কবিয়াল রমেশ শীলের সাথে পল্লী কবি জসিম উদ্দীন ও সাহিত্যিক আবুল ফজল
প্রলয় চৌধুরী মুক্তি
Posted on

বাংলার কবি গানের অমরশিল্পী, রুচিশীল ভিন্ন ধারার কবি গানের প্রবর্তক, বাংলার লোকসংস্কৃতির গীতিকার গণশিল্পী- যার কন্ঠে ছিল, জারিগান, সারিগান, গাজিরগীতি ঢপকীর্তন, পাল্টা কীর্তন, কবিগান, যাত্রাগান, মাইজভান্ডারী গান, পালাগান, বৈঠকিগান ও পল্লীগীতি। যার লেখনী ছিল মাইজ ভান্ডার শরীফ, ভাষাআন্দোলন, গণআন্দোলন, ধর্ম শাস্ত্র, লোকসংস্কৃতি, শ্রমজীবী মানুষ, অসাম্প্রদায়িকতা, সর্বধর্ম সমন্বয়বাদ নিয়ে বিশ্বযুদ্ধ- সহ ১৯০০ সাল থেকে সকল আন্দোলন বিল্পব, দাঙ্গা, জমিদারী, সুফিবাদ উচ্ছেদ ডাক, রাজশাহী জেল হত্যা (১৯৫০) দেশভাগ (১৯৪৭), মাহাত্না গান্ধীর, অসহযোগ আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসনামলের নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ ছিলো সোচ্চার।
মানব ধর্মে বিশ্বাসী এ লোক কবি গেয়েছেন “মিমের পর্দা উঠাইলে দেখবি ওরে মন / রাম রহিম কৃষ্ণ করিম মূলেতে একজন। মানুষের ভিতর নিরঞ্জন, মানুষ বিনে পশুপাখির ঘটে না সাধন, যাবে ভ্রান্তি পাবি শান্তি চেতন মানুষ সঙ্গ ধর”।

২০০২ সালে একুশে পদকে ভূষিত এই কবির জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনাবলী …
১৮৮৮সালে ১১ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ, সুতরাং পড়াশুনার পরিসমাপ্তি। ৬সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ। জীবিকার সন্ধানে আকিয়াব / বার্মায় গমন।
১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামের সদরঘাট জেলে পাড়ায় কবিয়াল মোহন বাশি ও কবিয়াল চিন্তাহরণের কবিগান অনুষ্ঠানে হঠাৎ করে কবিয়াল চিন্তাহরণ অসুস্থ হলে উপস্থিত ২১ বছরের শ্রোতা/দোহার রমেশ চন্দ্র শীল সবার অনুরোধে সু-প্রতিষ্ঠিত কবিয়াল মোহন বাঁশীর বিপরীতে অবতীর্ণ হন। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা প্রতিযোগিতায় তিনি বিপুল বিক্রমে যুক্তি খণ্ডন করে কবিয়াল মোহনবাঁশীকে জর্জরিত করে তুলেন। এটা রমেশের প্রথম এবং বিশাল অর্জন।
১৮৯৮সালে কধুরখীলের প্রবীণ কবিয়াল নবীন চক্রবর্তী (নবীন ঠাকুর) এর সংস্পর্শ ও কবিগানের শিষ্যত্ব গ্রহন। গুরু শিষ্য এর আসরে কবিগান উপস্থাপন করেছেন, গভীর মমত্ব দিয়ে শিষ্যকে নির্মাণ নবীর ঠাকুর : কোন কোন সময় শিষ্যেও কাছে পরাজয় বরণ করেও তিনি গৌরববোধ করতেন। কবিগানে বিশ্ব মানবতার চর্চা, সর্বধর্ম সমন্বয় বাদী দর্শনারোপ,কবিগানকে অশ্লীলতামুক্তকরণে ইত্যাদি গুরুদেবের পথ নির্দেশনা ছিল। ১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির খবরে লিখিত কবিতা, গান রচনা ও পরিবেশন করেন।
১৯০৯-১৩ সালে দেশাত্নবোধক গান, পদ্য রচনায় মনোনিবেশ, ১৯১৪-১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ নিয়ে অসংখ্য কবিতা গান রচনায় মনোনিবেশ, ১৯১৯-২০ খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের উপর কবিতা ও গান রচনা, ১৯২৩ মাইজভান্ডার শরীফে প্রথম গান। হিন্দু সম্প্রদায়ের মোড়ল ও পুরোহিতদের রোষানলের শিকার হন। ১৯২৭ সর্বভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে কবির মানসে দেশপ্রেম ও গণমানুষের দুঃখ বেদনার সুর বেজে উঠে। ১৯৩৭ মাইজভান্ডারশরীফ নিয়মিত যাতায়াত ধ্যানমগ্নতা, ভান্ডারী ও মরমী সংগীত রচনায় মনোনিবেশ। ১৯৩৮সালে ২৮ এপ্রিল কবিকে সভাপতি করে সর্বপ্রথম ‘রমেশ উদ্বোধন কবি সংঘ’ গঠিত হয়। ১৯৪২ সালে কবিয়ালদের নিয়ে কবিগানে নতুন ধারার প্রবর্তন করার জন্য চিন্তাভাবনা। ১৯৪৩ সালে কবিকে সভাপতি করে চট্টগ্রাম জেলা কবি সমিতি পূর্নগঠন ও কমিউনিষ্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ততা। ১৯৪৪ সালে চট্টগ্রাম গান্ধী ময়দানে সর্বপ্রথম মাইকযোগে কবিগান পরিবেশন করেন। ১৯৪৫ সালে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘের উদ্যেগে কলিকাতা মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত বিশাল সন্মেলনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন কবিয়াল দেওয়ান শেখ গোমানীর সাথে কবির গানে রমেশ শীল সেরা কবিয়ালের শিরোপা অর্জন করেন। সংগে ছিলেন ফণী বড়ুয়া, রায় গোপাল দাস ও অন্যান্য। ১৯৪৬ সালে কলিকাতা পার্ক সার্কাস এলাকায় কবি ও রায় গোপাল দাস ‘যুদ্ধ ও শান্তি‘ শীর্ষক কবিগান পরিবেশন। সংগে ছিলেন ফনী বড়ুয়া, ঢুলী বিনয় বাঁশী দাস (একুশে পদক প্রাপ্ত) ও অন্যান্য। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ, পাকিস্তান আন্দোলনের উপর গান ও কবিতা রচনা। ১৯৪৮ সালে কলিকাতাস্থ শ্রদ্ধানন্দ পার্কে অনুষ্ঠিত কবিগানে বিপক্ষে দেওয়ান শেখ গোমানী ও লম্বোদর চক্রবর্তী, তিনি শ্রেষ্ঠ কবিয়াল শিরোপা ও পদক লাভ করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের উপর অসংখ্য গান, কবিতা ও দেশাত্ববোধক গান রচনা ও পরিবেশন। ১৯৫৩-৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “ পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলনে‘ কবিগান পরিবেশন, প্রাদেশিক নির্বাচন যুক্ত ফ্রন্টের পক্ষে অংশ গ্রহণ ও কবিগান। ১৯৫৬ সালে রমেশ শীলের উদ্যোগে চট্টগ্রামে লোকগীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে কবিকে সেরা কবিয়ালের সম্মামনা প্রদান।
তার সঙ্গে গণসংগীত পরিবেশন করেন ২০০১ সালের একুশ পদক প্রাপ্ত কবি বাউল শাহ্‌ আবদুল করিম। ১৯৫৮-৫৯ সালে কবিকে দেওয়া সরকারি ৪০ টাকা ভাতা, পাকিস্তানের সামরিক শাসন বিরোধী কবিতা রচনা করায় তাঁর সাহিত্যিক ভাতা বন্ধ করা হয়। ১৯৬০ জাতীয় কবিতা বিষয়ক দীর্ঘ কবিতা রচনা যাহা বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার সহায়ক ১৭৫৭ সাল হইতে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জী। ১৯৬১ সালে ঢাকায় বুলবুল ললিত কলা একাডেমী আয়োজিত “ লোকসংগীত ও শিল্প উৎসবে“ কবি গান পরিবেশন। বোয়ালখালীর কধুরখীলে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী উৎসবে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছন্দোবন্ধ ভাষণ প্রদান করেন। ১৯৬৪ সালে ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে রমেশ শীল সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, সভাপতি কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল, সদস্য সচিব ছিলেন ড. মোহাম্মদ ইউনুছ। ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল ২৩ চৈত্র ১৩৭৩ বাংলা মহাপ্রায়ণ, ২৪ চৈত্র কবির ইচ্ছানুসারে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
(সংগৃহীত- পারিবারিক সূত্র )
লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here