকে তা করছেন

বার আউলিয়াদের একজন সুলতানুল আরেফিন হজরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.)। তিনি ইরানের নাগরিক। তার জন্ম সাল নিয়ে মতবিরোধ আছে। কেউ বলেন,  খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষভাগে বা  খ্রীষ্টীয় নবম  শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে আসার পর তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় এক পাহাড়ের ওপর ‘খানকাহ’ গড়ে তোলেন। ধর্ম প্রচারকালে এখানে তাঁর বহু ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি হয়।

জনশ্রুতি আছে, একপর্যায়ে হজরত বায়েজিত বোস্তামি চট্টগ্রাম ছেড়ে ইরানে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হলে তাঁর ভক্তরা তাকে এখানে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তখন ভক্তদের ভালোবাসা ও ভক্তিতে মুগ্ধ হয়ে নিজের কনিষ্ঠ আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়তে দেন এবং ওই স্থানে তাঁর নামে মাজার গড়ে তুলতে বলেন তিনি। আনুমানিক ৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার সমাধি ইরানে।

বায়েজিদ বোস্তামির দরবারটি নাসিরাবাদে অবস্থিত হলেও এখন এলাকাটি বায়েজিদ নামে পরিচিত। তিন গম্বুজের একটি মসজিদ, বিশালাকার দীঘি ও মাজারবেষ্টিত এলাকা। বায়েজিদ বোস্তামির মাজার থেকে একটু পশ্চিমে আরো অনেকগুলো মাজার আছে। লোকমুখে শোনা যায়, এগুলো তাঁর ভক্তদের। কিছু মাজারে নাম খোদাই করা আছে।

একজন দর্শনার্থীর কাছে যে বিষয়টি খুবই আকর্ষণ করবে তা হলো, দীঘিতে বিচরণ করা বিরল প্রজাতির বড় বড় কচ্ছপ ও কচ্ছপী। কেউ কোনো খাবার দিলে কচ্ছপগুলো মাথা উঁচিয়ে হা করে তা খেয়ে নেয়। দর্শনার্থীরা চাইলে মাজারের প্রবেশপথে বসা দোকান থেকে কচ্ছপের খাবার কিনতে পারেন।
          বায়েজিত বোস্তামির মাজারে বিরল প্রজাতির কচ্ছপ-কচ্ছপী ভাসছে

তিন গম্বুজের মসজিদের পাশ দিয়ে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মাজারে যাওয়ার সিঁড়ি রয়েছে। দর্শনার্থীদের আনাগোনায় কোলাহলময় থাকে মাজার। কেউ রোগমুক্তির আশায়, কেউ আসেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি বা পরিবারের শান্তির আশায়। আবার নিঃসন্তান মা-বাবারা আসেন সন্তান লাভের বাসনায়।

অনেক সাহস নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম কয়েকজন দর্শনার্থীর কাছে, কেন এসেছেন মাজারে? না, যা ভেবেছিলাম তা নয়। শান্ত-সরল উত্তর পেলাম- ‘বিশ্বাস। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর।’ কেউ কেউ বললেন, ‘বিশ্বাস অটুট রেখে কিছু চাইলে হুজুরের উছিলায় তা পাওয়া যায়।’ আবার একজন বললেন, তিনি ‘মাজারে বিশ্বাস করেন না। দেখার উদ্দেশেই এসেছেন।’ মতের ভিন্নতা থাকবে এটি স্বাভাবিক। যার বিশ্বাস তার অন্তরে। তবে আগেই বলেছি, চট্টগ্রামের সংস্কৃতির সঙ্গে মাজারগুলো এমনভাবে মিশে গেছে, তা আলাদা করা সম্ভব নয়।

মূল মাজারের প্রবেশপথে বড় অক্ষরে খোদাই করা আছে ‘মাজার শরিফে সেজদা করা শরিয়ত মতে নিষেধ’। তারপরও অনেকেই সেজদা করছেন। কেউ আবার মাজারের পিলার কিংবা দেয়ালে চুমু খাচ্ছেন। আবার কেউ এসেছেন জিয়ারতের উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যা নামলে মাজারের দক্ষিণ পাশে জ্বলে ওঠে মোমবাতি। একটি, দুটি করে সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেক মোমবাতি যখন একসঙ্গে জ্বলতে থাকে, তখন মনে হয় মাজারে আলোর মিছিল চলছে। এক ব্যক্তি মোমবাতি ধরাচ্ছিলেন। দেখে মনে হলো তিনি দর্শনার্থী। জানতে চাইলাম, কেন মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন। বললেন, ‘পরিবারে অশান্তি। সেই অশান্তি যেন দূর হয়, সেই প্রত্যাশা নিয়ে মোমবাতি জ্বালাচ্ছি। এখানে সবাই এমন করে, তাই আমিও করছি।’
   সম্পর্ক আজীবন অটুট থাকুক, এই প্রত্যাশায় মাজারে গাছের শাখায় সুতা বাঁধছেন তরুণ-তরুণী

মাজারের খাদেমদের কাছে মোমবাতি পাওয়া যায়। আরো পাওয়া যায় লাল সুতা। দর্শনার্থীদের এসব কিনে নিতে হয়। যেখানে লাল সুতা বিক্রি হচ্ছে, তার কয়েক কদম দূরে দুটি গাছের শাখায় সুতা বাঁধতে দেখা গেল দুজনকে। সুতা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে গাছের শাখাগুলো দেখাই যাচ্ছে না। কি জানি, এত সুতা কে কবে বেঁধে গেছে! কত সুখ-দুঃখের গল্প জড়িয়ে আছে বাঁধা সুতার ভাঁজে ভাঁজে! এক তরুণ ও এক তরুণী খুব যত্ন করে গাছের শাখায় সুতা বাঁধছিলেন। জানতে চাইলে তারা বললেন, ‘আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসি। আমাদের এই সম্পর্ক যেন আজীবন অটুট থাকে, সেই প্রত্যাশা নিয়ে সুতা বাঁধছি। জানি না, এতে কোনো কাজ হয় কি না। তবে অনেকের মুখে শুনেছি, তারা ফল পেয়েছেন।’

লেখক : কথা সাহিত্যিক।

এবি/টিআর

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here