বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত নোবেল পুরস্কার। চলতি মাসেই পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য ও অর্থনীতিসহ ৬টি ক্যাটাগরিতে প্রতিভাবানদের হাতে তুলে দেওয়া হলো এ বছরের নোবেল।

পৃথিবী ও মানবজাতির কল্যাণে নিজ মেধার স্বাক্ষর রাখা প্রতিভাবানরাই এ পুরস্কারের অধিকারী হন। আর সেই মেধাবীদের সাফল্য অনুপ্রাণিত করে গোটা বিশ্বের মানুষকে। ১৯০১ সাল থেকে নিয়মিত রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল প্রবর্তিত এ পুরস্কার দিয়ে আসছে।

এর মাঝে ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার বিশ্ববাসীর মধ্যে বিশেষ কৌতূহলের সৃষ্টি করে। সব জাতি, ধর্মের মানুষই নোবেলের জন্য বিবেচিত হলেও, এ বছরই প্রথম কোনো মুসলিম এ পুরস্কারে ভূষিত হন। বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য এ পুরস্কার পান তিনি।

বিস্মৃতপ্রায় সেই বিজ্ঞানীর নাম আব্দুস সালাম। মৌলিক কণার মধ্যে দুর্বল ও তড়িৎ চৌম্বকীয় মিথষ্ক্রিয়া বিষয়ক তত্ত্বে গুরুত্ব্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পদার্থ বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে এ পুরস্কার পান তিনি।

পাকিস্তানি নাগরিক হলেও ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হয়ে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত ছিলেন বিরল প্রতিভার অধিকারী এ বিজ্ঞানী। এখনও তার নাম উচ্চারিত হয় না পাকিস্তানে। প্রথম মুসলিম হিসেবে নোবেল জয় করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া এ বিজ্ঞানী আজ ইতিহাসেও অবহেলিত।

বিবিসি জানায়, একজন বিজ্ঞানী হয়েও ইসলামের খুঁটিনাটি সব কর্তব্য পালন করতেন বলে নিজ মহলে সামালোচিত ছিলেন সালাম। অপরদিকে আহমেদিয়াপন্থী মুসলিম হওয়ায় অন্য সম্প্রদায়ের মুসলিমরা তাকে অপদস্থ করতো। এরই প্রতিক্রিয়ায় আবদুস সালাম বলেছিলেন, ধর্ম আমার মননে, আর বিজ্ঞান আমার মস্তিষ্কে।

দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা সালাম ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, দেশপ্রেমী ও বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবক। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশে বেড়ে ওঠা গুটিকয়েক মেধাবী শিক্ষার্থীদের একজন, যিনি সে সময় বৃত্তি নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান। কিন্তু, সেখানেও ইংরেজদের নিষ্ঠুর আচরণ ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাকে। কিন্তু, তাতেও থমকে যায়নি এ বিজ্ঞানীর গবেষণা।

অনেক ত্যাগ আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পড়াশোনা শেষ করে অবশেষে নিজ দেশে ফেরেন ক্যামব্রিজে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া আব্দুস সালাম। গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আহমেদিয়াপন্থী মুসলিম হওয়ায় তার নাগরিকত্ব বাতিল করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ১৯৫৩ সালে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় সালামকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও যুক্তরাজ্য তিন দেশই নাগরিকত্ব দেয় তাকে।

এরপর সালাম বিজ্ঞান গবেষণায় মনোযোগ দেন। ইতালিতে গড়ে তোলেন বিজ্ঞান অ্যাকাডেমি। বাকি জীবন বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ালেও শেষ পর্যন্ত থিতু হন যুক্তরাজ্যে। তবে মনেপ্রাণে চাইতেন নিজ দেশে ফিরে যেতে। মৃত্যুর পর পাকিস্তানে কবর দেওয়া হলেও ফলকে লেখা নেই তার সাফল্যের কোনো ইতিহাস।

প্রথম মুসলিম হিসেবে নোবেল পেয়ে বিপুল খ্যাতি ও সম্মানে ভূষিত থাকার কথা ছিল প্রফেসর আব্দুস সালামের। স্বর্ণাক্ষরে তার ঠাঁই হওয়ার কথা ছিল ইতিহাসে। কিন্তু, তার বদলে অসাধারণ প্রতিভাবান এ বিজ্ঞানীর জীবন যেন রচনা করে গেছে নিজ দেশ ও মানবতার এক করুণ ইতিহাস।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here