মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান,
সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।
সহজ, নির্মোহ, নিভৃতচারী মানুষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সুনীতিভূষণ কনুনগোর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। কিন্তু কোনোভাবেই নিজের ব্যাপারে কথা বলতে চান না তিনি। নিজেকে অখ্যাত ভেবে সারা জীবন সবার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে গেলেন। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় অধ্যাপক কানুনগোর ফিরিঙ্গি বাজারের বাসায় আচমকা হানা দিই। আলাপচারিতার শুরুতেই সাফ জানিয়ে দেন পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে কিছু লিখলে কোনো কথা বলবেন না তিনি। বললাম, আমি তো পত্রিকার লোক নই, আপনার ছাত্র, এমনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি। জানতাম নিজের সম্পর্কে কিছুই বলতে রাজি হবেন না, তাই কায়দা করে তাঁর জ্যাঠা উপমহাদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ড. কালিকারঞ্জন কানুনগো (ক.জ ছধহঁহমড়) সম্পর্কে জানতে চেয়ে গপ্পো জুরলাম। ব্যস জ্যাঠার নাম শুনতেই চোখ দুটো চকচক করে উঠল। একে একে স্মৃতির পাতাগুলো মেলে ধরলেন আমার সামনে। নিজের কথা কিছুই বলেন না। শুধু জ্যাঠামণি আর জ্যাঠামণি । প্রায় দুণ্টার আলাপে বেশির ভাগই ছিল জ্যাঠামণি কে আর কানুনগো আর নিজ গ্রামের প্রখ্যাত গণিতবিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বিভূতিভূষণ দত্তর কথা। তবুও ফাঁকে ফাঁকে খেয়ালী ভঙ্গিতে নিজের সম্পর্কে যা বললেন তার বয়ান তুলে ধরছি:
১৯৩৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ায় সুনীতি ভূষণ কানুনগোর জন্ম। নিজ গ্রামের ড. বিভূতিভূষণ দত্ত হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় পাড়ি জমান তিনি। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ করেন। একজন গবেষক-শিক্ষক হিসেবে ইতিহাসের বহু ঘটনার সাল-তারিখ মনে রাখলেও আত্নভোলা কানুনগো নিজের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর দিনক্ষণ এদিক ওদিক করে ফেলেন। কলকাতা থেকে দেশে ফিরে ১৯৬১ সালে নিজ গ্রামে স্যার আশুতোষ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পড়িয়েছেন। কলেজে পড়ানো অবস্থায় লক্ষ্ণৌতে জ্যাঠা কালিকা রঞ্জন কানুনগোকে চিঠি লিখে ইতিহাস গবেষণা শুরুর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। জ্যাঠামণি ইতোমধ্যে লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। ভাইপোর আগ্রহে সাড়া দিয়ে তিনি গবেষণার বিষয় হিসাবে চট্টগ্রামের ইতিহাস-সাব্যস্ত করে দেন। জ্যাঠামণি না-কি প্রতি মাসে একটি করে চিঠি পাঠিয়েই তাঁর গবেষণার আগ্রহ উসকে দিতেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ‘উৎস-উপাদান’ খুঁজে পাচ্ছেন না উল্লেখ করে চিঠি দিলে না-কি জ্যাঠা ধমকের সুরে উত্তর দিয়েছিলেন যে, কাজের ইচ্ছে থাকলে মেটেরিয়্যালসের কোনো সমস্যা হবে না।
কালিকারঞ্জন কানুনগোর ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হালিমের অধীনে ১৯৬৩ সালে সুনীতিভূষণ আনুষ্ঠানিকভাবে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। এর আগেই তিনি জ্যাঠার সাথে চিঠি বিনিময়ের মাধ্যমে পাওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ কিছুটা এগিয়ে রেখেছিলেন। এ সময় উপমহাদেশের আরেক খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। কানুনগো সাহেবের গবেষণায় সুবিধার কথা বিবেচনা করে ড. করিম তাঁকে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৪ সালের জুন থেকে ১৯৬৫ সালের জুন পর্যন্ত সুনীতিভূষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। এই এক বছরে তিনি তাঁর গবেষণা বিষয়ে প্রচুর উপাদান সংগ্রহ ও তা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন। আবদুল করিম সাহেবের নাম উঠলেই বারবার দুহাত কপালে ঠেকিয়ে শ্রদ্ধা জানান। বলেন, সারা জীবন এই করিম সাহেবের কাছেই সবচেয়ে বেশি ঋণ তাঁর। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র এক বছর শিক্ষকতা করে তিনি তাঁর গ্রামের কলেজে ফিরে আসেন। কারণ জানতে চাইলে বড্ড লাজুক কণ্ঠে জানালেন, ঢাকায় ইতিহাস বিভাগের সবাই ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, বড় বড় পণ্ডিতদের মাঝে নিজেকে তুচ্ছ মনে হতো। হীনমন্যতায় ভুগতেন বলে চাকরি ছেড়ে কলেজে ফিরে আসেন।
ইতোমধ্যে অধ্যাপক আবদুল হালিম পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়লে গবেষণা নির্দেশক পাল্টানো জরুরী হয়ে পড়ে। তিনি তখন ইতিহাসের আরেক দিকপাল অধ্যাপক দানীর সঙ্গে দেখা করে গবেষণার ইচ্ছে প্রকাশ করলে ড. দানী জানান, ‘তোমার চট্টগ্রাম বিষয়ে আমার তেমন কোন পরিষ্কার ধারণা নাই। তুমি অন্য কাউকে খুঁজে নাও।’ এর মধ্যে তিনি থিসিস লেখার কাজ বেশ এগিয়ে নিয়েছিলেন। এবার সাহায্য করার মতো কাউকে না পেয়ে যা লিখেছেন তাই নিয়ে জ্যাঠামণির কাছে লক্ষ্ণ্নৌতে যেতে মনস্থির করলেন। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, সম্ভবত: ১৯৬৫-এর শেষে জ্যাঠার বাড়িতে গিয়ে হাজির হন। চাচা থিসিসের আকার দেখে আঁতকে উঠে বলেন, ‘তোমার এই মহাভারত দেখার সময় আছে আমার ! কালিকারঞ্জন তাঁর স্ত্রীকে বললেন সুনীতির শোবার খাটটা যেন তাঁর খাটের সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। কারণ, কখন কি মনে পড়ে, আবার তা ভুলেও যান। তাই কিছু মনে পড়লেই যেন তা টুকে রাখতে বলতে পারেন। কে আর বাবু টাইপ মেশিনে নিজের লেখা টাইপ করতেন, পাশাপাশি সুনীতি ভুষণের থিসিসের প্রয়োজনীয় সংশোধনী, নোট টাইপ করে দিতেন। থিসিসের প্রথম অধ্যায় গভীর অভিনিবেশসহ দেখে ঠিক করে দেন। বাকি অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে দিক-নির্দেশনা দেন। জ্যাঠামণি তাঁকে আরও কিছুদিন থাকলে গোটা থিসিসটাই দেখে দেওয়ার কথা জানান। কিন্তু নস্টালজিক সুনীতি ভুষণ মাত্র দশ দিন থেকে গ্রামে ফিরে আসেন। তাঁর সারা জীবনের আক্ষেপ কেন আরও কিছুদিন থেকে পুরো থিসিসটাই জ্যাঠাকে দেখালেন না। এ কথা বার বার বলেন আর কপাল চাপড়ান।
১৯৬৬ সালে ড. আবদুল করিম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলে কানুনগো সাহেব তাঁর অধীনে থিসিসের বাকি কাজ শেষ করেন। কিন্তু তাঁর মতে, করিম সাহেব খুব অতিপ্রজ লেখক হওয়ায় ঠিকমতো সময় দিতে পারেননি। যদিও শেষের দিকে তাঁর সম্পূর্ণ থিসিসটাই ড. করিম দেখে প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ঠিক করে দেন।
১৯৬৮-৬৯ সালে পিএইচডির কাজ শেষ হলেও এরপর যুদ্ধ আর নিজের গাফিলতির কারণে সুনীতি ভূষণের ডিগ্রি পেতে ১৯৭৩ সাল হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে ড. করিম তাঁকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে নিয়োগ দেন। টানা ২৬ বছর তিনি বিভাগে কর্মরত থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান। বিরামহীনভাবে লিখে গেছেন, যা এখনো চলমান। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার তাঁর সবচেয়ে প্রিয় স্থান। প্রায় আশির কোঠায় বয়স হলেও এখনো নিয়মিত লাইব্রেরিতে যান।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক কানুনগো জানালেন, এক সময় এই উপমহাদেশে ‘সামপ্রদায়িকতা’ অভিধার সঙ্গে কেউ পরিচিতই ছিল না। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল ধর্মের মূল মন্ত্র-যা মানুষ পালনও করত। কিন্তু এখন সামপ্রদায়িকতা সারা বিশ্বেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে-যা মানব সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, আজীবন সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধু হত্যার ভিতর দিয়ে আবহমান বাংলার রাজনীতির মূল ধারার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বর্তমান রাজনীতিতে কোনো আদর্শ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক স্ত্রী লীনা কানুনগো গত বছর ৬ই ডিসেম্বর মারা যাওয়ায় ড. কানুনগো বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। বড় ছেলেটি ১৪ বছর বয়সে ক্যানসারে মারা যায়। ছোট ছেলে দীপঙ্কর কানুনগো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করে ঐ দেশেই রয়ে গেছে।
অধ্যাপক কানুনগো গান শুনতে ভালোবাসেন। বলেন, গান মানুষকে উজ্জীবিত করে, চিত্ত শান্ত করে।
আজীবন নিবিষ্ট ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক কানুনগো মূলত বর্ণনামূলক ইতিহাস চর্চা করে গেছেন। সম্ভবত তিনিই বাংলাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের উপযোগী সর্বাধিক ইতিহাস গ্রন্থের রচয়িতা । তাঁর সব বই-ই তিনি নিজ খরচায় ছাপিয়েছেন। শুধু ‘কালিকা রঞ্জন কানুনগো ঃ জীবন ও কর্ম’- বইটি এ বছর বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে। কেন নিজের খরচে বই ছাপান জানতে চাইলে বলেন, প্রকাশকেরা বলে তাঁর এসব বই না-কি বাজারে চলবে না। অবৈষয়িক কানুনগো পেনশনের প্রায় সব টাকা খরচ করে গ্রামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করছেন ।
এবি/টিআর