আলোকিত প্রতিবেদক :

আপনি হয়তো এখন বলতে পারেন একটা দোকান কিভাবে ট্যুরিষ্ট স্পট হয়,আমি বলি হয় । একটা দোকান যখন ইতিহাসের অংশ এবং ইতিহাসের ধারক হয় তখন সেটা ট্যুরিষ্ট স্পটই হয় ।

একজন মানুষের এতগুলো নাম মনে রাখা সম্ভব নয় যত গুলো পন্য এই দোকানে পাওয়া যায়। পীতাম্বর শাহ’র দোকান মূলতঃ ভেষজ ওষুধের দোকান। যেখানে নাই বলতে কিছু নেই। এমনকি সামান্য সুঁই-সুতা থেকে অর্জুনের ছাল, অশোক, ত্রিফলা (আমলকি-হরিতকী-বহেরা), তিতকুটে চিরতা, সুন্দরবনের মিষ্টি মধু , শতমূল, বাঘের তেল, বাঘের চামড়া, বাঘের হাড়, বাঘের দুধ, জিনসেং, ওলট কম্বল, উস্তে, একাঙ্গি, লতাকুস্তুরি, সমুদ্র ফেনা, হরিণের পিত্ত, লোহজারণ, স্বর্ণমাক্ষী, তামাজারণ, অভ্রুজারণ, মুক্তা, দস্তা, নিমতৈল, পদ্মমধু, বিষমধু, ষষ্ঠীমধু, পুষ্টিগোটা, বকুলগোটা, বিজবন্দ, বিজকারক, বনজৈন, বহেড়া, মারজান, হযরত পাথর, মুক্তাদানা, মুক্তাজারণ, তুলসী, বিভিন্ন ধরনের সিন্দুর, চন্দনবীজ, কোরাসিয়া, মুরা মাংসি, অশোক ছাল, অর্জুন, অশ্বগন্ধ, দেশি-বিদেশি অজৈইন, আফিম, ইত্যাদি।মিলবে দূর্লভ ঔষধি গাছের ছাল বাকল। রয়েছে বিয়ে,পূজা,পার্বণ, ঈদ-কোরবানির সরঞ্জামও।

বলা হয়, গুরুজির নির্দেশে ১৮০ বছর আগে পীতাম্বর শাহ ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ১৫-২০ দিন পর চট্টগ্রামে পৌঁছেন। চট্টগ্রামে এসে দোকানটি কিনে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো ১৮০ বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারা একই পদ্ধতিতে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে দোকানটি পরিচালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির গোড়া পত্তনকারী পীতাম্বর শাহ’র চতুর্থ প্রজন্ম।

লোকে বলে সময় পাল্টেছে , পাল্টেছে সবকিছু। কিন্তু পীতাম্বর শাহ’র দোকানের কোনো কিছুই পাল্টেনি। গুরু পীতাম্বর শাহ যেভাবে ব্যবসা শিখিয়ে গেছেন তাদের বংশধররাও এখনো সেভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

দিন বদলের ভীড়ে ব্যতিক্রম নগরীর ১৮০ বছর পুরানো পীতাম্বর শাহ’র দোকান। যেখানে এখনো টিকে আছে হালখাতার ঐতিহ্য। নববর্ষে এখনো এই দোকানে পালন করা হয় হালখাতা উৎসব। বলা যায় বাঙালী ঐতিহ্যের বিলুপ্ত প্রায় অনুষঙ্গ এই হালখাতার শেষ আশ্রয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে অবস্থিত এই পীতাম্বর শাহ’র দোকান।

এ কথা সত্য, হালখাতা হার মেনেছে আধুনিক সফটওয়্যারের কাছে। কিন্তু যে খাতার সাথে বাঙালী ব্যবসায়ীদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, যে খাতা পরিণত হয়েছিলে বাংলা নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতিতে সেই হালখাতার আবেদন কি ভোলা যায়! আর তাইতো পীতাম্বর শাহ’র দোকান এখনও নিভৃতে লালন করে চলেছে হালখাতার ঐতিহ্য।

পীতাম্বর শাহর দোকান
প্রতিষ্টাতা- কুঞ্জলাল পীতাম্বর শাহ “

“চট্টগ্রাম শহরে আশৈশব দেখে আসছি কেউ যদি কোন কিছু খুঁজে হয়রান হতো তবে তাকে রসিকতা করে বলা হতো পীতাম্বর শাহর দোকানে যেতে।

সামান্য সুঁই-সুতা থেকে অর্জুনের ছাল, অশোক, ত্রিফলস আমলকি-হরিতকী-বহেরা, তিতকুটে চিরতা, সুন্দরবনের মিষ্টি মধু, কষটে যষ্ঠী মধু, ময়ুর পাখ থেকে বাঘের দুধ, হরিণের কস্তুরী সব মিলবে এখানে। দুর্লভ ওষুধি গাছ ছাল বাকল। রয়েছে বিয়ে-পূজা-পার্বণ, ঈদ-কোরবানির সরঞ্জামও। কী নেই পীতাম্বর শাহ’র দোকানে। পসারি মাল ছাড়াও হোমিওপ্যাথিক, ওষুধি, আয়ুর্বেদিক, ইউনানী জাতীয় পণ্যের জন্য বিখ্যাত এই পীতাম্বর শাহ’র দোকান। এপার-ওপার দুই বাংলায় সমান খ্যাতি রয়েছে। ঢাকার ওয়ারীতে শাখা অফিস ছাড়া আর কোথাও কোন শাখা নাই। পীতাম্বর সাহার চতুর্থ প্রজন্ম এখন দোকানটি চালান। তিনি জানান গুরুজির নির্দেশে দেড়শো বছরের অধিক আগে পীতাম্বর শাহ ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ১৫-২০ দিন পর চট্টগ্রামে পৌঁছেন। চট্টগ্রামের এসে দোকানটি কিনে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। সবচে অবাক করা ব্যাপার হলো দেড়শো বছর ধরে কিভাবে তারা এত ডাইভার্সিভাই আইটেমের সাপ্লাই চেইন ঠিক রেখেছে!

আসুন তাদের দোকানে সাজিয়ে রাখা কিছু ঔষধি আইটেমের নাম শুনি:

শতমূল, জিনসেং, মুগানি, কস্তুরি, ওলট কম্বল, উস্তে, কুরদুস, উধেসলিব, ওন্নার, উটাঙ্গন, একাঙ্গি, লতাকুস্তুরি, শিমুলমূল, সোনাপাতা, মুরমাক্ষী, রক্তদ্রোন, সমুদ্র ফেনা, হরিতকি, হরিণের পিত্ত, লোহজারণ, স্বর্ণমাক্ষী, তামাজারণ, অভ্রুজারণ, কাজ্জলীজারণ, মুক্তা, দস্তা, প্রবালজারণ, নিমবীজ, নিমতৈল, পদ্মমধু, বিষমধু, ষষ্ঠীমধু, পুষ্টিগোটা, বকুলগোটা, বিজবন্দ, বিজকারক, বনজৈন, বহেড়া, বাঘের তেল, বাঘের চামড়া, বাঘের হাড়, বাঘের দুধ, বাসকপাতা, বাবলাছাল, ভূজকিদানা, ভাংপাতা, ভেরনবীজ, মোথা, ময়ুরপাখা, ময়ুরপুচ্ছ, মারজান, হযরত পাথর, মুক্তাদানা, মুক্তাজারণ, তুলসী, বিভিন্ন ধরনের সিন্দুর, চন্দনবীজ, চন্দনগুঁড়া, দেশি-বিদেশি কর্পূর, শালপানি, জয়তুন তেল, তামার পয়সা, দেশি-বিদেশি নীল, নাগেশ্বর ফুল, ঝিল্লি, চামড়া, হরিটনিক, সাকোস মাছের কাটা, ভারতের জান্দেবেদস্তা, সম্ভেলতিফ, কোরাসিয়া, মুরা মাংসি, অশোক ছাল, অর্জুন, অশ্বগন্ধ, দেশি-বিদেশি আমলকি, দেশি-বিদেশি অজৈইন, আফিম, আমের বিচ, বিভিন্ন ধরনের ধুপ, কোয়াসিয়া, কাঞ্চন অয়েল, কুশুম দানা, কায়াবতি তেল, কডলিভার তেল ইত্যাদি।

চিটাগাং শহরের যে কোন জায়গা থেকে সিএনজিযোগে যেতে হবে বক্সিরহাট বিটে। তারপর যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিবে।

প্রশ্ন হতে পারে একটা দোকান কেমনে ট্যুরিষ্ট স্পট হয়। না এটি তা নয়। তবে একজন ট্রাভেলার জন্মগতভাবে কিউরিয়াস হয়ে থাকে। অনেক কিউরিউসিটির উত্তর এ দোকানে মিলবে।

যেখানেই যান লোকাল মানুষের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে চলুন। তাতে ভ্রমণ আনন্দময় হবে।”

পীতাম্বর শাহ’র দোকানে প্রবেশের আগে বাইরের বারান্দায় চোখে পড়ে সারি সারি সাজানো সব দুর্লভ জিনিসপত্র। যা এখন একেবারেই বিরল। প্রাচীনকালের মানুষ জুতোর পরিবর্তে কাঠের তৈরি খড়ম পরিধানর করতেন। সেই খড়মের দেখা মেলে এখানে। যার প্রচলন এখনকার সময়ে নেই বললেই চলে।

শুধু যে ঐতিহ্যের খড়ম তা নয় এ দোকানে দেখা মেলে প্রতিমার চুল, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পিতৃ-বিয়োগে ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য বাঁশের শলা, তালপাতার পাখা, ঢালা, কুলা, ঝুড়ি ইত্যাদি।

এছাড়াও রন্ধন শিল্পের নানারকম মসলার সমাহার এ দোকানটি। বিশেষ করে চাটগাঁইয়া মেজবানিতে ব্যবহৃত হরেকপদের মসলা পাওয়া যায় পীতাম্বর শাহ’র দোকানে। আজও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মানুষ পীতাম্বর শাহ’র দোকানের মসলার উপর নির্ভরশীল। এ দোকানে ভালো মানের মসলা যেমন পাওয়া যায় তেমনি বিশেষ এক কারণে এখানে মসলা কিনতে ভিড় করেন ক্রেতারা।

সাধারণত আমরা যখন দোকানে কোনকিছু কিনতে যাই তখন দোকানি ঠোঙা বা প্যাকেটসহ পাল্লায় ওজন করে থাকে। কিন্তু পীতাম্বর শাহ’র দোকানের বিশেষ রেওয়াজ হলো এখানে কেবল ক্রয়কৃত জিনিসটুকুই পাল্লায় দেয়া হয়। ঠোঙ্গা কিংবা প্যাকেটের ওজন এখানে করা হয় না। যা আজকালের যামানায় একেবারেই ব্যতিক্রম।

এসব কারণে এ দোকানে মসলা কিনতে ভিড় জমান শতশত ক্রেতা। অনেক ধরণের মানুষও এখানে সদাই করতে এসে দিয়ে যায় ধৈর্যের পরিচয়। বলা হয় যে ভালো জিনিস কিনতে মানুষেরা বহুদূর থেকে এসেও বিরক্ত হন না, বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও পীতাম্বর শাহ’র দোকানে এসে থাকেন তারা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here