শেফালী ঘোষ (জানুয়ারি ১১, ১৯৪১ – ডিসেম্বর ৩১, ২০০৬)
মো. তাজুল ইসলাম রাজু
মো. তাজুল ইসলাম রাজু

মো. তাজুল ইসলাম রাজু
প্রকাশ- ২৮/১২/২০২০

উৎসবে, পার্বণে, মেলায় এখনো শেফালী ঘোষের গান ছাড়া কোনো অনুষ্ঠান জমে না চট্টগ্রামে। শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চলে তরুণ উদীয়মান শিল্পীরা শেফালীর গান গেয়ে দর্শক; শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। ২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তাঁকে হারিয়েছি আমরা। মৃত্যুর পর এক যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু শেফালী ঘোষ এখনো বেঁচে আছেন তরুণ শিল্পীদের সাধনায়, মানুষের প্রাণে প্রাণে।

আঞ্চলিক গানের এই কিংবদন্তি শিল্পী বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরেছেন যা উপমহাদেশের সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রায় পাঁচ দশকের সংগীত জীবনে তিনি প্রায় সহস্রাধিক গান গেয়েছেন। তার গাওয়া গান নিয়ে দুই শতাধিকের বেশি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রায় ২০টিরও বেশি দেশে সঙ্গীত তিনি পরিবেশন করেছেন।

তার গাওয়া বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে এম এন আখতার রচিত এবং সুরারোপিত “যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম”, আহমেদুল হক সিদ্দিকী রচিত ও সুরে “ও রে সাম্পানওয়ালা”, মলয় ঘোষ দস্তিদার রচিত ও সুরে “ছোট ছোট ঢেউ তুলি” প্রভৃতি।

১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে শেফালী ঘোষ শিল্পী হিসেবেই অংশ নেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেন। সঙ্গীতের পাশাপাশি যাত্রা এবং মঞ্চনাটকেও তার নিয়মিত অংশগ্রহণ ছিল।

কানুনগোপাড়ায় শেফালী ঘোেষর পৈত্রিক বাড়ী
কানুনগোপাড়ায় শেফালী ঘোেষর পৈত্রিক বাড়ী

শেফালী ঘোষ ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই তার শৈশব কেটেছে। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তার পিতার নাম কৃষ্ণ গোপাল ঘোষ এবং মাতার নাম আশালতা ঘোষ। শেফালী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন শেষে ভর্তি হন স্থানীয় মুক্তাকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।

বাড়ীর আঙ্গিনায় বাবার সাথে  শেফালী ঘোষ
বাড়ীর আঙ্গিনায় বাবার সাথে শেফালী ঘোষ
মা আশালতা
মা আশালতা

পরিবারের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তার গান গাওয়ার এবং শেখার সূত্রপাত ঘটে। তার গানের প্রথম ওস্তাদ ছিলেন তেজেন সেন। পরবর্তীতে অধ্যক্ষ ওস্তাদ শিবশঙ্কর মিত্র, জগদানন্দ বড়ুয়া, নীরদ বড়ুয়া, মিহির নদী, গোপালকৃষ্ণ চৌধুরীসহ বিভিন্ন সংগীতজ্ঞের কাছে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। শিল্পীজীবনের সূচনালগ্নে প্রথমে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত এবং আধুনিক গান শিখতে শুরু করলেও এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের লোকসঙ্গীত- অর্থাৎ আঞ্চলিক গান, পল্লিগীতি, মাইজভান্ডারী গান, পীর মুর্শিদের শানে রচিত গান গাওয়ার দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

১৯ বছর বয়সে শেফালী ঘোষ গান শেখার জন্য চট্টগ্রাম শহরে আসেন। সেখানে তার পরিচয় ঘটে সংগীতানুরাগী ননী গোপাল দত্তর সঙ্গে। পরবর্তীতে পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের বিয়ে হয়। শেফালী ঘোষের এক ছেলে ছিল, সেও এখন পরপারে। ক্যন্সার আক্রান্ত ছিল সে।

শেফালী ঘোষের কণ্ঠে কর্ণফুলীর দুই তীরের মানুষের আনন্দ;বেদনার গল্প সুর হয়ে উঠেছিল। কেননা, তাঁর গানে সূর্য ওঠার অসাধারণ বর্ণনার সঙ্গে প্রিয় বিরহের বেদনা একাকার যেমন হয়েছে, তেমনি চিরপ্রবহমান জলধারা কর্ণফুলীর কথাও উঠে এসেছে;সূর্য উডের অভাই লাল মারি/ রইস্যা বন্ধু যারগই আমার বুকে সেল মারি; (চারদিকে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে/ এ সময় আমার বুকে সেল মেরে যেন রসিক বন্ধু চলে যাচ্ছে)। ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত, লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী। (জলে ছোট ছোট ঢেউ তুলে, লুসাই পাহাড় থেকে নেমে কর্ণফুলী ধেয়ে যাচ্ছে) শেফালী ঘোষ বেশির ভাগ গান গেয়েছেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। কিন্তু তাঁর সেই গানের সুর ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

জনপ্রিয় জুটি শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব এর সাথে
জনপ্রিয় জুটি শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব এর সাথে

১৯৬৩ সালের কথা। বয়স তখন ২২। শুরুতে নজরুলগীতি ও আধুনিক গান করতেন শেফালী ঘোষ। তখন চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক ছিলেন আশরাফুজ্জামান। তিনি শেফালী ঘোষ আর আঞ্চলিক গানের সম্রাট শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবকে ডেকে পাঠালেন। প্রস্তাব দিলেন আঞ্চলিক ভাষায় গান গাওয়ার। দুজনে রাজি হলেন। ডেকে আনা হলো মলয় ঘোষ দস্তিদারকেও। তিনি এই দুই শিল্পীর জন্য গান বাঁধলেন। এ গানের কথায় মানুষের অন্তরের আকুলতা যেন কর্ণফুলীর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে;নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তাড়াতাড়ি/ তোঁয়ারে ছাড়া খাইল্যা ঘরত থাইক্যুম কেন গরি? (বাপের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছ, ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। তোমাকে ছাড়া একা ঘরে কেমন করে থাকব?)। শেফালী ঘোষ আর শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সেই দ্বৈতকণ্ঠের গান নিয়ে হইচই পড়ে গেল। শেফালী ঘোষকেও আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তাঁকে জনপ্রিয়তার এমন শীর্ষ এক পর্যায়ে নিয়ে গেল যে কোনো পালাগান, অনুষ্ঠান শেফালী ছাড়া জমল না। গ্রামে, গঞ্জে, পাড়ায় ছেলে-বুড়ো;যুবক সবার মুখে শেফালীর গান। তাই তো তাঁর জন্য গান লিখলেন উপমহাদেশ খ্যাত রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালী, এম এন আখতার, কবিয়াল এয়াকুব আলী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মোহাম্মদ নাসির, মোহন লাল দাশরা। তাঁদের লেখা সেসব গান শেফালীর জাদুকরি কণ্ঠে এসে মানুষের হৃদয় কেড়ে নিল, আর তাদের মুখে ফিরতে ফিরতে একধরনের লোকগানের মর্যাদায় অমর হয়ে গেল। মানুষ কি ভুলবে সেই কথাগুলো;আঁধার ঘরত রাত হাডাইয়ুম হারে লই;ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা;পালে কী রং লাগাইলিরে মাঝি;সাম্পানে কি রং লাগাইলি;নাতিন বরই খা বরই খা হাতে লইয়া নুন।

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলে মানুষের হাহাকার। ঝড়ের ধ্বংসযজ্ঞের পর তখনো হতবিহ্বল মানুষ ও প্রকৃতি। ঠিক সেই সময় তিনি গাইলেন এক অসাধারণ গান।
গর্কি, তুয়ান, বইন্যা, খরা, মহামারি, ঘূর্ণিঝড়
ভাসাই মারে, ধ্বংস গড়ে
মাইনস্যে তো আর বই ন রয়
অক্কল হামর ধান্দা চলের,
আবার নতুন সৃষ্টি হর।
(গর্কি, তুফান, বন্যা, খরা, মহামারি আর ঘূর্ণিঝড় এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ধ্বংস করে দেয়। মানুষ তারপরও বসে থাকে না। সব কাজের গতি থেমে নেই। নতুন করে আবার সৃষ্টি হচ্ছে)

সৈয়দ মহিউদ্দিনের লেখা এটি এক আশ্চর্য উদ্দীপক গান। ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে এই সুরেলা প্রেরণা সেদিন শেফালী ঘোষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেই গানেরই একটি কথা …
ভাঙা গাছর নয়া টেইল/ পাতা মেতিল দেহার খেইল/ পঙ্খি আবার উডের ঘুরের, চুপপে প্রেমর কথা হর; (ভাঙা গাছের নতুন শাখায় নতুন পাতা মেলে কী খেলা দেখাচ্ছে। পাখিরা আবার উড়ছে, ঘুরছে। চুপিসারে প্রেমের কথা বলছে)

শুনতে শুনতে গায়ে শিহরণ জেগেছিল। অগুনতি মানুষের কান্নার ভেতর, হাহাকারের ভেতর, বিলাপের ধ্বনির ভেতর এই গান শুনে সেদিন প্রতি রোমকূপে জীবনের পুলক জেগেছিল।

আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো রয়ে যাবে শেফালীর গানে। শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ যে পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন, তা হচ্ছে অগুনতি মানুষের ভালোবাসা। অবশ্য ২০০৬ সালে মৃত্যুর এক বছর পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছিলেন একুশে পদক।

শেফালী ঘোষ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। লাভ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক পদক (১৯৯০), বাংলা একাডেমির আজীবন সম্মাননা (২০০২), শিল্পকলা একাডেমি পদক (২০০৩) ও একুশে পদকে (২০০৮, মরণোত্তর)।

চির বিদায়ের সময়
চির বিদায়ের সময়

এই জনপদের সংস্কৃতি, জীবনাচার এবং মানুষের মনের কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারবার তাঁর গানে। তাই সেসব গান আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কর্ণফুলী যত দিন বয়ে চলবে, তত দিন শেফালী থাকবেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here