ইকবাল হায়দার
রোজা শব্দের অর্থ হচ্ছে “দিন” আর আরবীতে নাম সাওমা বা সিয়ামা যার অর্থ কোন কাজ থেকে বিরত থাকা। রোযা বা রোজা, (ফার্সি রুজে) সাওম (আরবী সাউম) বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ বিলাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। অন্যভাবে অধ্যাপক মো: মতিউর রহমান রোজা ও ঈদের তাৎপর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার এক লেখায় বলেছেন, আরবী “রমজ” শব্দ থেকে রোজা শব্দের উৎপত্তি। “রমজ” অর্থ পোড়ানো বা জ্বালানো। আগুনে পুড়িয়ে কোনো ধাতেুকে যেমন নিখাদ করা হয়, রোজাও তেমনি। রোজা মানুষের অসৎ প্রবৃত্তিকে নাশ করে সুপ্রবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। প্রত্যেক মানুষের স্বভাবে দুটি বিপরীতমুখী প্রবনতা রয়েছে, একটি সৎ, অন্যটি অসৎ। রোজা অসৎ প্রবৃত্তি পুড়িয়ে মানুষের মধ্যে সৎ প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে, মানুষকে সত্যিকারে নিখাদ মানুষে পরিনত করে। ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক নেয়ামত।
রমজানের রোজা মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ প্রাপ্তি। এ রোজা মুসলিম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংযম, আত্মশোধনের ক্ষেত্রে এক বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। মানুষ রোজার শেষে নিষ্পাপ, নির্দোষ, নির্ভেজাল স্বচ্ছ জীবন লাভ করে থাকে ঈদুল ফিতর উদযাপনের মদ্য দিয়ে। সারা বছরে তার দেহে ও প্রাণে জমে ওঠে নানা রোগ, শোক, কুস্বভাব, কুপ্রবৃত্তি, কুদৃষ্টি ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ ও সংযম সাধনের মাধ্যমেই রোজা ও ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য নিহিত। প্রকৃত প্রস্তাবে সুষ্ঠুও ধর্মীয়ভাবে সিয়াম সাধনের মাধমেই মুসলিম নর নারী লাভ করে প্রকৃত সাফল্য। এ সাফল্যর নিদর্শন হলো ঈদ উদযাপন। ঈদ হলো গরিব, দু:খী, অসহায়ও নি:স্বজনের মাধ্যে যার যা সামর্থ্য আছে তা দেদার বিলিয়ে একাত্মতা তথা এক কাতারে দাঁড়ানোর আনন্দ ও মহামিলন।
ঈদ মুসলমানদের প্রতীক্ষিত এক মহা আনন্দ উৎসব। এই উৎসব এখন বাংলাদেশের প্রধানতম সাংস্কৃতিক প্রথা। ঈদ বাঙালি মুসলমানদের বড় উৎসব। প্রায় সহস্র বছরের পথপরিক্রমায় মুসলমাান সংখ্যা গরিষ্ঠাতার কারণে এদেশে ঈদ এখন বহু মাত্রিক সামাজিক সাংস্কৃতিক উপাচার। বর্নিল আয়োজন নান্দনিক বোধের জীবনঘনিষ্ঠ এক মানবিক আচার অনুষ্ঠান। আর এভাবে বাঙালির ঈদ উৎসবের জায়গা করে নিয়েছে শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতের নান্দনিকতায়ও।
সাহিত্যতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদরা বলেন বিশ শতকের গোড়ার দিকের বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ঈদ সংখ্যায় সৈয়দ এমদাদ আলী তারই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নবনূর পত্রিকায় ঈদ বিষয়ক প্রথম “ঈদ” কবিতাটি প্রকাশ করেন। এই কবিতার দুটি স্তবক উদ্ধৃত করছি।
কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে / তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে / আজ কি হর্ষ ভরে।
আজি প্রভাতের মৃদুল বায় / রঙে নাচিয়ে যেন কয়ে যায়
‘মুসলিম জাহান আজি একতায় / দেখ কত বল ধরে?’
ইহাই মুসলিম বাংলার প্রথম ঈদ কবিতা। ১৯৩০ সালে প্রথম প্রকাশিত সৈয়দ এমদাদ আলী–সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকাই খুব সম্ভবত প্রথমবার ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে । ১৯০৩, ১৯০৪, ১৯০৫– পর পর এই তিন বছরই ‘নবনূর’ ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে, ‘এই অর্থে অন্তত যে প্রত্যেক বছরই এই পত্রিকায় ঈদ সংক্রান্ত লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ‘নবনূর’ পত্রিকায় প্রধান সাহিত্যিক আবিস্কার ও ফসল সৈয়দ এমদাদ আলী নিজে এবং কায়কোবাদ (১৮৫৭–১৯৫১) ও মিসেস আর. এস. হোসেন অর্থাৎ বেগম রোকেয়া (১৮৮০–১৯৩২)। এই তিনজন লেখকই ‘নবনূরে’ ঈদ–সংক্রান্ত কবিতা বা গদ্য লিখেছেন। ‘নবনূর’ এর পৌষ ১৩১১ সংখ্যায় কায়কোবাদ লেখেন ‘ঈদ’ শীর্ষক কবিতা।
ঈদ নিয়ে লিখেননি এমন কোন মুসলিম কবি সাহিত্যিক বা লেখক মিলবে না। ঈদ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে লেখালেখি হয়েছে বিপুল পরিমাণ। তাঁদের মধ্যে কাব্যে কবি সৈয়দ এমদাদ আলী সহ কবি কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলল করিম, শাহাদাৎ হোসেন, ড. মো: শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, কবি মঈন উদ্দিন, তালিম হোসেন, আ ন ম বজলুর রশিদ, সৈয়দ আলী হাসান, কবি তোফাজ্জল হোসেন, কাজী আবদুল অদুদ, মো: ওয়াজেদ আলী, আশরাফ আলী খান এবং সঙ্গীতে কাজী নজরুল ইসলাম, মতিউর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, সানাউল হক, আজিজুর রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, মনমোহন বর্মন ও কবি শামসুর রাহমান অন্যতম।
‘ঈদ আবাহন’ এই একই নামে কায়কোবাদ দুটি কবিতা লিখেছিলেন, একটি তাঁর অশ্রুমালা (১৩১১) গ্রন্থর্ভূত, অন্যটি তাঁর অমিয়ধারা (১৩২৯) গ্রন্থর্ভূত। দুটি কবিতাতেই ঈদ উপলক্ষে কায়কোবাদ কামনা করেছেন মুসলমানের জাগৃতি–
১. আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মন প্রাণ,
জাগায় মোস্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান।
ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিস্মান রবি,
জীবন সার্থক হবে, ধন্য হইবে এ দরিদ্র কবি । [ঈদ আবহন, অশ্রুমালা]
২. আজি এ ঈদের দিনে
এ পবিত্র শুভক্ষণে, এস ভাই এক সনে হৃদয় বাঁধিয়া।
রক্ষিতে ইসলাম ধর্ম সাধিতে আপন কর্ম।
মানবজাতির তথা মুসলমানদের মহামিলনের উৎসব ঈদকে নিয়ে কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’ নামে আর একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতাটি এ রকম–
‘এই ঈদ বিধাতার কি যে শুভ উদ্দেশ্য মহান, হয় সিদ্ধ বুঝে না তার স্বার্থপর মানব সন্তান।
এত নহে শুধু তবে আনন্দ উৎসব ধলাখেলা, এ শুধু জাতীয় পূণ্যমিলনের এক মহামেলা।
মোজাম্মেল হক (শান্তিপুর, ১৮৬০–১৯৩৩) ‘ঈদ’ (মোসলেম ভারত, ‘জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭) কবিতায় লিখেছেন–
মুসলেমের আজ ঈদ শুভময়, আজ মিলনের দিন, গলায় গলায় মাখামাখি, আমির ফকির হীন
আজ সবারি হস্ত পুত, ধোওয়া স্বর্গ নীরে? তাই যে চুমোর ভিড় লেগেছে, নম্র নত শিরে।
শেখ ফজলুল করিম (১৮৮২–১৯৩৬) ‘ঈদ’ কবিতায় লিখেছেন–
অলস অধম মোরা এখনো কি অবহেলে যাব রসাতলে?
অদৃষ্টের উপহাস এখনো কি আনিবে না চেতনা ফিরিয়া?
এখনো লাঞ্ছিত মোরা বুঝিব না হিতাহিত রহিব ঘুমিয়া?
জীবন–প্রভাত আজি বিস্ময়ে দেখিতে চাহি মহাজাগরণ
সাহসে বাঁধিয়া বাকি পথে হয়ে অগ্রসর
নতুবা মরণ!! [‘বাসনা’ আশ্বিন ১৩১৫]
কবি শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩–১৯৫৩) ও গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭–১৯৬৪) ও ঈদ বিষয়ক কবিতা লিখেছেন। শাহাদাৎ হোসেনের কবিতার বিষয়ে ও প্রকাশে তাঁর স্বভাবশোভন ধ্রুপদী বিন্যাস। ‘ঈদুল ফিতর’ কবিতায়–
কোথা মক্কা–মোয়াজ্জেম মদিনা কোথায় প্রাণকেন্দ্র এ মহাসাম্যের
কোথা আমি ভারতের প্রান্ততটে ক্ষুদ্র ঈদগাহে, সিন্দু–মুরু–গিরি–দরী–কান্তার–তটিনী
রচিয়াছে ব্যবধান দুর্জয় বিপুল, তবু শুনি বায়ুস্তরে তরঙ্গদোলায়
ভেসে আসে সে উদাত্ত মন্দ্রিত নির্ঘোষ, সাম্যের দিশারী আমি –আমি মুসলমান
দেশ–কাল–পাত্র মোর সর্ব একাকার বহুত্বে একক আমি
আত্মর আত্মীয় মোর দুনিয়া–জাহান।
কবি গোলাম মোস্তফার চোখে ঈদের চাঁদটা কেমন ? তিনি লিখেছেন–
‘আজ নূতন ঈদের চাঁদ উঠেছে, নীল আকাশের গায়।
তোরা দেখবি কারা ভাই–বোনেরা আয়রে ছুটে আয়।
আহা কতই মধুর খুবসুরাৎ ঐ ঈদের চাঁদের মুখ
ও ভাই তারও চেয়ে মধুর যে ওর স্নিগ্ধ হাসিটুকু
যেন নবীর মুখের হাসি দেখি ওই হাসির আভায়।
কবি শাহাদাৎ হোসেন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে তিনটি কবিতা লিখেছেন। তার ‘শাওয়ালের চাঁদ’ কবিতায় লিখেছেন–
তোমার আগমে আজি বরিহৃ অশান্তির, নিভে যাক, হাহাকার মহা–মহিমার
বিশ্ব নিখিলের, ডুবে যাক প্রশান্তির, গভীর অতলে, রূপ–রস গন্ধভারে
দগ্ধসৃষ্টি হোক পূর্ণ ঋতুপর্ণা রূপা।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অজস্র গদ্যের পাশাপাশি আবার ‘রমজানের চাঁদ’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন–
পুনরাজ রমযানের এই অগ্রচর, বসন্ত ঋতুর যথা দূত পিকবর
অথবা এ বিধাতার শরীরিনী বাণী, রোজাব্রত পালিবার যাকিছে সবায়
কিংবা পাঠায়েছে এযে পূর্বে ঈদরাণী, যেমনি পাঠায় ঊষা শুত্রু তারকায়।
চল্লিশ দশকের কবি ফররুখ আহমদের উচ্চারণে ঈদ এসেছে এইভাবে–
আকাশে বাঁক ঘুরে চাঁদ এল ছবির মতন
নতুন কিস্তি বুঝি এল ঘরে অজানা সাগর
নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর
আজ এ স্বপ্নের মধ্যে রাঙা মেঘ হল ঘনবন।
এটা আজ দিবালোকের মতো সত্য যে কাজী নজরুল ইসলামই (১৮৯৯–১৯৭৬) ইসলামী বিষয়বস্তুর অসাধারণ সাহিত্যিক রূপদান করেছিলেন। ঈদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা ও গান লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ঈদুল ফিতর নিয়ে নজরুল অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। তার মধ্যে কবিতা হচ্ছে নিন্মরূপ–
কবিতা
১. কৃষকের ঈদ। সাপ্তাহিক ‘কৃষক’ ঈদ সংখ্যা ১৯৪১, ২. ঈদ মোবারক। রচনা: কলিকাতা, ১৯ চৈত্র ১৩৩৩। হিঞ্জির।
৩. জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ, ৪. ঈদের চাঁদ ৫. সর্বহারা।
গান
১. ওরে ও নতুন ঈদের চাঁদ, ২. ও মন রমজানের রোজার শেষে এলো খুশির দিন, ৩. এলো আবার ঈদ ফিরে
৪. ঈদুল ফিতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ, ৫. ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ৬. আজি ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ এলো ঈদ
৭. আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, ৮. নতুন চাঁদের তাকবীর।
কার না মনে পড়ে কাজী নজরুলের এই ভূবন কাঁপানো সুরের দোলা–
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশির দিন
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানী তাগিদ।
এ গানটি ছাড়া ঈদের আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। এছাড়া ঈদ মোবারক ও কৃষকের ঈদ ও ঈদের চাঁদ কবি নজরুলের বহুল আলোচিত কবিতা। ঈদ মোবারক কবিতায় কবি লিখেছেন–
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো
কত বালুচরে কত আখি–ধারা ঝরায়ে গো
বরষের পরে আনিলে ঈদ।
এ কবিতায় নজরুল দেখেছেন অসংখ্য মরুভুিম, বালুচর আর অনাবিল আঁখিজল পেরিয়ে এসেছে ঈদ। তিনি বলতে চেয়েছেন মানুষের মানুষে ভেদাভেদ ভূলে সুখ দুঃখের সমভাগী হয়ে অধিকার ভোগ আর দায়িত্ব পালনের মধ্যে যে প্রকৃত আনন্দ, সে শিক্ষা যেন রয়েঝে ঈদের মাহাত্ম্যে।
ঈদের মহান শিক্ষাই হচ্ছে সব ভেদাভেদ–হিংসা–বিদ্বেষ ভূলে এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে ঈদের জামায়াতের ভ্রাতৃত্বও সহমর্মিতার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ঈদ সচরাচর দেখা যায় না। এ দিনও দেখা যায় গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা শীর্ণ গরুর পাল নিরয়ে মাঠে যায় জমিতে লাঙ্গল দিতে। এদিকে ইঙ্গিত করে তিনি রচনা করেছেন তারা কৃষকের ঈদ কবিতাটি। কবির ভাষায়–
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনা নিদ
মুমুর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু–পুঁজরের হাড়
কবি নজরুলের কবিতা ও গান ঈদের তাৎপর্য, এদিনের করণীয় ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
নজরুল ইসলামের সমকালে ও পরবর্তীকালে ঈদ বিষয়ক কবিতা ও গদ্যের ধারা অব্যাহত থাকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বেগম রোকয়া, সৈয়দ এমদাদ আলী, কাজী এমদাদুল হক (১৮৮২–১৯২৬), এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮৭–১৯৪০), ডা. লুৎফর রহমান (১৮৮৯–১৯৩৫), ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫–১৯৬৯) প্রমুখ যে চিন্তার চর্চা শুরু করেন, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে তা কিশেষভাবে ফলবান হয়ে ওঠে কয়েকজন ভাবুকের রচনায়। এদের শ্রেষ্ঠ দুজন হচ্ছে কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪–১৯৭০) ও মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৮৯৬–১৯৫৪)। এদের দুজনের বহুমাত্রিক ভাবনার মধ্যে ঈদ–প্রসঙ্গও এসেছে। কাজী আবদুল ওদুদের যে বিশিষ্টতা প্রমুক্তচিত্ততা, তার প্রকাশ এখানেই আছে। তার ঈদুল ফিতর প্রবন্ধের উপসয়হার এরকম। সর্বপ্রকারের জড়তা থেকে মুক্ত হয়ে মানব যোগ্যভাবে ধর্ম পালন করুক, পালন করে সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষ লাভ করুক, ঈদুল–ফিতরের পূণ্য দিনে এই প্রার্থনা করি।
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ঈদের লেখা নামক নকশায় একজন লেখক পরোক্ষভাবে নিজেরই সামাজিক অবস্থান বর্ণনা করেছেন। ঈদ–উল–ফিতর (সাম্যবাদী, বৈশাখ ১৩৩১) প্রবন্ধে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী তার স্বভাবসুলভ ঈদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। আমাদের তিরিশের কবিদের কেউ কেউ ঈদের কবিতা লিখেছেন। বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১)। অনেকদিন ধরে বছর–বছর ঈদের কবিতা লিখে গেছেন। কবি মঈনুদ্দীন (১৯০২–৮১) সাম্যবাদী পত্রিকায় (বৈশাখ ১৩৩২) ঈদ কবিতাটি তো এক সময় যথেষ্ট বিখ্যাত হয়েছিলো। আশরাফ আলী খান চিরকালই ছিলেন নির্যাতিতদের পক্ষে, ঈদ কবিতাতেও তার পরিচয় পাওয়া যায়। শেষ স্তবকটি উদ্ধার করছি–
সাঁঝের আকাশে দেখা দেয় চাঁদ, ঘরে ঘরে ধুম
সারা রাত ধরি চলে উৎসব, কারো চোখে নাই ঘুম।
মওলভী ক’ন, ‘আল্লার শান
ঈদে হয় তাজা সকালের প্রাণ।
প্রজা কেদে
কয় ঈদের জুলুমে মরিল গরীব মজলুম।
ঈদ একেবারে ব্যর্থ হইল আল্লাহ ভাবেন হয়ে গুম।
শাওয়ালের রূপালী চাঁদ পশ্চিমাকাশে মুচকি হেসে জানিয়ে দেয় যে, ঈদ এসেছে। দীর্ঘ প্রতিক্ষীত এ দিন নিয়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল তার ঈদের চাঁদ কবিতায় লিখেছেন–
চাঁদ উঠিয়াছে, ঈদের চাঁদ কি উঠেছে শুধায় সবে
লাখো জনতার আঁখি থির আজি সুদূর সুনীল নভে।
এই ওঠে, ওই উদিল গগনে
সুন্দর শিশু চাঁদ–
আমিন। আমিন। রাব্বুল আলামিন
করে সবে মোনাজাত।
আগেই বলেছি ঈদের নতুন চাঁদ সবার জন্য আনন্দ বয়ে আনে না । এদিন গবীর–দু:খী ও অসহায়দের মনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে কবি তালিম হোসেনের ঈদের ফরিয়াদ কবিতায়। কবির ভাষায়–
ঈদ মোবারক, সালাম বন্ধু, আজি এই খোশরোজে
দাওয়াত কবুল কর মানুষের বেদনার মহাভোজে।
কহিব কি আর চির–মানুষের ওগো বেদনার সাথী,
ঈদের এদিন শেষ হয়ে আাসে, সমুখে ঘনায় রাতি।
কবি সিকান্দার আবু জাফর প্রায় একই বিষয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। ঈদ উপলক্ষে দোয়া চেয়ে পিতার কাছে লেখা ঈদের চিঠিতে তিনি লিখেছেন–
ঈদের সালাম নিও, দোয়া করো আগামী বছর
কাটিয়ে উঠতে পারি যেন এই তিক্ত বছরের
সমস্ত ব্যর্থতা।
অন্তত: ঈদের দিন সাদাসিধে লুঙ্গি একখানি
একটি পাঞ্জাবী আর সাদা গোলটুপি
তোমাকে পাঠাতে যেন পারি
আর দিতে পারি পাঁচটি নগদ টাকা।
অন্যদিকে সৈয়দ আলী আহসান ঈদের চাঁদের হাসিতে দেখতে পেয়েছেন নতুন দিনের বারতা। লিখেছেন–
এসেছে নূতন দিন
আলো শতদল পাপড়ি মেলেছে, কুয়াশা হয়েছে ক্ষীণ
জরির জোব্বা, শেরোয়ানী আর আমামার সজ্জায়
আতরের পানি, মেশেকের রেণু খোশবু বিলায়ে যায়–
বাতাসে বাতাসে কলরোল আজি, ভেঙেছে তন্দ্রা ঘোর
সাহেবজাদীর নেকাব টুটেছে, রাত্রি হয়েছে ভোর।
সমাজে ঈদের খুশির প্রভাব সম্পর্কে কবি আ.ন.ম. বজলুর রশিদ তার ঈদ কবিতায় লিখেছেন–
ঈদ আসে হাসি–খুশি তোমাদের আমাদের সকলের ঘরে
অনেক আনন্দ নিয়ে কিছুক্ষণ ভুলে যাই
দু:খ জ্বালা যত বাংলা লেখা ভুল দেখাচ্ছে?
আজ শুধু মেলামেশা অন্তরঙ্গ
হয়ে থাকা অবিরত
আল্লাহর প্রশংসায় গান, তার দয়া দাক্ষিণ্যের অমৃত ঝরে।
কবি তোফাজ্জল হোসেন খান ঈদ নিয়ে চমৎকার একটি গান লিখেছেন। প্রতি বছর ঈদ এলেই শিশুরা সমবেত কণ্ঠে গয়ে ওঠে এ গানটি–
আজ আনন্দ প্রতি প্রাণে প্রাণে, দুলছে খুশীর নদী প্লাবনে,
ঘরে ঘরে জনে জনে, আজি মুখর হব মোরা গানে গানে
ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক আজ, বল ঈদ মোবারক আজ।
অধিকাংশ কবি –সাহিত্যিক ঈদের দিনকে খুশীর দিন হিসেবে চিত্রিত করলেও কবি মতিউর রহমান মল্লিক তার গানে লিখেছেন–
ঈদের খুশী অপূর্ণ রয়ে যাবে ততদিনে
খোদার হুকুমাত হবে না কায়েম
কায়েম হবে না যতদিন।
কবির এ গানের কথাগুলো যৌক্তিক। কারণ দুনিয়ার খোদার হুকুমাত কায়েমের মাধ্যমেই ধনী–দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা সম্ভব। আর এ বৈষম্য দূর হলেই ঈদ সত্যিকার আনন্দের দিন তা সবার হৃদয়ে বুলিয়ে দেবে প্রেম প্রীতি আর শান্তির পরশ।
শামসুর রাহমান তার একটি কবিতায় শৈশবের ঈদের আনন্দের বর্ণনা দিয়েছেন। শহীদ কাদরীর কবিতায় সুনীল ঈদগা দেখা দেয় প্রতীকের মতো। এমনিভাবে ঈদের আনন্দ–বেদনা মূর্ত হয়েছে সৈয়দ এমদাদ আলী থেকে শহীদ কাদরী বা তার পরবর্তীদের রচনায়।
কয়েকশ বছর ধরে বাঙালি–মুসলমান ঈদ উদযাপন করলেও মাত্র এই শতাব্দীর শুরু থেকে ঈদ সম্পৃক্ত সত্যিকার সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের ঈদ তথা ধর্মীয় উপাচারগুলিকে অসাধারণ সৌন্দর্য ও তাৎপর্যমন্ডিত করে এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছিলেন।
যুগের পর যুগ রচিত হয়ে চলেছে ঈদের উপর কবিতা ও গান। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো ঈদকে কোনো কবিই খুশি ও আনন্দের কেবল ঝর্ণাধারা হিসাবে চিহ্নিত করেননি, বরং তাদের দৃষ্টি ও মননের সীমায় আছে সৌভ্রাতৃত্ববোধ, মানবতা, ঐক্য, সাম্য আরা মহামিলনের এক বৈশ্বিক বোধ। মূলত এটাই তাদের কবিতার কেন্দ্রীয় চারিত্র্য। রমজানুল মুবারক ও ঈদ বিষয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও আল্লাহর রাসূল (সা.) যে ধরনের শিক্ষা গ্রহণের কথা বলেছেন ঈদবিষয়ক কবিতা ও গানে আমরা তারই প্রতিধ্বনি লক্ষ্য করি। সন্দেহ নেই , ঈদ মুসলিম মিল্লাতের জন্য একটি সার্বজনীন আনন্দ উৎসব। কিন্তু সেই সাথে আবার স্বাতন্ত্র্যিকও বটে। কারণ ঈদের এই সাম্যের শিক্ষা ও বৈশিষ্ট্য একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মে লক্ষ্য করা যায়না। বাংলা কবিতা ও গানে ঈদের এই সার্বভৌম উদার শিক্ষা ধারণ করেই বয়ে চলেছে খরস্রোত নদীর মত। বাংলা সাহিত্য এটাও একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ঐশ্বর্যিক দিক বটে।
সবশেষে এই লেখকের অবতারণাঃ
ঈদ এলো আজ ঘরে ঘরে, তিরিশ রোজা পূর্ণ করে
আনন্দেরই ঝর্ণাধারা উপছে যেন পড়ে।
বেহেস্তি সুখ সুধায় পূর্র্ণ, অহমিকা রাগ করি চূর্ণ
আনন্দ মিলনে প্রেমে, আকাশে বাতাসে ঝরে।
আজ যত কষ্ট বিশাদ, আজ যত ক্ষোভ ব্যাথা বাঁধ
আজ বুকে মিলাবো বুক, প্রেম জাগ্রত করে।
আজ রোযাদারের মুখে মুখে, কি আনন্দ মহাসুখে
স্বর্গ যেন আসল নেমে, বাহিরে অন্দরে।
একাকীত্বের পদ্য / বিজন মজুমদার
ক. গ্রহ নেই গ্রহেতে
আমি আছি শূন্যে,
তুমিহীনা এই রাত
কাটি কোন পূণ্যে!
খ. রাত জাগা দু’টি চোখ
থেমে থেমে রয়,
কোথা সুখ কোথা সুখ
খুঁজি আশ্রয়।
গ. চারিদিকে শূন্য
ধূপছায়া শূন্যে
তুমি আছো থাকবে
বাহারী কি পণ্যে!
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগীতশিল্পী
এবি/টিআর ৪/৬/২০১৯