নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
রাস্তার পাশের দোকানটিতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে লাল, নীল, হলুদ ও সবুজ রঙের বদনা। সেখান থেকে এগুলো কিনে নিচ্ছেন মানুষজন। এরপর তাঁরা সরাসরি চলে যাচ্ছেন মাজারে। পানি ভরে মনোবাসনা পূরণের জন্য বদনাটি রেখে আসছেন। আবার কেউ কেউ মাজার জিয়ারত করছেন।
নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন প্রবর্তক মোড় এলাকায় মূল সড়কের পাশে বদনা শাহ (র.) মাজার। আর সেখানেই ভক্তদের আনাগোনা।
আড়াই শত বছরের পুরোনো এই মাজার। এই মাজারের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। বদনা শাহ (র.)-এর প্রকৃত নাম ছিল হযরত মোহাম্মদ শফি শাহ (র.)। ইয়েমেন থেকে তিনি এই অঞ্চলে আসেন। বর্তমান মাজার এলাকায় এসে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হন। বদর শাহ (র.) এর ওফাতের দিন–ক্ষণ জানা যায়নি। তবে এই মাজার শরীফের বয়স প্রায় আড়াই শত বছর ছাড়িয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তাঁর বর্তমান বংশধর সৈয়দ মনির আহমেদ।
তিনি জানান, শফি শাহ (র.)-এর হাতে সব সময়ে একটি বদনা থাকতো। সেই বদনার কোনো তলা ছিল না। অর্থাৎ বদনাটি ছিল তলাবিহীন। এরপরেও বদনাটি পানিতে পরিপূর্ণ থাকতো সব সময়। সেই পানি পান করে সাধারণ অসুখ থেকে দুরারোগ্য অসুখ–বিসুখে আক্রান্ত রোগীও সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতো। এভাবে এ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে অসুস্থ মানুষজন তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। আর তখন থেকেই হযরত মোহাম্মদ শফি শাহ (র.) সবার কাছে বদনা শাহ (র.) হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মাজারে এখনো দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশা,
ধর্ম–বর্ণের মানুষ। রোগ–ব্যাধি সহ নানা মনোবাসনা পূরণের জন্য ভক্ত–অনুরক্তরা পিতল ও প্লাস্টিকের বদনায় পানিসহ মাজারে রেখে যান। প্রতি বৃহস্পতিবার মাজারে ইবাদত–বন্দেগির মাধ্যমে সেই পানিকে দোয়া–দরুদের মাধ্যমে পবিত্র করে রাখা হয়। পরে ভক্তরা এসে আবার সেই পানি বোতলে সংগ্রহ করে নিয়ে যান। তবে বদনাগুলো মাজারে দান করে যেতে হয়। মাজারের ভেতরে খতমে কোরান, খতমে খাজেগান, খতমে বুখারির মাধ্যমে পবিত্র পানি সংরক্ষণ করে রাখা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এসেও অনেক ভক্ত সেই পানি পান করেন।
মাজারের খাদেমের আসনের পাশে বেশ কিছু বদনা দেখা যায়। পাশাপাশি ছোট টেবিলের ওপর পিতলের বদনায় রয়েছে সংরক্ষিত পবিত্র পানি। সেখান থেকে ভক্তদের পান করার জন্য ছোট ছোট পিতলের গ্লাসে পানি ঢেলে রাখা হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে বংশ পরম্পরায় বদনা শাহ (র.) এর ৫ম প্রজন্ম এর দেখাশোনা করছেন। তাঁর দুই ছেলে ছিলেন সৈয়দ ইসমাইল আহমেদ ও সৈয়দ মকবুল আহমেদ। সৈয়দ মকবুল আহমেদের ৫ ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। বংশ লতিকায় ৫ম প্রজন্মের মধ্যে রয়েছেন তাদের সন্তান, নাতি, পুতি (প্রপৌত্র)। এঁদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে রয়েছেন দুই ভাই, হাজি সৈয়দ মনসুর আহমেদ ও হাজি সৈয়দ অলি আহমেদ। হাজি সৈয়দ মনসুর আহমেদ প্রধান মোতোয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন। দুই ভাইয়ের বংশধর সৈয়দ মনির আহমেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ নওশাদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ইমরান, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, সৈয়দ মোহাম্মদ আসাদ সর্দার মাজারের সার্বিক দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন। তারা সবাই মিলে পারিবারিকভাবে মাজার উন্নয়নের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান সৈয়দ মনির আহমেদ।
মাজারের দেয়ালে লেখা রয়েছে, মাজারে সেজদা করা নিষেধ। এক গম্বুজ বিশিষ্ট মাজারের মূল ভবনটি অক্ষত রাখা হয়েছে বলে জানান বংশধর সৈয়দ মনির আহমেদ। শুধুমাত্র মাজারের পাশে ১২ ফুট গুণিতক ১২ ফুট আয়তনের ছোট মসজিদটি ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে মাজারে আগত মহিলাদের বসার ও ইবাতদের জায়গা।মূল প্রবেশপথটিও নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে মাজার সংলগ্ন তিন তলা একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদের নিচে রয়েছে বদনা শাহ (র.) –এর আওলাদদের কয়েকজনের মাজার। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ ইসমাইল আহমেদ, সৈয়দ মকবুল আহমেদ, সৈয়দ মোহাম্মদ ইউসুফ, আছিয়া খাতুন, সৈয়দ মো নাসির ও সৈয়দ আবুল হাশেম প্রমুখ। এছাড়া মসজিদের পেছনে সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই রয়েছে বদনা শাহ (র.) –এর বংশধরদের পারিবারিক কবরস্থান। মাজার এলাকার মোট ১৬ গ–া জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে এসব স্থাপনা।
সৈয়দ মনির আহমেদ জানান, প্রতি শুক্রবারে জুমার দিনে বদনা শাহ (র.) মাজার সংলগ্ন মসজিদটিতে প্রায় ৫ হাজার মুসল্লির সমাগম ঘটে। এছাড়া প্রতিদিন মাজারে আসেন ১০০ থেকে ২০০ মানুষ। মাজারের ভেতরে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য একটি করে মোট দুটি পৃথক বাথরুম রয়েছে। ওযুখানা রয়েছে ৪টি। এর মধ্যে পুরুষদের জন্য ৩টি এবং মহিলাদের জন্য ১টি।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার পুরো দিন ও রাত এবং প্রতিদিন ভোর ৩টা থেকে রাত ১২–১টা পর্যন্ত মাজার খোলা রাখা হয়।
এবি/টিআর