কবিয়াল রমেশ শীলের একটা গানে আছে:
“যে দেশে নাই চৈত্র মাস, নাইরে সোমবার,
সে দেশে যাই বসত করতে বাসনা আমার।”
একথার পটভূমি হল, হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবাভাণ্ডারী (কঃ) ইন্তেকাল করেন চৈত্র মাসের ২২ তারিখ, সোমবার। নিজের সাধনগুরুর ওফাত প্রাপ্তির বেদনায় আকীর্ণ কবিয়াল স্বীয় মর্মযাতনা বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন ঐভাবে ও ভাষায়। সত্যেই অপূর্ব সহজ, সরল অথচ বিপুল মহিমা মন্ডিত এই আকুতি।
কবিয়াল রমেশ শীল দেহত্যাগ করেন বাংলা ১৩৭৩ সালে সনের ২৩শে চৈত্র। মোতাবেক ১৯৬৭ খৃষ্টাব্দের ৬ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার। জন্ম তাঁর ১২৮৪ বাংলা সনের ২৬শে বৈশাখ, (১৮৭৭ খৃঃ) শুক্রবার, সুবেহ সাদেকের মাহেন্দ্রক্ষণে।
কবিয়াল রমেশ শীলের দেহত্যাদের দিন ক্ষণের সাথে কিছু আধ্যাত্মিক ব্যাপার জড়িত। নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ তিনি আগে থেকেই জানতেন। সমাধিস্থলসহ সব কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন আগে-ভাগে। ১৩৭৩ বাংলা সনের ২২শে চৈত্র। তাঁর একেবারে অন্তিম দশা। কিন্তু তিনি বলেন। আজ বাবাভাণ্ডারী গেছেন। তাঁর পরে। ২৩শে চৈত্র তিনি দেহত্যাগ করেন।
তাঁর দেহত্যাগের ব্যাপারে অনেক আকর্ষণীয় তথ্য পেশ করেছেন শাহ ফকির আর্শ্বাদ তরফদার মাইজভাণ্ডারী। তিনি তাঁর “বিরহ তরঙ্গ ভাণ্ডারী ও ভাণ্ডারে শফি মাওলা’ গীতি কবিতা গ্রন্থে রমেশ শীলের সাথে তাঁর এ ব্যাপারে পত্রালাপের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবন্ধ করেছেন। মুদ্রিত করেছেন কবিয়ালের দু’টি পত্র। এতে দেখা যায় শাহ্ ফকির আর্শ্বাদ তরফদার মাইজভাণ্ডারীর সাথে কবিয়াল রমেশ শীলের গভীর জানা শোনা ছিল। তাদের মধ্যে পত্রালাপ ছিল। তারা দু’জনকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ভাবে চিনতেন। জানতেন। রমেশ শীলের ভাষায়, তারা দু’জন এক তারে বাঁধা।
আর্শ্বাদ তরফদার মাইজভাণ্ডারীর বাড়ি বাগেরহাট জিলার ভোজপতিয়া গ্রামে। ডাকঘর- বড় কাটা খানি। আলোচ্য পুস্তকটার প্রকাশক ফরহাদ তরফদার মাইজভাণ্ডারী ও ফারুক তরফদার মাইজভাণ্ডারী। প্রথম প্রকাশ ১৫ই চৈত্র, ১৩৯৫ বাংলা। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও মুদ্রণ : কাকলি প্রেস, এ আসাহ আহমদ রোড, খুলনা।
কবিয়াল রমেশ শীলের কাব্য প্রতিভা, সাংস্কৃতিক চেতনা। জীবনবোধ্য আধ্যত্মিক বিকাশ সব কিছুই ছিল অত্যন্ত উন্নত স্তরের। কবিয়াল রমেশ শীলের ভক্ত তথা মাইজভা-ারী আশেক ভক্তদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় এসব তথ্য প্রকাশ করা আমরা ঐতিহাসিক কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে মনে করি। নীচে আর্শ্বাদ তরফদার মাইজভা-ারীর ভক্ত পুস্তক থেকে কবিয়াল রমেশ শীলের দু’টো পত্র এবং আর্শ্বাদ তরফদারের নিজের ভাষায় লিপিবদ্ধ বর্ণনাংশ অবিকল পুনঃ মুদ্রিত হলো। ঐ পুস্তক থেকে ফকির আর্শ্বাদ শাহ্ ও মোসাম্মৎ আয়েশা বেগমের আলোকচিত্রও পাঠকের জ্ঞাতার্থে মুদ্রিত হলো। পত্রনংগুলো আমাদের দেওয়া।
–সম্পাদক মাসিক আলোকধারা

এই প্রতিবেদনটি সংগ্রহকালে রমেশ সমাধী প্রাঙ্গনে আলোকধারার সম্পাদক মো. মাহবুুব উল আলম এর সাথে প্রতিনিধি আবদুল হালিম আল মাসুদ, আবুল মুনসুর খান ও রমেশের দুইপুত্র পুলিন বিহারী শীল ও যজ্ঞ্যশ্বর শীল -ছবি মো. তাজুল ইসলাম রাজু ২২-২-৯৮

পত্র নং-১

হযরত বাবা ভাণ্ডারীর মুরীদ কবিয়াল
শ্রী যুক্ত বাবু রমেশ চন্দ্র সরকার
গ্রাম – গোমদন্ডি
পোষ্ট- গোমদন্ডি
জেলা-চট্টগ্রাম।

বন্ধু;
আমার শুভেচ্ছা নিবেন। আশা করি বাবাভাণ্ডারীর কৃপায় স্ত্রী-পুত্র নিয়া সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতেছেন।
বন্ধু;
বাঘে বাচ্ছা ছাড়িয়া তাকাইয়া রহিয়াছে। আপনি বাবাভাণ্ডারীর রহমত হইতে দূরে যাবেন না। বাবাভাণ্ডারী আপনার বাড়ি আমাকে দেখাইয়াছেন। আপনার বাড়ির চর্তুপার্শ্বে ফুলের সমারোহ। অকালে আমের বোল ও মুকুল দেখিয়াছি। বাবাভাণ্ডারী আপনার যা হবার তাহা বজ্র কলমে লিখিয়াছেন। আপনার সৌভাগ্য। আপনি-আমি ভাণ্ডারীর গোলাম ও হুকুমের কুকুর। আমার দুইজনে একতারে বাঁধা আছি।
ইতি-
আশীর্বাদক
রমেশ চন্দ্র সরকার।

পত্র নং-২
শ্রী রমেশ চন্দ্র সরকারের ২৩শে চৈত্র দেহত্যাগের চিঠি

বন্ধু;
আমার আশীর্বাদ নিবেন। আশা করি, বাবাভাণ্ডারীর কৃপায় আপনার স্ত্রী-পুত্র নিয়া সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতেছেন। আমার ৯০ (নব্বই) বছর বয়স। চিঠি লিখতে গেলে হাত কাঁপে। তবুও আপনার চিঠি পাইলে আমি নিজের হাতে লিখি।
আপনি ছেলে-মেয়েদের জন্য বেশী চিন্তা করিবেন না। আপনি বাবাভাণ্ডারীর নাম সবসময় স্মরণ রাখিবেন। রাখাল মাঠে গরু ছাড়িয়া দিয়া একখানে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। সময় সময় মাথা একটু উঁচু করিয়া দেখে, গরু কারো ক্ষেত নষ্ট করে নাকি।
বাবাভা-ারীর হুকুমে আমি দেহত্যাগ করিব। আমাকে বলিয়াছেন; রমেশ, তুমি প্রস্তুত থাক।…
ইতি-
আশীর্বাদক রমেশ চন্দ্র সরকার।

ছবিতে রমেশ শীলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফকির আর্শ্বাদ
তরফদার শাহ্ ও মোছাম্মৎ আয়েশা বেগম

এরপর শাহ্ ফকির আর্শ্বাদ তরফদার মাইজভান্ডারী ঐ পুস্তকে লিখেন, “এই সংবাদ শুনিয়া আমি কিছু টাকা পাঠাইলাম। সে সময় ঐ টাকায় ষাট-বাষট্টি (৬০-৬২) বোতল গোলাপ জল হইত। আমি চিঠিতে লিখিয়া দিলাম “আপনাকে আগুনে পোড়াইবেন না। পুলিনকে অথবা যজ্ঞেশ্বরকে ঐ গোলাপ জলে স্নান করাইয়া আপনাকে মাটি দিতে বলিবেন।”
রমেশ আমাকে চিঠিতে লিখিয়া জানাইল; বাবাভাণ্ডারী আপনাকে ইঙ্গিত দিয়াছেন নাকি!
বন্ধুর মৃত্যুর কিছু পূর্বে বাড়ী থেকে যাত্রা করিলাম এবং টাউন থেকে কিছু ফল বিস্কিট নিয়া বন্ধুর বাড়ি হাজির হইলাম। মৃত্যুর প্রথম দুই তারিখ পরিবর্তন হইল।
২১শে চৈত্র বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। রমেশ বলিলেন; “থাকেন। আমি আগামী দিন দেহত্যাগ করিব।”
তখন আমি বলিলাম, “আগামীদিন ২২শে চৈত্র বাবাভাণ্ডারীর ওরশ।” তখন তিনি বলিলাম, “তবে যান।”
তখন আমি বলিয়াছিলাম, “২৩শে চৈত্র ভোর বেলা আসিব। তখন বন্ধুকে আমি নিজের হাতে বিস্কিট গালে দিয়াছিলাম এবং তিনিও আমাকে নিজের হাতে বিস্কিট খাওয়াইলেন। তারপর আমি দরবার শরীফে যাইয়া ফুলের মালা ও আঁতর কিনিলাম এবং ২৩শে চৈত্র ভোর বেলা বন্ধুর বাড়িতে গেলাম। যাইয়া দেখিতে পাইলাম, বন্ধু আমার দেহত্যাগ করিয়াছেন। তখন তাকাইয়া দেখিতেছি, তাহাকে চেয়ারের উপরে বসাইয়া নব সাজে সাজাইয়া রাখিয়াছেন। তখন আমি দরবার শরীফ থেকে যে ফুলের মালা নিয়া গিয়াছিলাম, তখন সেই ফুলের মালা বন্ধুর গলে পয়াইয়া দিলাম। নাকে মুখে আঁতর দিলাম।
তিনি দেহত্যাগ করার পূর্বে বলিয়া গিয়াছিলেন, আপনার যখন যে কথা দরকার হইবে, বলিয়া পুলিনকে জানাইলে সেই কথার উত্তর দিব। তারপর আমি তাহাকে প্রণাম করিয়া বাড়ির দিকে যাত্রা করিলাম।

সূত্র- মাইজভাণ্ডারী তাপসমালা-৮ ( প্রকাশ- এপ্রিল ১৯৯৮ সংখ্যা)
এবি/ মো. তাজুল ইসলাম রাজু/২৪-৬-২০১৯

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here