নিজস্ব প্রতিবেদক 

সংস্কারকাজ শেষে প্রায় ১৫ মাস পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু। গতকাল রোববার সকাল ১০টা থেকে সেতু দিয়ে চলাচল শুরু করেছে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। তবে ৮ ফুট উচ্চতার বেশি গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না।

সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে কর্ণফুলী নদীর দুই পারের বাসিন্দাদের। সংস্কারকাজের জন্য গত বছরের ১ আগস্ট সেতু দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। পুরোনো সেতুর সংস্কারকাজ শেষ হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা খুশি। তাঁদের এখন দাবি, নতুন সেতুর নির্মাণকাজ যেন দ্রুত শুরু করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা হয়।

গতকাল সকালে সরেজমিন দেখা যায়, সেতু দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, মাইক্রোবাস, কার, মোটরসাইকেল চলাচল করছে। সেতুর এক পাশে হেঁটে চলাচলের জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। সেটি দিয়ে অনেক পথচারী সেতু পার হন।

সেতু দিয়ে পার হয়ে বোয়ালখালী প্রান্ত থেকে কালুরঘাটের নগর প্রান্তে আসেন উবারচালক মোহাম্মদ ইছহাক। বোয়ালখালীর পশ্চিম চরণদ্বীপ এলাকার এই বাসিন্দা বলেন, সেতু দিয়ে চলাচল বন্ধ থাকায় অনেক দুর্ভোগ ছিল। ফেরি থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তা দিয়ে পারাপার হওয়া যেত না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কুয়াশা থাকলে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকত। তখন অনেক পথ ঘুরে নগরে আসতে হতো। এখন সেতু চালু হয়েছে। যাতায়াতের কষ্ট অনেক কমে যাবে।

আবু বকর নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, পুরোনো সেতু সংস্কারে ১৫ মাস পার করে দেওয়া হয়েছে। নতুন সেতু নির্মাণে কত সময় লাগে, কে জানে। তবে দাবি থাকবে, যত দ্রুত সম্ভব নতুন সেতুটি যেন নির্মাণ করা হয়। তখন দুই পারের মানুষের আর কোনো কষ্ট থাকবে না।

গত বছরের ১ আগস্ট কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত ৯৩ বছরের পুরোনো কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ শুরু করে রেলওয়ে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে ৪৩ কোটি টাকার সংস্কারকাজের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

আর্থিক সংকট, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক কারণে সংস্কারকাজ বিলম্ব হয় বলে দাবি করে রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করে রেলওয়ে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ৯৩ বছরের পুরোনো এই সেতুর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সংস্কারকাজ শুরুর তিন মাসের মধ্যে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়। গত বছরের নভেম্বরে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়। আর গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে এই লাইনে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে।

কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ার একটি অংশের মানুষ চট্টগ্রাম নগরে আসা-যাওয়া করে থাকেন। বন্ধ হওয়ার আগে এই সেতু দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, ছোট পিকআপ, ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), মাইক্রোবাস চলাচল করত। এখন ফেরি দিয়ে পারাপার হন মানুষ। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ নদী পার হন।

সেতুর সংস্কারকাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কারকাজ শেষে কালুরঘাট সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। ফলে দুই পারের মানুষ অনেক খুশি। তাঁরা এখন থেকে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবেন।

এদিকে গত বছরের ১ আগস্ট সংস্কারকাজ শুরুর পর সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সেতুর পাশে ফেরি চালু করা হয়। সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত্বাবধানে দুটি ফেরি চলাচল করছে। টোলের মাধ্যমে এসব ফেরি দিয়ে গাড়ি পার হয়।

একমুখী সেতু হওয়ায় ট্রেন এলে সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। ট্রেন না চললে তখন সেতু দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। তবে একমুখী সেতু হওয়ায় এক প্রান্ত থেকে গাড়ি এলে অন্য প্রান্তের গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। এ কারণে দুই পাশেই যানজট তৈরি হয়। ট্রেন চলাচল এবং এভাবে গাড়ি বন্ধ রাখায় সেতু পার হতে দুই পারের মানুষদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তবে এবার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর এক পাশে পায়ে হেঁটে পারাপারের জন্য ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই গাড়ির জন্য অপেক্ষায় না থেকে ওয়াকওয়ে দিয়ে সেতু পার হয়ে যান।

আজ রবিবার (২৭ অক্টোবর) সকাল ১০টা থেকে সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। এর মাধ্যমে দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মানুষের প্রতিদিনের দুর্ভোগের অবসান হল।

কালুরঘাট সেতু দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়ার মানুষ চট্টগ্রাম শহরে আসা-যাওয়া করেন। যান চলাচল শুরু করার সময় উপস্থিত ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়াসহ পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা।

জানা যায়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিমের পরামর্শ মতে জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু মেরামতের জন্য গত বছরের ১ আগস্ট থেকে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়। প্রায় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারকৃত সেতুতে নতুন করে নির্মাণ করা হয় ওয়াকওয়ে। সেতুতে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াকওয়ে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিয়া বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে কালুরঘাট সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে সেতুতে যান পারাপারে কোনো টোল রাখা হয়নি। সেতু দিয়ে সর্বোচ্চ ৮ ফুট উচ্চতার সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। কিন্তু ট্রাক-বাসের মত ভারী যান চলবেনা।

জানা যায়, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর ১৯৩১ সালে প্রায় ৭০০ মিটার দৈর্ঘ্যের স্টিলের কাঠামোর কালুরঘাট রেলসেতু নির্মিত হয়। ১৯৬২ সালে যান  চলাচল শুরু হয়। এর আগে দুই বার সংস্কার করা হয়েছিল। কালুরঘাট রেলসেতুর বয়স এখন ৯৩ বছর। গত বছর সেতু দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম রুটের রেল চলাচলে বড় আকারের সংস্কার করা হয়। এরপর গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে এ রুট দিয়ে তিন জোড়া রেল এবং দোহাজারী পাওয়ার প্ল্যান্টের জ্বালানিবাহী ট্রেন চলাচল করে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here