লিটন দাশ গুপ্ত

(প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক)
রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার খেলা ক্রিকেট। একজন ক্রিকেট অনুরাগী হিসাবে দীর্ঘ সময় ক্রিকেটে দেখেছি, ব্রায়ান লারা’র রানের রেকর্ড ব্রেক করল শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরামের সর্বোচ্চ উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ড ভাঙ্গলো মুত্তিয়া মুরালিধরণ, এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ১০ উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়ল অনিল কুম্বলে কিংবা ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় নিয়ে ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ইত্যাদি আরো কত কি!
সেই ক্রিকেটের ভাঙ্গা-গড়ার রেকর্ড দেখছি এখন নবাগত কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে। সকাল হলে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখি, ২০৩৭ জন মৃত্যুর মধ্যদিয়ে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশ্বে এই ভাইরাস চীন দেশে শুরু হলেও এশিয়ায় মৃত্যু দিকে এগিয়ে আছে ইরান। চীনকে পিছনে ফেলে আরো ৫ টি দেশ এগিয়ে গেল। ২০ হাজার মৃত্যুর রেকর্ড ছুঁয়ে গেল ইতালি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিংবা আক্রান্তের হিসাবে ‘লক্ষ’ ঘর ছুঁয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি আরো কত কি!
বিষয়গুলো অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এই রকম নানা ধরণের রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার দুঃসংবাদ টিভিতে দেখতে হচ্ছে, বেতারে শুনতে হচ্ছে, পত্রিকায় পড়তে হচ্ছে। কারণ নভেল করোনা ভাইরাস মৃত্যুর খেলায় মেতে উঠেছে। আর এটি সংক্রমনের গতি প্রক্রিয়া দেখে মনেপড়ে ইতোপূর্বেকার তথাকথিত মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০, ইউনিপে-টু ইত্যাদির কথা। প্রথমে বাইনারি প্রক্রিয়ায় দুইজন সদস্য অর্ন্তভূক্ত করা, এরপর ডান পক্ষে ও বাম পক্ষে জ্যামিতিক হারে সেই ২ জন থেকে ৪, ৮, ১৬, ৩২….. এই ভাবে বাড়তে থাকা!
এইদিকে এখনো পর্যন্ত বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থাপত্রে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘরের মধ্যে অবস্থান করা ইত্যাদি ছাড়া নতুন কিছু আসেনি। কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ রূপ দেখে আমরা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধান পর্যন্ত শংকিত। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প পূর্ভাবাস দিয়েছেন, সেই দেশে দুই লক্ষ চল্লিশ হাজারের মত মানুষের মৃত্যু ঘটবে নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে। জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলী ম্যার্কেল বলেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম পৃথিবী এত বড় মহাসংকটে পড়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান, রাষ্ট্র প্রধান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতি সংঘের মহাসচিব ভয়াবহতা সম্পর্কে সর্তক করে দিয়ে যাচ্ছে। যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি মত দেশ গুলোতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে দেখে। অনেকেই ধারণা করছে এই ভাইরাস ইউরোশিয়া হয়ে আফ্রিকা মহাদেশে মহামারি ছড়িয়ে দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে অবস্থান করবে। এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। কারণ সংক্রমণের গতি, প্রতিরোধ করার সক্ষমতা কিংবা প্রতিষেধক আবিষ্কার ও বাজারজাতের জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে। যদিও বিশ্বে এই মুহুর্তে করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্যে সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা চলছে। কারণ এটার সাথে রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক দক্ষতা আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। এই দিকে চীন প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্যে এই ভাইরাসের জেনেটিক কোড খুঁজে পেয়েছে। এটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় হবার সত্তে¡ও প্রথম দিকে নিজেদের বেগতিক ও অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা দেখে বিভিন্ন দেশকে জানিয়ে দিয়েছিল। তবে এটাও ঠিক জেনেটিক কোড বা ভাইরাসটির জিনগত পরিবর্তন হলে, আগামীতে দ্রæততার সাথে কম সময়ে প্রতিষেধক আবিষ্কার কঠিন হবে। এই অবস্থায় বিভিন্ন দেশ লকডাউন আর শাটডাউন মেয়াদ বাড়িয়ে আর কত দিন থাকতে পারবে? ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তিন মাস পর্যন্ত নিজেদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই ভাবে আর কয়দিন, কয় সপ্তাহ, কয় মাস চলতে পারবে। অনেক দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ, স্থলপথে সকল ধরণের গাড়ির চাকা ঘুরছেনা, আকাশপথে প্রায় সকল প্রকার বিমান উড়ছেনা, পানিপথে সকল ধরণে জলযান ভাসছেনা। রেলপথ বন্ধ, সরকারি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বেসরকারি স্বায়ত্বশায়িত প্রতিষ্ঠান বন্ধ, মিল কলকারখানা, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ, ব্যবসা বাণিজ্য দোকানপার্ট বন্ধ, আমদানী রপ্তানী বন্ধ, সামাজিক অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিগত কার্যক্রম বন্ধ; হ্যান্ডশেক কোলাকুলি বন্ধ, এমন কি একজন অন্যজনের কাছে গিয়ে কথা বলাও বন্ধ! বাড়ির গেইট বন্ধ, ঘরের দরজা বন্ধ, হৃদয়ের দুয়ার বন্ধ, আন্তরিকতা বন্ধ, শুধু বন্ধ আর বন্ধের মধ্যে একপর্যায়ে এখন দম বন্ধের উপক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র প্রধান টেড্রোস অ্যাধনম হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, কোন দেশ এই বন্ধ অবস্থা (লক ডাউন) থেকে সহসা যদি মুক্ত হবার চেষ্টা করে, তবে এর পরিনাম হবে আরো ভয়াবহ ও সুদূর প্রসারী। অন্যদিকে এই বন্ধ যদি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, তাহলে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিজীবনের কায়ামন কোন পর্যায়ে যেতে পারে অনুমান যোগ্য। সেই অনুমানের ভিত্তিতে বলতে চাই আমাদের জন্যে নতুন এক পৃথিবী হাতছানি দিচ্ছে।
করোনা প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুরুতে আমরা বুঝতে পারিনি চীন এত দ্রæততার সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে। একইভাবে ভাবতেও পারিনি যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ফ্রান্স ইতালি, স্পেন এত দ্রুত সংক্রমিত হয়ে অসহায়ত্ব বরণ করবে। করোনার এমন অনেক বিষয় আমাদের ভাবনার সাথে মিলছেনা। তাই দেখা যাচ্ছে যাদের হুকুমে যুদ্ধ শুরু হয়, আর হুঁশিয়ারিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, তারাও আজ করোনা যুদ্ধে অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। যদিও সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে এইসব দেশ প্রস্তুত, কিন্তু করোনা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে কোন দেশকে পাওয়া যাচ্ছেনা। যে সব দেশ বিশ্ববাসীকে সামরিক শক্তি দিয়ে বিশ্বস্ত করে নিত, তারা কিন্তু করোনা নিয়ে বার্তা দিয়ে বিশ্ববাসীকে আশ্বস্ত করতে পারছেনা। এবার হয়ত ঐ দেশগুলো অনুধাবন করতে সক্ষম হবে, আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বা পারমানবিক বোমার তৈরীর চেয়ে হাসপাতাল নির্মাণ জরুরী। পৃথিবীর সকল মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপেক্ষা করে নিজ স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার মত চিরাচরিত ঐতিহ্য কতটুকু পরাজয় আনতে পারে এটাই তার নৈতিক ব্যর্থতার প্রমাণ। উন্নত রাষ্ট্রের শক্তি পরীক্ষায় করোনা শুধু প্রমাণিত করে ক্ষান্ত হয়নি, পৃথিবীর সকলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে কভিড-১৯ নামক নব সৃষ্ট ভাইরাস। ধারণা করা হচ্ছে, এই চ্যালেঞ্জে পাল্টে যাবে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট। যেভাবে পাল্টে গিয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীতে রেনেসাঁর ফলে বিশ্বপট; উত্থান ঘটেছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার এক নতুন পৃথিবী। কিংবা ষোড়শ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার এক ধরণের ফাটল এনে জেগে উঠেছিল আবার নতুন শৈল্পিক বিশ্ব। যার ফলে মানুষের চেয়ে মেশিন বড় হয়ে দেখা দেয়। সভ্যতা উত্তপ্ত হয় শিল্পের উত্তাপে। আবার সপ্তদশ শতাব্দীতে ঘটে ফরাসী বিপ্লব। পতন হয় জাজক সম্প্রদায় আর শুরু হয় সা¤্রাজ্যবাদ। প্রবেশ করে মানুষ অন্য এক পৃথিবীতে। যে পৃথিবী ধীরে ধীরে মানুষের কাছে চলে আসে, আর মানুষ চলে যেতে থাকে মানুষ থেকে দূরে, ছুটতে থাকে অর্থের পিছনে।
অতঃপর উনিশ শতকে দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ আর স্প্যানিশ ফ্লু’র মহামারিতে বৈশ্বিক চিত্র পাল্টে গিয়েছিল; পেয়ে যায় আবার এক নতুন প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবী। যে পৃথিবীর পরাশক্তি আর অক্ষশক্তি ভেদাভেদ ভুলে বিশ্বকে অগ্রসর করতে চেয়েছিল। শান্তি ও স্বস্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল মানব সভ্যতা। সম্মিলিত প্রয়াসে সৃষ্টি হয়েছিল জাতিসংঘ।
এইভাবে পুরানো পৃথিবীর দিকে তাকালে, বারে বারে একটি অনিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর অতীত ইতিহাস বিশ্লেষণ করে তাই বলা যায়, আমরা আবারো এক নতুন পৃথিবী পেতে যাচ্ছি। যেখানে সর্বক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন আসবে; যা কয়েক বছর পর লক্ষ্য করতে পারবো, কয়েক দশক পর এর সুফল কিংবা কুফল পাব, কয়েক শতক পর ইতিহাসে হয়ত আমাদের নিয়ে পড়বে, কোন এক নতুন পৃথিবীর মানুষ।
যদিও আমরা এখনো সেই পুরানো পৃথিবীর অপেক্ষায় আছি, যে পৃথিবীতে আবারো মাস্ক খুলে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো। যে পৃথিবীতে কাছে এসে পাশে বসে মন খুলে কথা বলতে পারবো। যে পৃথিবীতে সেই চিরচেনায় চির ঐতিহ্যে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলির পর বলতে পারবো, কেমন আছ বন্ধু কত দিন দেখিনি তোমায়! হয়ত সেই আশা-ভরসা হবে সুদূর পরাহত, যদি উল্লেখিত ইতিহাসের ধারা পূর্ববর্তী নিয়মে সঠিক পথে চলে।

বি:দ্র: লেখাটি 2সপ্তাহ খানেক আগে প্রেরিত, তাই করোনার সম্পর্কিত মৃত্যুর তথ্য উপাত্ত সপ্তাহ খানেক আগের কথা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here