মো. মুনীর হোসেন খান

ইমাম হুসাইন (রাদি.)-এর শাহাদাত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী
এ প্রসঙ্গে প্রচুর হাদীস ও বর্ণনা রযেছে। মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে মুসলিম উম্মাহকে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সম্পর্কে অবগত করেছেন যাতে করে তারা পূর্ব হতেই ইমাম হুসাইনের মর্যাদা,গুরুত্ব,ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড অনুধাবন করতে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ভুল না করে। এখানে ইমাম হুসাইনের শাহাদাত সংক্রান্ত কতিপয় হাদীস উল্লেখ করব :
১. হযরত আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রাদি.) বলেন,“আমাদের কোন সন্দেহই ছিল না এবং মহানবীর পরিবারের সকলেই জানতেন,ইমাম হুসাইন কারবালার মরুপ্রান্তরে শহীদ হবেন।’’
২. উম্মে সালামাহ্ (রাদি.) বলেন,‘‘একদিন মহানবী আমাকে বললেন : দরজার সামনে বসে থাকো আর কাউকে ঢুকতে দিও না। আমিও মহানবীর নির্দেশ মত কাজ করলাম। হঠাৎ হুসাইন এসে সেখানে উপস্থিত হলো। তাকে ধরতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমার হাত থেকে ছুটে ঘরের ভেতরে একদম মহানবীর নিকট পৌঁছে গেল। আমি মহানবীর নিকট গিয়ে বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! আমার প্রাণ আপনার জন্য উৎসর্গ হোক। আপনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন যেন কেউ এ ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু আপনার দৌহিত্র (হুসাইন) আমার হাত থেকে পালিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মহানবী এ কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। হুসাইনও তাঁর কাছে দীর্ঘ সময় রইল। তাই কৌতূহলবশত আমি দরজার বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে উঁকি দিলাম এবং দেখতে পেলাম,মহানবীর পবিত্র দু’ নয়ন বেয়ে অশ্রু ঝরছে এবং তিনি হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। মহানবীকে আমি এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন : জিবরাঈল এসে আমাকে জানিয়েছেন,আমার উম্মত হুসাইনকে হত্যা করবে। আর যে স্থানে হুসাইন নিহত হবে সে স্থানের মাটিও তিনি আমার কাছে নিয়ে এসেছেন।
৩. উম্মে সালামাহ্ থেকে বর্ণিত,“মহানবী (সা.) বলেছেন : জিবরাঈল আমাকে জানিয়েছেন,আমার এ সন্তানকে (ইমাম হুসাইন) হত্যা করা হবে এবং হত্যাকারী মহান আল্লাহর তীব্র রোষানলে পড়বে।
৪. হযরত আয়েশা বলেন,“মহানবী বলেছেন : যে ভূমিতে হুসাইনকে হত্যা করা হবে জিবরাঈল আমাকে সে স্থানের মাটি দেখিয়েছেন। যে ব্যক্তি হুসাইনের রক্ত ঝরাবে সে মহান আল্লাহর তীব্র রোষানলে দগ্ধ হবে। হে আয়েশা! এ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছে,আমার উম্মতের মধ্য থেকে কে সেই ব্যক্তি যে আমার হুসাইনকে হত্যা করবে?
৫. হযরত উম্মে সালামাহ্ থেকে বর্ণিত আছে,“আমার হুজরায় মহানবীর সামনে হাসান ও হুসাইন খেলছিল। এমন সময় জিবরাঈল অবতীর্ণ হয়ে হুসাইনের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : হে মুহাম্মদ! আপনার পরে আপনার উম্মত আপনার এ দৌহিত্রকে হত্যা করবে। এ কথা শুনে মহানবী হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন : তোমার কাছে এ মাটিটি রাখলাম। তিনি উক্ত মাটিটি শুঁকে বললেন : হে উম্মে সালামাহ্! যখন এ মাটিটি রক্তে রূপান্তরিত হবে তখন জেনে নিও যে,আমার দৌহিত্রকে হত্যা করা হয়েছে।” অতঃপর উম্মে সালামাহ্ উক্ত মাটিটি একটি বোতলে রেখে দিলেন। তিনি প্রতিদিনই উক্ত বোতলটির দিকে তাকিয়ে বলতেন,“এক মহাদিবসে হে মাটি তুই রক্তে রূপান্তরিত হয়ে যাবি!’

হযরত আলী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসসমূহ
আবদুল্লাহ্ বিন নাজীর পিতা হযরত আলীর খিলাফতের একজন পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি হযরত আলীর সাথে সিফ্ফিনের দিকে যাচ্ছিলেন। নেইনাভা বা কারবালার কাছাকাছি কোন এক স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ করে হযরত আলী উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন,‘‘হে আবু আবদুল্লাহ্ (হুসাইন)! ফুরাত নদীর তটে তোমাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।’’ বর্ণনাকারী বলেন,‘‘আমি জিজ্ঞেস করলাম : ব্যাপারটি কি? কেন আপনি ‘হে আবু আবদুল্লাহ্’ বলে উঠলেন?” তখন হযরত আলী (রাদি.) বললেন,‘‘একদিন মহানবীর কাছে গিয়েছিলাম। দেখলাম,তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম : হে রাসূলাল্লাহ্! কেউ কি আপনাকে ক্রোধান্বিত করেছ যার দরুন আপনি কাঁদছেন? মহানবী বললেন : না,তবে কিছুক্ষণ পূর্বে জিবরাঈল আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আমাকে জানিয়েছে,হুসাইনকে ফুরাতের তীরে হত্যা করা হবে। মহানবী আমাকে বললেন : তুমি কি চাও সেখান থেকে কিছু মাটি তোমাকে দেই এবং তা তুমি শুঁকো? আমি বললাম: জী হ্যাঁ,রাসূলাল্লাহ্। অতঃপর ঐ স্থানের এক মুষ্টি মাটি আমাকে দিলেন। আর আমিও তখন কান্না থামিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল।
হযরত আনাস (রা.) বলেন,“মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার এ দৌহিত্রকে অর্থাৎ হুসাইনকে ইরাকের এক এলাকায় হত্যা করা হবে। অতএব,তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাকে ঐ অবস্থায় পাবে তাকে সাহায্য করা তার ওপর ওয়াজিব হবে।
এখানে উল্লেখ্য,আনাস বিন হারেস কারবালায় ইমামের পক্ষে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন।

ইমাম হুসাইনের হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ
জাবির বিন আব্দুল্লাহ্ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“আমি মহানবীকে শিশু ইমাম হুসাইনের ঊরুদ্বয় ফাঁক করে চুম্বন করতে দেখলাম। এ সময় তিনি বলেছিলেন : হে হুসাইন! তোমার হত্যাকারীর ওপর অভিশাপ বর্ষিত হোক!’’ জাবির বলেন,“আমি এ কথা শুনে বললাম : হে রাসূলাল্লাহ্! কে হুসাইনকে হত্যা করবে? মহানবী বললেন : আমার উম্মতের মধ্যে থেকে আমার বংশধরদের প্রতি শত্রুতা পোষণকারী এমন এক ব্যক্তিই হবে আমার হুসাইনের হত্যাকারী। আমি কিয়ামত দিবসে তার জন্য শাফায়াত করব না।’

ইয়াযীদ ইমাম হুসাইনকে হত্যা করবে
হযরত মায়ায (রাদি.) বলেন,“মহানবী (সা.) বলেছেন : ইয়াযীদের অমঙ্গল হোক!… যে মাটিতে ইমাম হুসাইন নিহত হবে সে মাটির কিছু অংশ আমার কাছে আনা হযেছিল।”
এ প্রসঙ্গে মহানবী থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহেও উল্লিখিত অনেক হাদীসে ইমাম হুসাইনের হত্যাকারী ও এ ব্যাপারে যারা জড়িত থাকবে তাদেরকে কিয়ামত দিবসে মহানবী যে শাফায়াত করবেন না- এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই বর্ণনা সংক্ষেপ করার জন্য কেবল উপরোক্ত দু’টি বর্ণনা উল্লেখ করা হলো।
মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর থেকে ইমাম আলীর শাহাদাত পর্যন্ত সম্ভবত নবী দৌহিত্রদ্বয়ের জীবনের সবচেয়ে মধুর ও সুন্দর অধ্যায় ছিল শৈশবের অল্প কয়েকটি বছর যা তাঁরা নানা মহানবীর স্নেহ ও মমতামাখা ক্রোড়ে কাটিয়েছেন। কারণ মহানবীর ওফাতের পর তাঁদের জীবনে নেমে আসতে থাকে একের পর এক দুঃখ-বেদনা ও বিপদাপদ। আর কারবালায় শাহাদাত বরণের মাধ্যমে সে সকল দুঃখ-কষ্ট ও বেদনার অবসান হয়। যা হোক,এসব বিপদাপদ ও দুঃখজনক ঘটনাসমূহ ইমামভ্রাতৃদ্বয়ের মনে সুগভীর প্রভাব ফেলেছিল।

ইমাম ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্য মহানবীর ওসিয়ত
হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ্ আল-আনসারী থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন,“ওফাতের তিন দিন পূর্বে মহানবী (সা.) আলীকে সম্বোধন করে বলতে শুনেছিলাম,মহান আল্লাহর শান্তি তোমার ওপর বর্ষিত হোক,হে সুগন্ধ পুষ্পদ্বয়ের পিতা! আমার পৃথিবীর এ দু’রায়হান (সুগন্ধি) সম্পর্কে তোমাকে ওসিয়ত করছি। কারণ অতি শীঘ্রই তোমার স্তম্ভদ্বয় ভেঙ্গে পড়বে। আর মহান আল্লাহ্ই হচ্ছেন তোমার রক্ষাকারী। অতঃপর যখন মহানবী ইন্তেকাল করলেন তখন হযরত আলী বললেন : মহানবীই ছিলেন আমার জীবনের স্তম্ভদ্বয়ের একটি। এরপর যখন হযরত ফাতেমার ওফাত হলো তখন হযরত আলী বললেন : এ হচ্ছে আমার দ্বিতীয় স্তম্ভ যে সম্পর্কে মহানবী বলেছিলেন।”
খাওয়ারিযমী প্রণীত ‘মাকতালুল হুসাইন’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে,মহানবী (সা.)-এর ওফাতের সময় ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন তাঁর পবিত্র বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁদের দু’জনকে মহানবীর বুক থেকে উঠিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। তখন মহানবী বলছিলেন,“এ দু’জনকে আমার থেকে এবং আমাকেও তাদের থেকে সরিয়ে নিও না। কারণ এ দু’জনকে বিপদাপদ স্পর্শ করবে।” মহানবী তখন তাঁর আশেপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বললেন,‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে মহান আল্লাহর কিতাব আল-কোরআন ও আমার বংশধরদের রেখে যাচ্ছি। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে যারা মহান আল্লাহর কিতাব আল-কোরআনকে হারাবে তারা আমার সুন্নাহকেও হারাবে। আর যারা আমার সুন্নাহকে হারাবে তারা আমার বংশধরদেরকেই (আহলে বাইত) হারাবে। নিশ্চয়ই হাউযে কাউসারে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত এরা (আল-কোরআন ও নবীর বংশধর) কখনো পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।

৭২ জন শহিদে কারবালার নাম মুবারক

ইমাম হুসাইন (রাদি.)-এর ঘাতকদের শেষ পরিণতি

ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গ শাহাদাতের পরপরই নেপথ্য নায়কদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here