বাবার হাতেই বিপিন চন্দ্র পালের লেখাপড়ার হাতেখড়ি ।১৮৬৬ সালে বিপিন চন্দ্র পালকে তার বাবা নয়া সড়ক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর তিনি সিলেটের প্রাইজ স্কুল, হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্মতত্ত বিষয়ে লেখাপড়া করেন।
তিনি রামচন্দ্র পাল কোর্টে কয়েক বছর চাকুরি করে নিজ জেলা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ চলে আসেন। তারপর সিলেট বারে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হন। একসময় তিনি সিলেটের একজন খ্যাতনামা উকিল হিসেবে সম্মান ও সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হন।
বিপিন চন্দ্র পাল ছিলেন নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করে তরুণ বয়স থেকেই বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। তার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ছিলো বিধবা-বিবাহ প্রচলন করা। বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহরোধ এবং নারীশিক্ষার প্রচলনে ভারতীয় সমাজে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করা। এ ধরনের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিপিন চন্দ্র পাল আমৃত্যু লড়েছেন। রাজা রামমোহন প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ তিনি মনে প্রাণে সমর্থন করতেন। ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেছেন যে সমস্ত বক্তব্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিলো নারী জাগরণের প্রসঙ্গটি। এ জন্য ব্রাহ্মসমাজে দ্বারা পরিচালিত হয়ে ১৮৮১ সালে ডিসেম্বর মাসে তিনি শ্রীমতী নৃত্যকালীকে বিয়ে করেন। নৃত্যকালী ছিলেন পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর এক পালিতা বিধবা কন্যা । নৃত্যকালীকে বিয়ে করার জন্য সমাজচ্যুত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। তাদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয় ।
তার শিক্ষানুরাগীতা ছিল অনন্য । তাঁর বাসায় মফঃস্বলের বহু ছাত্র দীর্ঘদিন থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। বিপিন চন্দ্র পালের মাও ছিলেন উদার ও মানবিক গুণের অধিকারী। তাঁর বাসায় থেকে যেসব ছাত্ররা পড়াশোনা করতো তিনি তাদেরকে স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। পারিবারিকভাবেই বিপিন চন্দ্র পালের মধ্যে সাম্য ও মানবতা বোধের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে। তাঁর প্রচেষ্টায় ১৮৭৭ খ্রি. কলকাতায় শ্রীহট্ট সম্মিলনি স্থাপিত হয়। তিনি ১৮৮০ খ্রি. সিলেটের মুফতি স্কুলের ভগ্নাংশ নিয়ে সিলেট জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠা করে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৮৮০ খ্রি. প্রকাশ করেন সিলেটের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র পরিদর্শন । এছাড়া তিনি বেঙ্গল পাবলিক অপিনিয়ন, ট্রিবিউন, স্বরাজ, হিন্দু রিভিউ, সোনার বাংলা, ইনডিপেনডেন্ট, ডেমোক্রেট সহ অনেক পত্রিকায় সাংবাদিক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন অখন্ড ভারত আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা । ভারত উপমহাদেশের কংগ্রেসীয় রাজনীতির প্রগতিশীল গ্রুপের তিন দিকপাল ছিলেন। তারা হলেন লালা রাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিন চন্দ্র পাল। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিপিন চন্দ্র পালই একমাত্র বিরল প্রতিভার অধিকারী, যিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক । তাঁর বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ। অনলবশী বক্তা হিসেবে তাঁকে ‘বাগ্নী বিপিন চন্দ্র পাল’ বলে অভিহিত করা হয়।
মানুষের মুক্তির আলো ছিনিয়ে আনতে, আপোষহীন রাজনৈতিক কর্মকান্ড, সাহসী লেখনীর জন্য বিপিন চন্দ্র পাল বৃটিশ শাসকের রোষানলের স্বীকার হন বার বার । কারাবরণসহ নানা নির্যাতনে নির্যাতিত হন। কিন্তু কখনোই পিছপা হননি। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ, সাহিত্য রচনা, সাংবাদিকতা এবং তেজস্বী বক্তৃতা ও পান্ডিত্যের জন্য পেয়েছিলেন পরাধীন মানুষের ভালবাসা আর পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষী সমাজের কাছে ।
ভারতীয় কংগেসের জন্মলগ্ন ১৮৮৫ থেকে ১৯০০ সন পর্যন্ত সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনে মতানৈক্যের কারণে ১৯০৫-০৬ সনে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি নিউ ইন্ডিয়া নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে ভারতের স্বায়ত্বশাসন দাবির প্রেক্ষিতে প্রচার শুরু করেন ।
যৌবনের প্রথমদিকে কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে তার সাহিত্য জীবনে সূচনা হয়েছিল। তার সৃষ্টির মধ্যে প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি। তাছাড়া তিনি উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস রচনা করেছেন। তার ‘সত্তর বছর’ বইটি সেকালের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
বিপিন চন্দ্র পালের প্রথম উপন্যাস ‘শোভনা’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। ঠিক এসময় বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয়। ‘শোভনা’ উপন্যাসে তিনি ছদ্মনাম হরিদাস ভারতী ব্যবহার করেন। ‘শোভনা’ নারীসমাজের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য লিখিত একটি উপন্যাস। ‘শোভনা’র আখ্যাপত্রে লেখা আছে:
জীবন সংগ্রামে ভারতের নামে
যত রক্তবিন্দু গড়িবে এবার,
শতপুত্র হবে বীর অবতার;
ভারত আধার ভারতের ভাব
ঘুচাই তারা
না জাগিলে সব ভারত ললনা।
এ ভারত আর জাগে জাগে না।
পূর্ববাংলার নাগরিকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন প্রথম উপন্যাস লিখেছেন ‘রত্নবতী’। সেই হিসেবে রত্নবতী (১৮৬৯) আমাদের প্রথম উপন্যাস। বিপিন চন্দ্র পালের ‘শোভনা’ (১৮৮৪ বাংলা) উপন্যাসের দ্বিতীয় উপন্যাস।
বিপিন চন্দ্র পালের বাংলায় ১৫ টি এবং ইংরেজিতে ১৭টির বেশী বই লিখেছেন। বাংলা গ্রন্হের মধ্যে শোভনা (১৮৮৪), ভারত সীমান্তে রুশ (১৮৮৫), মহারানী ভিক্টোরিয়া (১৮৮৯), জেলের খাতা (১৯০৮), চরিত কথা (১৯১৬), সত্য ও মিথ্যা (১৯১৭), প্রবর্তক বিজয় কৃষ্ণ (১৯৩৩), সুবোধিনী, সত্তর বছর (১৯৫৪), নবযুগের বাংলা (১৯৫৫), মার্কিনে চার মাস (১৯৫৫), রাষ্ট্রনীতি (১৯৫৬), চরিত্রচিত্র (১৯৫৪), শতবর্ষের বাংলা, সাহিত্য সাধনা, কৃষ্ণতত্ত্ব প্রকাশিত হয়।
ইংরেজি গ্রন্হের মধ্যে The New Spirit, The Soul of India, The Battle of Swaraj, Memories of My Life and Times, Beginning of Freedom, Movement in India ইত্যাদিসহ ১৮/১৯ টি বই প্রকাশিত হয়। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত তাঁর ২৫ টিরও বেশী বই বিশ্বের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়।
মহাত্মা গান্ধীর কংগ্রেসে যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত দেশের বামপন্থী নেতৃত্ব বিপিন পালের হাতেই ছিল ।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রাগমুহুতে গান্ধীজীর দেশময় অ-সহযোগ আন্দোলন চালাবার প্রস্তাব জাতীয় মহা সমিতিতে পাশ হয়েছে- বাংলায় তখনও এই প্রস্তাবে মত দেয় নি। সমগ্র ভারত বাংলার নেতা দেশ-বন্ধুর মহিগতির উপর নিবদ্ধ দৃষ্টি। এমন সময় বরিশাল প্রাদেশিক সম্মিলনীতে দেশ-বন্ধু অ-সহযোগের স্ব-পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। সেই সম্মিলনীর সভাপতিত্ব করার সময় বিপিনচন্দ্র এর বিরোধিতা করলেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বিলাতে এক দল লোক পাঠিয়ে এক চরমপত্র ব্রিটিশ পালিয়ামেন্টের নিকট উপস্থিত করা হোক।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীতে মহাত্মা গান্ধীর সাথে মতের মিল না হলে তিনি গান্ধীর মতাদর্শের বিরোধীতা করে বলেছিলেন, “You wanted magic, I tried to give you logic. But logic is in bad odour when the popular mind is excited. I have never spoken a half-true when I know the true … … … I have never tried to lead people in faith blindfolded.”
পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে গান্ধীর সাথে মতানৈক্যের কারণে বিপিন পাল রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
বিপিন চন্দ্র পাল স্বাধীন-সুন্দর-মুক্ত সমাজে স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ কারণে ধৈর্য সাহস ও দৃঢ়তা নিয়ে তার সুদীর্ঘ জীবনের রাজনৈতিক সংগ্রামে অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে অনুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা স্মরণাতীতকালের ইতিহাসে দুর্লভ।
১৯৩২ খ্রি. ২০ মে বিপিন পাল তাঁর জন্মস্থান হবিগঞ্জ জেলার পৈল গ্রামেই দেহত্যাগ করেন।
মহান এ নেতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের নেতা পরবর্তীতে ভারতের স্বনামধন্য প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু ১৯৩৭ সনে হবিগঞ্জের পৈল গ্রামে আসেন বিপিন পালের জন্মস্থান দর্শনের জন্য। সেখানে তিনি আবেগ আপ্লুত হন এবং এই মহান নেতার জন্মস্থান থেকে একমুঠো মাটি তার পাঞ্জাবীর পকেটে করে নিয়ে যান, যা আজও ভারতের দিল্লীস্থ ন্যাশনাল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিপিন চন্দ্র পাল সম্পর্কে যা কিছু বলা হল তার বাইরে রয়েছে, আরো বিস্তৃত ইতিহাস। তবে একথা বলা যায় যে, এ সবকিছু ছাপিয়ে একজন মানবিক বিপিন চন্দ্র পাল চির জাগরুক থাকেন চিরকাল। আসলে এমন মেধা এবং বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী বিপিন চন্দ্র পাল সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে। কেন জানি আমরা এদের যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে কুণ্ঠাবোধ করি। হয়ত আগমী প্রজন্ম ইতিহাসের মনি-মানিক্য থেকে তুলে আনবেন বিপিন চন্দ্র পালের কীর্তি।
লেখক- মোঃ মিজবাউর রহমান আখঞ্জী
কার্টেসি- বিউটিফুল হবিগঞ্জ ।
তথ্যসূত্র-
১ উইকিপিডিয়া ।
২ জেলা তথ্য বাতায়ন, হবিগঞ্জ ।
৩ মাহাফুজুর রহমান, প্রকাশক বাংলা একাডেমী ।
৪ ফজলুর রহমান, “শতাব্দীর দর্পণ”, ২০০০ ।
এবি/টিআর