মহান স্রষ্টা রব্বুল আলামিন সমস্ত মাখলুকাত সৃষ্টির পর নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, এরপর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে, ভালোবাসা ও নিজ কুদরতি হাত দিয়ে সৃষ্টি করলেন আদমকে, এরপর আদমের প্রতি আল্লাহ-প্রদত্ত ভালোবাসার পরীক্ষা নিলেন জানমালের কোরবানির মাধ্যমে। আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আত্মোৎসর্গ করে তাঁর নামে পশু জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। তিনি ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণ-স্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ সুরা হজ, আয়াত ৩৪। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সব নবী-রসুল ও তাঁদের অনুসারীরা কোরবানি করেছেন। হজরত আদম (আ.)-এর দুই ছেলে হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে প্রথম কোরবানির সূত্রপাত। ইরশাদ হয়েছে, ‘আদমের ছেলেদের বৃত্তান্ত আপনি তাদের যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। তাদের একজন বলল আমি তোমাকে হত্যা করব, অন্যজন বলল আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ সুরা আল মায়েদা, আয়াত ২৭। এরপর আল্লাহর নবী হজরত নুহ, ইয়াকুব, মুসা (আ.)-এর সময়ও কোরবানির প্রচলন ছিল। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে নিজের ছেলেকে কোরবানি করার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করার জন্য আদিষ্ট হন। আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে পিতার ইচ্ছার সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করে শিশু পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) নিজের জান আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর প্রতি ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষা। বহু চাওয়া-পাওয়া ও প্রতীক্ষার ফসল, চোখের মণি, ১৩ বছরের পুত্রধন, কলিজার টুকরা নয়নের মণি শিশু পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে, স্বীয় মমতাময়ী মা হজরত হাজেরা (আ.) স্বীয় হস্তে গোসল করিয়ে, নতুন পোশাক, আতর গোলাপ মেখে সুসজ্জিত করে, বুকের মানিক, নাড়িছেঁড়া ধনকে চিরদিনের মতো বিদায় দান করেন। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পিতার হাত ধরে চলে গেলেন মিনার প্রান্তরে। পিতা-পুত্র দুজনের প্রস্তুতির মধ্যে কোনো রকমের কমতি ছিল না। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ধারালো ছুরি এবং কিছু রশি। যাতে আল্লাহর হুকুম পালনে কোনোরকমের বিঘ্নতা সৃষ্টি না হয়। ক্ষণস্থায়ী এসব মায়া-মমতা, ভালোবাসা অপেক্ষা করে আল্লাহর বড় ভালোবাসা পাওয়ার আশায় ছোট ভালোবাসার গলায় ধারালো ছুরি সজোরে চালিয়ে দিলেন। পিতার হাতে শিশু পুত্রের তপ্ত রক্তের স্পর্শে তিনি আনন্দিত হলেন, তিনি বললেন হে আমার প্রভু! তোমার ভালোবাসার কাঙাল, ইবরাহিমের সব ভালোবাসা তোমার রাহে উৎসর্গ করলাম। তুমি গ্রহণ কর হে প্রভু! তুমি কবুল কর। আল্লাহ তাঁর কোরবানি কবুল করলেন। তিনি মহান প্রভুর ভালোবাসার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। শিশু পুত্র ইসমাইলের স্থলে তিনি পাঠিয়ে দিলেন আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিলের কোরবানিকৃত জান্নাতি দুম্বা। তিনি মহান প্রভুর দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। নবীজি বললেন, পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নতই কোরবানি। মানুষের পরিবর্তে পশু কোরবানি এখান থেকেই নির্ধারিত হয়। অতএব আমাদের পশুগুলোকে পুত্রসম ভালোবাসা, আদর-সোহাগ দিয়ে কোরবানি করতে হবে। পশু কেনার পর তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ও সুন্দর মানের হতে হবে। সব রকমের কষ্টদায়ক পরিবেশ থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয় দিতে হবে। ঈদের দিন প্রভাতে সম্ভব হলে গোসল দেবে এবং ঈদের নামাজের পর অল্প সময়ে সহজভাবে, রশি, ধারালো ছুরি, লোকবল, সুন্দরভাবে মজবুত করে বাঁধাসহ সব রকমের ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করে উচ্চ আওয়াজে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে ধারালো ছুরির দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে তিনটি রগ কেটে কোরবানি সুসম্পন্ন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় ছুরি ধারালো না হওয়ার কারণে অতিরিক্ত কষ্টে পশুটির আত্মবিসর্জন হয়।
যা কখনই উচিত নয় : পশুটি যখন মৃত্যুর সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার শুনতে পায় তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করে এই বলে আত্মতৃপ্তি পায় যে সে আল্লাহর রাহে তাঁর প্রিয় বান্দা কর্তৃক কোরবানি হচ্ছে। ফলে তার কোনো দুঃখ-কষ্ট অনুতাপ অভিযোগ থাকে না বরং সন্তুষ্টচিত্তে সে কোরবান হয়ে যায় এবং তার সম্পূর্ণ প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুনরায় কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া। হাত-পায়ের রগ কর্তন না করা। কোনো ধরনের শারীরিক কষ্ট দ্বিতীয়বার না দেওয়া। মনে মনে ভাবতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যেন আমি আমারই প্রিয় আদরের পুত্রকে নিজ হাতে কোরবানি করছি। হে দয়াময় খোদা আমার কোরবানি কবুল কর, যেমন কবুল করেছিলে ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি।