ইমরান বিন ছবুর : এপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, ওপারে বোয়ালখালী। মাঝখানে প্রবাহমান কর্ণফুলী নদী। এই হচ্ছে চট্টগ্রাম-৮ সংসদীয় আসন। সংসদ সদস্য মঈনউদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে আগামী ১৩ জানুয়ারি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথমবারের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট অনুষ্ঠিত হবে। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থী চষে বেড়াচ্ছেন মাঠ-ঘাট। পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে নির্বাচনী এলাকা। কিন্তু বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বোয়ালখালীতে প্রচারণা ও গণসংযোগ করতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধে। উপজেলা সদরে তার গাড়ি বহরের একটি নোহা মাইক্রো ভাঙচুর ও কর্মীদের মারধর এবং পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ ওঠেছে। নির্বাচনী পরিবেশ নগরীর অংশে (সিটি কর্পোরেশনের ৫ ওয়ার্র্র্র্র্র্র্র্র্র্ড) সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শান্ত থাকলেও বোয়ালখালী অংশে অশান্ত ও শঙ্কিত হয়ে ওঠেছে।
পোস্টার ছিঁড়ে ভোটাধিকার হরণ করতে পারবে না, জনগণই বড় বিচারক : আবু সুফিয়ান
নির্বাচনী আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক এক সভায় নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমও বোয়ালখালীর পরিবেশ নিয়ে আগ থেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি গত উপজেলা নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘বোয়ালখালী একটি অস্থির এলাকা। উপজেলা নির্বাচন ছিল নিজেদের মধ্যে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এক জন আরেক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেই চলছিল। তখন থেকে বোয়ালখালী নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম। এটা হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন, বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সকলের সমন্বয়ে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবো।’
ভোটের মাঠে রয়েছেন ৬ প্রার্থী। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমদ ও বিএনপির মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। মাঠে রয়েছেন বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদের অধ্যক্ষ সৈয়দ মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, ন্যাপের বাপন দাশগুপ্ত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ এমদাদুল হক।
মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্বাচনের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছে বিএনপি : আওয়ামী লীগ
প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোছলেম উদ্দিনের জন্মস্থান বোয়ালখালী অংশে। দীর্ঘদিন ধরে ঘরোয়া রাজনীতিতে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন তিনি। নির্বাচনী মাঠেও দেখা গেল একই চিত্র। প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগে প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বোয়ালখালীতে প্রচারণা চালাতে গিয়ে হোঁচট খায় বিএনপি।
গত শনিবার সুফিয়ানের প্রচারণা ও গণসংযোগ শেষে ফেরার সময় প্রচারণার গাড়ি ভাঙচুর এবং নেতাকর্মীদের মারধর করেছে বলে অভিযোগ বিএনপির। উপজেলা প্রশাসনের সীমানা দেয়ালের ভেতরে এই হামলার ঘটনা ঘটে। বিএনপির দাবি, ছাত্র ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও নেতাকর্মীদের মারধর করেছে। নির্বাচন কমিশনকেও লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বিএনপি প্রার্থী। এই ঘটনার পর থেকে বোয়ালখালীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ ভোটার ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে অজানা শঙ্কা বিরাজ করছে। শান্ত পরিবেশ এখন ভীতিকর হয়ে ওঠেছে। এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ-ভোটার, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা হলে তারা এই শঙ্কার কথা প্রকাশ করেন।
এলাকাবাসী জানায়, গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিল সাধারণ ভোটাররা। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। প্রচার-প্রচারণায় শান্ত পরিবেশ এখন আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে। যেন এক বছর আগের পুনরাবৃত্তি। ভয়-আতঙ্ক আর শঙ্কায় রয়েছেন সাধারণ ভোটাররা।
তফসিল ঘোষণার আগে কধুরখীল ইউনিয়নে আবু সুফিয়ানের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এসময় পৌর মেয়র ও পৌর বিএনপি সভাপতি হাজি আবুল কালাম আবুর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছিল। দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিনের নেতৃত্বে এই হামলা করা হয়েছিল বলে দাবি করেছিল বিএনপি। ভোটের মাঠে ওঠে আসছে এসব ঘটনার রেশ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মোহরা, চান্দগাঁও, পাঁচলাইশ, পূর্ব ও পশ্চিম ষোলশহর এবং বোয়ালখালী পৌরসভা ও উপজেলার ৮ ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-৮ সংসদীয় আসন গঠিত। ভোটার চার লাখ ৭৫ হাজার ৯৯৬ ভোট। এরমধ্যে বোয়ালখালী অংশে ভোট রয়েছে এক লাখ ৬৪,১৩১ জন। আর নগরীর অংশে রয়েছে তিন লাখ ১১ হাজার ৮৬ ভোট। ভোটকেন্দ্র ১৭০টি। বোয়ালখালীতে ৬৯টি ও নগরীতে ১০১টি। ভোটকক্ষ হচ্ছে ৮৫০টি।
দেখা যায়, নগরীর ৫ ওয়ার্ডের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি পর্যন্ত প্রধান দুই দলের পোস্টার, ব্যানারে ছেয়ে গেছে। বিরামহীনভাবে চলছে প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগ ও মিছিল-মিটিং। বোয়ালখালী অংশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট হচ্ছে এই অংশে (নগরী)। এতে দুই দলই সমানতালে প্রচার-প্রচারণা ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা যায় বোয়ালখালী অংশে। পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং, নির্বাচনী ক্যাম্প থেকে শুরু করে প্রচার-প্রচারণা ও ভোটের হাওয়া অনেকটা একপেশে। রাস্তা-ঘাট, অলি-গলিতে শোভা পাচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পোস্টার-ব্যানার। অন্য প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা অনেকটা ¤্রয়িমান। শীতের আমেজে গরম হয়নি ভোটের হাওয়া।
পৌর এলাকার ভোটার কামাল হোসেন, ফুলতলী ব্যবসায়ী নুর আহমদ, শাকপুরা এলাকার কাকলী দে বলেন, ‘গত নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে হেনস্থা হয়েছি। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে এখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছি। পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে ভোটকেন্দ্রে যাব।’
কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কামরুন নাহার, জিসান চৌধুরী বলেন, ‘জীবনের প্রথম ভোটের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ভোট নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’
বিএনপি দলীয় প্রার্থী মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান এই বিষয়ে বলেন, ‘বোয়ালখালীতে আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে মানুষের ভোটারাধিকার হরণ করতে পারবে না। নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। জনগণ এর জবাব দেবেন।’
তিনি আও বলেন, ‘এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি, দেখি কী ব্যবস্থা নেয়। অন্যথায় জনগণ ও ভোটারের কাছে বিচার দেব। তারাই হচ্ছেন বড় বিচারক।’
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোছলেম উদ্দিন বোয়ালখালীর সন্তান। এখানকার মানুষের সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। তিনি ভোটারের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। বিরামহীন প্রচার-প্রচারণা করছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। মানুষ সাড়া দিচ্ছেন।
দেখা যায়, মাইকিং ও প্রচার-প্রচারণা জোরেশোরে চললেও সাধারণ মানুষের কাছে ভোটের আগ্রহ অনেকটা কম।
বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম বলেন, বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। মিথ্যা ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে তিনি (প্রার্থী) ও বিএনপির নীতিনির্ধারকরা নির্বাচনে শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, তাদের দু’গ্রুপের হাতাহাতির কারণে নির্বাচনী মিছিলে গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে।
বোয়ালখালীতে গুটিকয়েক এলাকা ছাড়া পোস্টার ব্যানার তারা লাগায়নি, ছিঁড়বে কে? পরাজয় নিশ্চিত জেনে অভিযোগ করা তাদের পুরোনো অভ্যাস।
খবর দৈনিক পূর্বকোণ