ক্রীড়া ডেক্স: ড্রেসিংরুম থেকে কেউ ছুটে এল না। স্টাম্প নিয়ে কাড়াকাড়িও পড়ল না। এক রান দরকার ছিল, মাহমুদউল্লাহ এক্সট্রা কাভার দিয়ে চার মেরে দিলেন। ‘সিগনেচার’ শটে এল স্বাক্ষর রেখে দেওয়ার মতো এক জয়। অদূরের গ্যালারিতে তখন দর্শকের গর্জন, উল্লাস। এই চিৎকার, এই গর্জনের মানে—আমরা পেরেছি! আমরা পেরেছি!

এবারও কাজটা সহজ ছিল না। বরং আগের ছয়বারের চেয়ে অনেক দিক থেকেই কঠিন ছিল। কিন্তু কঠিনকেই কী সহজ-সম্ভব করে বাংলাদেশ জিতল! ২৪ ওভারে ২১০ রান করতে হতো। বাংলাদেশ জিতল ৫ উইকেট আর ৭ বল হাতে রেখেই! সপ্তমবারে এসে ফাইনাল নামের দুর্বোধ্য ধাঁধাটা কাল মালাহাইডে মিলিয়ে দিল মাশরাফির দল।

শুরুতে দুরন্ত সাহস ভর করেছিল সৌম্য সরকারের ব্যাটে। ৪১ বলে ৬৬ রানের সেই সাহস সৌম্য সঞ্চার করে দিয়েছেন মোসাদ্দেকের মধ্যে। মাত্র ২০ বলে ফিফটি করা মোসাদ্দেক ২৪ বলে ৫২ রানে অপরাজিত থাকলেন। বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম ফিফটির দিনে ৫টি বিশাল ছক্কা হাঁকিয়েছেন, দুটি চার। দুই তরুণের অসম সাহসিকতার দিনে পথ দেখালেন দুই সিনিয়র। মুশফিক ২২ বলে করলেন ৩৬। ২১ বলে মাহমুদউল্লাহর ১৯ রানের ইনিংসটাও সময় বিবেচনায় হয়ে উঠল মহাগুরুত্বপূর্ণ।

বৃষ্টির কারণেই কমেছে আকার। বৃষ্টি নামার আগে ২০.১ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তোলে ১৩১ রান। ৫ ঘণ্টার বেশি সময় বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ থাকার পর ম্যাচ হয়ে যায় ২৪ ওভারের। বাকি ৩.৫ ওভারে ক্যারিবীয়দের হাত খুলে মারতে দেননি মিরাজ। আর ২১ যোগ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেমেছিল ১ উইকেটে ১৫২ রানে । ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২১০ রানের।

টি-টোয়েন্টি জমানায় ২৪ ওভারে এই লক্ষ্য কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তামিম-সৌম্যর জুটি ৫ ওভারের পাওয়ার প্লেতেই এনে দেয় ৫১ রান। এমন একটা শুরুই তো দরকার ছিল। সৌম্যই ছিলেন কড়া মেজাজে। তামিম শুধু প্রান্ত বদল করে দিচ্ছিলেন। সৌম্যর রান তখন ৩৯, যার ৩৬-ই এসেছে বাউন্ডারি থেকে; আর তামিমের ১০। ছয়টি চার আর দুই ছক্কা হাঁকিয়ে ফেলেছেন সৌম্য। তামিম তখনো বাউন্ডারির খাতা খোলেননি। স্ট্রাইক ঘোরানোর তালে ছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ ওভারে গ্যাব্রিয়েলকে পরপর দুটি চার মেরে তৃতীয় বলে ক্যাচ তুলে দিলেন আগে একবার বেঁচে যাওয়া তামিম। ৫৯ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙল। ভালো শুরুটাও ভালো থাকল না। ব্যাটিং অর্ডারে পদোন্নতি পেয়ে তিনে নেমে সাব্বির টিকলেন মাত্র দুই বল। গ্যাব্রিয়েল চার বল আর ১ রানের মধ্যে ২ উইকেট তুলে এনে দারুণভাবে ম্যাচে ফেরালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। কিন্তু তাতেও সৌম্যকে টলানো গেল না। এবার মুশফিকের সঙ্গে ৪৯ রানের জুটিটাও হলো ৩৩ বলে। ৯টি চার আর তিন ছক্কা হাঁকানো সৌম্য বদলি ফিল্ডারের হাতে ক্যাচ তুলে ফিরলেন।

কী শটগুলোই না খেলেছেন এর আগে! কোমর উচ্চতার বলে বাংলাদেশিদের অস্বস্তি পুঁজি করতে চেয়েছিল ক্যারিবীয় পেস-ব্যাটারি। কিন্তু সব কটি বল টেনে টেনে মেরেছেন। এই সফরে তিন ম্যাচে তিনটি ঝলমলে ফিফটি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে কখনোই টানা তিন ম্যাচে ৫০ পেরোনো হয়নি। সৌম্য দারুণ আত্মবিশ্বাস নিয়েই যাচ্ছেন বিশ্বকাপে।

মালাহাইডে বাংলাদেশের সমর্থক একেবারে কম ছিল না। ছবি: এএফপিসৌম্য ফেরার পর মুশফিকের ২২ বলে ৩৬ আরেকটু এগিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। কিন্তু ৯ রানের মধ্যে মুশফিক-মিঠুন দুজনই ফিরে এলে আবারও কঠিন চাপে পড়ে বাংলাদেশ। মালাহাইডের আকাশে তখন আবার ভিড় করা কালো মেঘ শঙ্কার রূপক। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেকের ৭০ রানের হার না মানা জুটি বাংলাদেশকে নিয়ে গেল সেই তীরে, যেখানে ভেড়ার জন্য অপেক্ষাটা সেই ২০০৯ সাল থেকে। মোসাদ্দেকের ইনিংসটার দ্যুতি সৌম্যর চেয়েও তো বেশি। ১৮ বলে ২৭ লাগে—অতীতে এর চেয়ে সহজ সমীকরণেও বাংলাদেশ পথ হারিয়েছে। কিন্তু অ্যালেনের করা ২২তম ওভারেই ২৫ রান তুলে খেল খতম করে দিলেন মোসাদ্দেক!

একটা ফাইনালও বাংলাদেশ নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারবে না, এ যেন নিয়তিরই লিখন। সাকিবকে ছাড়া খেলতে নেমে আরও একবার একাদশে পরিবর্তন আনতে হয় বাংলাদেশকে। একে তো হিম ঠান্ডা, তার ওপর ভেজা কন্ডিশন। বাংলাদেশের বোলারদের কাজটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। ম্যাচের শুরু থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি। ভেজা ঘাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে বল হয়ে গিয়েছিল পিচ্ছিল। আড়ষ্ট হাতে বল গ্রিপ করতে ঝামেলায় পড়েছেন বোলাররা। সফরের শেষ দিনেই সবচেয়ে কঠিন আবহাওয়া বাংলাদেশের সামর্থ্যের নিল কঠিন পরীক্ষা।

টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে উদ্বোধনী জুটিতেই ১৪৪ তুলে ফেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বৃষ্টির পর বোলাররা লক্ষ্যটাকে বেশি বাড়তে না দিলেও ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি সেই কাজ করে দিয়েছে। কিন্তু কাল কোনো বাধাই আর দেয়াল তুলে দাঁড়াতে পারল না মাশরাফিদের সামনে। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ পেয়ে গেল বহু আরাধ্যের সেই ট্রফিটা, সঙ্গে অদম্য আত্মবিশ্বাসও।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here