বাদল চন্দ্র দাশ
এদেশের শিক্ষিত সংস্কৃতিবান, পরিশীলিত, পরিচ্ছন্ন রুচির ব্যক্তিদের মনে সৃষ্টি হল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হবার অদম্য স্পৃহা। যুবসমাজের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করে চারিত্রিক দৃঢ়তা ও নৈতিকতা সৃষ্টিতে প্রয়ােজন জ্ঞানের আলাে। এই মানসিকতায় তাঁরা প্রতিষ্ঠাতা করেন স্কুল, ক্লাব, পাঠাগার। এমনি এক শুভমুহুর্তে বীর প্রসবিনী চট্টলার প্রেমপ্রীতির পুণ্যক্ষেত্র ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদ শাকপুরার পূর্ব সীমানায়, বিটনী বেষ্টিত লালার দিঘির পাড়ে ১৯১৫ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত হয় শাকপুরা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়। বিদ্যোৎসাহী, দানশীল প্রয়াত জমিদার দুর্গাকিংকর নাহা ও জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্ব প্রয়াত নিশীকান্ত চক্রবর্তীর অমলিন প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিদ্যালয়। যারা পূজিত হয়ে আসছেন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। ছুটির ব্যাপারে সরকারের বাধ্যবাধকতা আরােপের পূর্ব পর্যন্ত তাঁদের স্মরণে ছাত্র-শিক্ষক দু-দিন ছুটি ভােগ করত। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠাতাদের সার্বিক সহযােগিতায় ছিলেন এলাকার পুণ্যাত্মা গণ্যমান্য আরােও অনেকে। ১৯১৫ খ্রি. প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয় হাঁটিহাঁটি পা-পা করে সগৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে শিক্ষার দীপ্ত মশাল প্রজুলিত অজ্ঞতার তিমির তিরােহিত করে পল্লি গাঁয়ের হাজারাে তরুণের জীবনকে আলােকিত করে দেশ ও জাতির অগ্রগতির স্রোতে শামিল করে একশত এক বৎসরে পদার্পণ করল। পালিত হলো শতবর্ষপূর্তি ও প্রাক্তন ছাত্র পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। তা দেখে হৃদয়ে জাগে পুলকিত শিহরণ। গর্ববােধ ও সৌভাগ্যবান মনে করছি এ অনুষ্ঠানের একজন অংশীদার হতে পেরে। অনুষ্ঠানে পরপারের দুই প্রতিষ্ঠাতার স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধা। প্রতিষ্ঠাতাদের সহযােগিতায় যারা শিক্ষার মশাল প্রজ্বলনে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা সবাই প্রয়াত। তাঁদের স্মৃতির প্রতি রইল কৃতজ্ঞ চিত্তের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও বিনম্র প্রণাম। অবিস্মৃত বিদ্যালয় ইতিহাসের পাতায় প্রােথিত থাকবেন ওনারা।
বিদ্যালয় ভবনটি ছিল দীর্ঘ মাটির ঘর, টিনের ছাউনি, দু-দিকে বারান্দা ও দরজা এবং মাঝখানে এক বিশাল হলকক্ষ। লালার দিঘির উত্তর পাড়ে প্রতিষ্ঠাতা দুর্গাকিংকর নাহার নিজ জায়গায়। বােয়ালখালীর খালপাড়ে পুলের কাছে (বানছাল বলে পরিচিত) নিম্নমাধ্যমিক ইংরেজি বিদ্যালয়টি সারােয়াতলী পি. সি. সেন উচ্চ বিদ্যালয় ও পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে অত্র এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা এ নবপ্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন- এঁরাই প্রথম শিক্ষার্থী। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন আমার নিকট প্রতিবেশী প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব প্রয়াত নগেন্দ্রলাল সেন বি.এসসি.। তিনি সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ের প্রতি প্রগাঢ় আকর্ষণের প্রেক্ষিতে চাকুরিতে পদত্যাগ করে বিদ্যালয়ে যােগদান করেন। ঈর্ষণীয় ব্যাপার হলাে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্বীকৃতি লাভের প্রেক্ষিতে ছাত্ররা ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। স্বীকৃতি লাভে সহায়তা করে বিদ্যালয়ের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন পটিয়ার ঊনাইনপুরা নিবাসী নমস্য বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রয়াত কৃপাশরণ মহাস্থবির। ১৫ বৎসর পূর্বে ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত সারােয়াতলী উচ্চবিদ্যালয় সব সময় এ বিদ্যালয়কে অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। দিঘির পাড়ের স্কুল, ছাগল হাঁটার স্কুল- এসমস্ত অরুচিমূলক নামকরণে বিদ্যালয়ের পরিচিতি প্রদান করে নিজেদের। হীনমন্যতার পরিচয় প্রদান করতেন বলে আমার বিশ্বাস।
প্রতিষ্ঠালগ্ন ১৯১৫ থেকে ১৯৪৫ খ্রি. পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বৎসর বিদ্যালয়ের চলার পথ ছিল বন্ধুর। নানা প্রতিকূলতা জয় করে নিজ অস্তিত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। তৎকালীন প্রধান শিক্ষকমণ্ডলীর বিদ্যালয়ে অবস্থানের সময় অবলােকন করলে, বিদ্যালয়ের দুরবস্থার চিত্র উঠে আসে। এক থেকে দুই বৎসরের বেশি সময় কেউ অবস্থান করেন নাই, যদিও যাদের অধিকাংশই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাস্টার ডিগ্রিধারী, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ শিক্ষক, কিন্তু বিশুদ্ধ মানসিকতাসম্পন্ন, ত্যাগী ঋষিতুল্য, জ্ঞানতাপস যে-সমস্ত শিক্ষক প্রাণের টানে এ পেশায় এসেছিলেন এরা বিশ্বাস করতেন Teachership is not a job but dedicated mission. ওনারা দারিদ্রতাকে উপেক্ষা করে “হে দারিদ্র্য, তুমি মােরে করেছ মহান” কবির আত্মবাক্য ধারণ করে বিনা বেতনে চাকুরি করেছেন, শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যান। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বিদ্যালয়ের চরম দুরবস্থা অস্তিত্ব সংকটের মুখােমুখি। এই সময়ে ত্রাতা হিসেবে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মধ্য শাকপুরা নিবাসী প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব প্রয়াত বিপিন বিহারী চৌধুরী। বার্মায় নিজ কর্মস্থল ছেড়ে প্রাণের টানে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। স্বীয় কৃতিত্বময় উদ্যোগে জনগণ থেকে চাঁদাসগ্রহ এমনকি মুষ্টিভিক্ষার চাল সংগ্রহ করে বিদ্যালয়ের সচ্ছলতা আনতে সক্ষম হন। শিক্ষকবৃন্দের বকেয়া বেতন প্রদান করে পাঠদানে তাদের আগ্রহ ও আন্তরিকতা বাড়ানাের পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে পাঠক্রম এগিয়ে নেয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেন। এ নমস্য ব্যক্তিত্ব বিদ্যালয়কে নিজ পায়ে দাঁড়ানাের অবস্থায় এনে ১৯৪৫ সালে কৃতী, দক্ষ প্রশাসক, অভিজ্ঞ উত্তরভূর্ষি নিবাসী স্বর্গীয় নীরােদ বরণ চৌধুরী এম.এসসি,বি.টি. মহােদয়ের হাতে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব অর্পণ করে পুনরায় নিজ কর্মস্থল বর্মায় চলে যান। আজকের শতবর্ষের শুভলগ্নে তাঁর পুণ্য স্মৃতির প্রতি নিবেদন করি গভীর শ্রদ্ধা।
প্রধান শিক্ষক প্রয়াত নীরদ রঞ্জন চৌধুরী ছিলেন দক্ষ প্রশাসক ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বিদ্যালয়ে তাঁর অবস্থান ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২। এই সময়টা বিদ্যালয়ের ছিল গৌরবদীপ্ত কাল। বিজ্ঞানের ডিগ্রিধারী হলে ইংরেজিতে ছিলেন পারদর্শী। জ্ঞানের পরিসীমা ছিল অতুলনীয়। তার কে পরিচালনায় ১ম বারের মত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৭ সালে ১ জন ছাত্র জেলায় ১ম স্থান অধিকার করে বেইলি মেডেল এবং ১৯৪৯ সালে মেধানুসারে ৭ম স্থান অধিকার করে বিদ্যালয়ের সম্মানফলকে নাম লিপিবদ্ধ করেন। এ অভূতপূর্ব ফলাফলে বিদ্যালয়ের সুনাম রদিকে ছড়িয়ে পরে। তিনি বলতেন- ‘A Teacher is known by the students he teach. স্বাধীনচেতা আপােসহীন এই শিক্ষকের থে পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারির (তৎকালীন সময়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতি S.D.O. এবং এলাকার বিদ্যোৎসাহী একজন ব্যক্তি। সেক্রেটারি থাকতেন) মনােমালিন্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করেন বা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেই ১৯৫২ সালে শীতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে বাবার হাত ধরে শাকপুরা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের হাত থেকে ৪র্থ শ্রেণির ইউনিয়নভিত্তিক পরীক্ষার ৯ম পুরস্কার নিয়েছিলাম এবং প্রাথমিক শিক্ষা শাকপুরা হাইস্কুল সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমাপন করি।
একই পরিবেশে দু’টি বিদ্যালয়ের অবস্থান বিধায় নূতন স্কুলের ১ম দিনটা ভয়ের পরিবর্তে আনন্দের ছিল। প্রধান শিক্ষক ইংরেজি পড়াতেন। উনার পদত্যাগের প্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জ্ঞানতাপস প্রয়াত মােহিনীমােহন দত্ত মহােদয়কে Rector করে প্রয়াত নীরােদ রঞ্জন বড়ুয়া। মহােদয়কে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তার অবস্থান কাল ১৯৫২-এর শেষার্ধ থেকে ১৯৭২-এর প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় ২০ বৎসর। তাঁর অবস্থানকালটা বিদ্যালয়ের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল সময়। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন, অকুতােভয়, দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি আপন মহিমায় একজন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রধান শিক্ষক। আমার ছাত্রজীবনের প্রায় পুরাে সময়টা তাকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি।। প্রশাসনিক দক্ষতা ছাড়া তাঁর পাঠদান পদ্ধতি ছিল অপূর্ব। অংকের সমাধানে অংকের প্রতিটি Step যেন কথা বলত, প্রাণবন্ত করে তুলতেন ইংরেজি ক্লাস। প্রয়াত জ্ঞানদা বাবুর Parsing class ও Tense পড়াবার পদ্ধতি বড়ই আনন্দদায়ক। প্রয়াত নেপাল কান্তি দস্তিদার মহােদয়| ব্রে ইতিহাসের ক্লাসে তিনি ইতিহাসটাকে জীবন্ত করে তুলতেন। প্রয়াত মণীন্দ্র বাবুর ক্লাসে খুব রস উপভােগ করতাম। তাঁর রসালাে কথাগুলাে আজও স্মৃতিতে অম্লান। মনে পড়ে ঋষিতুল্য জ্ঞানের ভাণ্ডার স্বর্গীয় মােহিনী বাবুর কথা। তিনি ইংরেজি কবিতা পড়াতেন। জ্ঞানের গভীরতা, পরিসীমার ব্যাপ্তি এত বেশি ছিল যে তার প্রদীপ্ত আলােচনা বুঝতে পারার মত ধীশক্তি ও ধৈর্য আমাদের ছিলাে না। ফলে বলতাম স্যার, এগুলাে কলেজে লাগবে” তিনি কর্ণপাত করতেন না। আবার তিনি ছিলেন বিদ্যালয় পাঠাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত, প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেক ছাত্রকে কমপক্ষে একটি বই পড়তে হত। ফেরত দেয়ার সময় প্রশ্ন করে জানতে চাইতেন বইটা পড়েছে কিনা। তখন বিভিন্ন মনীষীদের জন্মমৃত্যুদিবস, জাতীয় দিবসের তারিখে হল কক্ষে সভা হতাে। ছাত্রদের বলতে হতাে, শিক্ষকবৃন্দ বলতেন, সভাপতি থাকতেন মােহিনীবাবু। সভাপতি, ভাষণ এত দীর্ঘ হত যে আমাদের ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটতাে। দীর্ঘ অবস্থানের কারণে কষ্ট পেতাম। ছাত্রাবস্থায় উনাকে যে মনােকষ্ট দিয়েছি। তার জন্যে এ শুভ মুহূর্তে তার বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
১৯৫৭ সাল। সরকার ঘােষণা করলেন প্রত্যেক থানায় একটি বিদ্যালয়কে Model (আদর্শ) স্কুল করা হবে।
তৎকালীন মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তালিকায় শাকপুরা উচ্চ বিদ্যালয় ও পি.সি. সেন সারােয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়। দুই বিদ্যালয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দীর্ঘ দিনের। স্মৃতিতে ভেসে আছে বেঙ্গুরা রেল স্টেশনে মন্ত্রীকে ঘিরে ধরা হলাে আমি ফুলের মালা দিলাম। ঘােষণা এল বােয়ালখালী থানায় শাকপুরা উচ্চ বিদ্যালয় Model হবে। সে প্রতিযােগিতায় আমরা জিতে গেলাম। নূতন নামকরণ `শাকপুরা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়’।
১৯৫৮ সালে ঢাকা বাের্ডের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এই বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৬ বৎসরের অবস্থান শেষ করলাম। আমার বর্তমান পরিচিতির জন্য আমি ঋণী আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান ও স্বনামধন্য শিক্ষকবৃন্দের কাছে। যাদের সন্তানতুল্য স্নেহমমতা, উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা আমাকে দিয়েছে এগিয়ে যাবার পাথেয়, শিখিয়েছে আত্মসচেতন, দৃঢ়প্রত্যয়ী মানুষ হতে, আত্মগর্বে গরীয়ান হতে, তাদেরকে| আজ বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি। অনেকে এখন না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁদের আত্মার সদ্গতি আন্তরিকতার সাথে কামনা করি। খুব মনে পড়ে স্কুলজীবনের সহপাঠীদের কথা। তাদের সাথে কাটানাে আনন্দঘন মুহূর্তগুলাে। বাের্ডিং-এ থাকতাম, তাই উপরের অনেক ছাত্রের সাথে ছিল সখ্যতা, সহমর্মিতা। ঝগড়া-বিবাদ করলেও একে অন্যের দুঃখে মর্মাহত হতাম। আনন্দের অংশীদার হতাম। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে, আলাপ হবে, স্মৃতির বিনিময় করতে পেরে পুলকিত হলাম।
১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যালয়ের প্রবল ক্ষতিসাধিত হয়। ঘরের টিনের চাল, কাঠের কাঠামাে-সহ উড়িয়ে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধানক্ষেতে ফেলে দেয়। পাঠদানের খুবই অসুবিধা। বিচলিত না হয়ে আপন মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত প্রধান শিক্ষক নীরােদবাবু নিজ প্রচেষ্টায় দাউদ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিদের কাজ থেকে টাকা সংগ্রহ শুরু করলেন। বিদ্যালয়ে ইটভাটা দিয়ে পাকা ভবনের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে পূর্ব দিক থেকে আরম্ভ করে ১৯৬৪ সালে কাজ শেষ করেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় এলাকার সবাই মুগ্ধ হন ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
আমার এই Alma Mater-এর আমার সম্পর্ক দ্বিমাত্রিক। ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খােলার অনুমতি পান। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে বাড়িতে ছিলাম। প্রিয় প্রধান শিক্ষকের আহ্বানে বিজ্ঞান হিসেবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করলাম। বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষকই আমার শিক্ষক। তারা অভিজ্ঞ ও প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী। নূতন শিক্ষক-তাই জ্ঞানের গভীরতা ছিল খুব কম। ছাত্র হিসেবে যাদের পেলাম তারা খুব মেধাবী। তাদের পাঠদানের জন্য আমাকে বেশ পড়তে হত।
প্রবীণ শিক্ষকেরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করায় তাদের কাজ থেকে আমার অজানা বিষয়বস্তু শিখে নিতাম। গর্ববােধ করি ১ম ২য় ব্যাচের ছাত্ররা কুমিল্লা বাের্ড থেকে ১৯৬৬ সালে ষােড়শ স্থান ও ১৯৬৭ সালে ৭ম স্থান অধিকার করে। ছুটির পরে প্রধান শিক্ষক, প্রয়াত কাকা অটলবাবু, জ্ঞানদা বাবুর কাজ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম। অনেক সময় প্রধান শিক্ষক তার অসমাপ্ত ক্লাসে আমাকে পাঠিয়ে পরীক্ষা নিতেন। যা আমার শিক্ষকতা জীবনকে শানিত করেছে। শিক্ষকতাকে নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণের কাজ অগ্রসর করে দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হল এক বৎসরের জন্য শিক্ষকতায় এসে কী এক অদৃশ্য চৌম্বকীয় আকর্ষণে আমি যেন আটকে পেলাম। শিক্ষকতা যেন নেশা হয়ে গেল। বিভিন্ন চাকুরির নিয়ােগপত্র পেয়েও যেতে পারলাম না। ছাত্রদের ভালােবাসা, পাঠদানের আনন্দ, সর্বোপরি প্রধান শিক্ষকের মায়াবী। এক আকর্ষণ আমাকে টেনে রাখতাে। ১৯৬৯ সালে এম.এ. পড়তে যেতে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে আমাকে শিক্ষা ছুটি দেন।
এলাে মুক্তিযুদ্ধ। শুরু হলাে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক কর্মকাণ্ড। ব্যাপক ক্ষতি হল বিদ্যালয়ের। E.PR. ঘাটি-এ সন্দেহে বিদ্যালয় অফিসে আগুন দিলেন। ভষ্মীভূত হল ১৯১৫ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সব রেকর্ডপত্র। প্রাক্তন ছাত্রদের কোনাে তথ্যই রইল না। আজও এ প্রধান শিক্ষকের সহযােগিতা এখনােও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি, “ভাঙবাে তবু মছকাবাে না”। এই মানসিকতা সম্পন্ন স্বাধীনচেতা প্রয়াত প্রধান শিক্ষক মহােদয় পরিচালনা কমিটির সাথে ভুল বুঝাবুঝির কারণে সৃষ্ট মনােমালিন্যের কারণে পদত্যাগ করে হাবিলাসদ্বীপ উচ্চ বিদ্যালয়ে চলে গেলেন। এতে করে যার সুন্দর ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় যে বিদ্যালয় জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
পরবর্তীতে স্বর্গীয় মণীন্দ্রলাল চৌধুরী ১৯৭২-৭৭ সাল পর্যন্ত সুনিপুণ দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে অবসরগ্রহণ করেন। পরবর্তী প্রধান শিক্ষক জনাব মাে. ইসহাক সাহেব ১৯৭৮-১৯৯২ (জানু.) পর্যন্ত দীর্ঘ দিন কৃতিত্বের সাথে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। দু-জনের দক্ষ পরিচালনায় পাবলিক পরীক্ষায় বরাবরই অভাবনীয় ও ঈর্ষণীয় ফলাফল করতাে। শ্রদ্ধেয় ইসহাক সাহেবের সময় বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি বাবু সুজিত কুমার বিশ্বাস নিজ অর্থায়নে বাের্ডিং-ঘর নির্মাণ-সহ অনেক কাজ করেছেন। দীর্ঘ ১৯ বৎসর সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর হাজি আজগর আলী উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির আহ্বানে ১৯৮৩-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত উক্ত বিদ্যালয়ে এবং ১৯৮৮-১৯৯২ সাল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনাজুরী নবীন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন কালীন সময়ে আমার প্রবল হিতাকাঙ্খী বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য মরহুম খায়ের আহমদ, স্বর্গীয় রাখাল দে এবং সভাপতি সুজিত কুমার বিশ্বাস (মন্টুবাবু) মহােদয়ের আহ্বানে সর্বোপরি বিদ্যালয়ের প্রতি অটুট ভালােবাসার কারণে নিয়ােগ প্রাপ্তির ৫ মাস পর অক্টোবর ১৯৯২-এ প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। পূর্বসূরি প্রধান শিক্ষকমণ্ডলীর প্রশাসনিক দক্ষতা ও পাণ্ডিত্যের সাথে নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার কথা ভেবে ভয় পেতাম। আবার ভাবতাম বীর নেপােলিয়ন ও আলেকজান্ডার প্রয়াত হলেও এখনাে যুদ্ধ হয়, জয়-পরাজয় নিশ্চিত হচ্ছে। এ বিশ্বাসে ভর করে সাহসিকতা ও আন্তরিকতার সাথে বিভিন্ন পরিকল্পিত কর্মসূচি নিয়ে ১৯৯২ অক্টোবরের থেকে জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত সময়ে নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলাম বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এ সময়ের ও সার্থকতা পরিচালনা কমিটির সম্মানিত সদস্য ও দক্ষ সহকর্মীদের প্রাপ্য, আর সব ব্যর্থতা নিজের কাঁধে নিয়ে অবসরগ্রহণ করি।
এ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৪১ বৎসর (ছাত্রাবস্থায় ৬ বৎসর ও শিক্ষক হিসেবে ৩৫ বৎসর) আমার অবস্থান সময়ের অনেক স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে চিরস্থায়ীভাবে প্রােথিত আছে। তাই Daffodils কবিতার Parody করে বলতে ইচ্ছে হয়When I am in empty and vacant mood The evergreen memory of many events and incidents of my Alma Mater flashes in my inward eye that gives me pleasure and appears to me as Bliss of Solitude. শতবর্ষপূর্তি ও প্রাক্তন ছাত্র পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের স্মারক প্রকাশিত হয়েছে আনন্দিত হলাম। পূর্তি অনুষ্ঠানের অনেক স্মৃতি কালের স্রোতে ভেসে গেলেও আগামী দিনের ছাত্রদের সৃষ্টিশীলতা সৃষ্টিতে এটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, তাদেরকে আবদ্ধ করবে প্রতি প্রেমের পূণ্য বন্ধনে। পরিশেষে প্রার্থনা জানাই-
বহু কীর্তিমানের গর্ভধারিণী হে বিদ্যালয় : তােমার শিখাটি জ্বলে উঠুক সবার প্রাণে।
লেখক : প্রাক্তন ছাত্র- ব্যাচ ১৯৫৮, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা
সূত্র- অনিবার্ণ -শাকপুরা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় শতবর্ষ স্মারক সংকলন