দেবাশীষ বড়ুয়া রাজু :

আশ্বিনে রাঁধে, কার্তিকে খায়/যেই বর মাগে, সেই বর পায়’। সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই প্রবচন। আশ্বিন সংক্রান্তির রাতে সারারাত জেগে বিশেষ খাবার তৈরি করেন বাড়ির নারীরা। এর মধ্যে অন্যতম গুড়মিশ্রিত নারিকেল। কার্তিকের সকালে সেই নারিকেল ও বাংলা কলা দিয়ে পূজায় নিবেদন করা পান্তা ভাত খাওয়া হয়।
শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) এই পার্বন উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিয়েছেন প্রস্তুতি। পূজার উপকরণ কলাপাতা, দূর্বা, পাটকাঠি, চাল, নারিকেল ও কলা, রান্নার নতুন ডেকচি সংগ্রহ করেছেন পূজার্থীরা।
আশ্বিন মাসের শেষ দিন ও কার্তিক মাসের প্রথম দিন ঘিরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে জলবিষুব সংক্রান্তি পালন করা হয়। এই সংক্রান্তি অশ্বিনী কুমারের ব্রত বা ‘ব্রতের ভাতের পূজা’ নামেও পরিচিত।

পঞ্জিকা মতে, শুক্রবার ২৯ আশ্বিন। এদিন অমাবস্যা তিথি, যা থাকছে রাত ২টা ১৭ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড পর্যন্ত।

এর পরেই মলমাস শেষ। ব্রতের ভাত রান্না ও পূজার ক্ষণ সম্পর্কে পণ্ডিত অমল চক্রবর্তী বলেন, মলমাসের মধ্যে পূজার বিধান নেই।

মলমাস নিবৃত্তি বা শেষ হলেই পূজার আয়োজন করা যাবে। সেই হিসেবে শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) ব্রতের ভাত রান্না করতে হবে। পরদিন শনিবার (৩০ আশ্বিন) মহাদেব ও অশ্বিনী কুমারদ্বয়ের পূজা হবে এবং রোববার (১ কার্তিক) ব্রতের ভাত গ্রহণ করবেন পূজার্থীরা।

জানা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উপোস থেকে অশ্বিনীকুমারের ব্রত পালনের রেওয়াজ নেই। ভক্তি সহকারে ব্রতের ভাত খাওয়ার ফলে রোগমুক্তি হয় বলে বিশ্বাস করেন সনাতন সম্প্রদায়।

সনাতনী ইতিহাস মতে, স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনী কুমারদ্বয় সূর্যদেব ও সংজ্ঞা’র পুত্র। অভিশাপগ্রস্ত সংজ্ঞা জগজ্জননী পার্বতীর কাছে নিজের দুর্দশা থেকে মুক্তি চাইলে পার্বতী এক মুষ্টি চাল দিয়ে তাকে বলেছিলেন-আশ্বিন মাসের শেষ তারিখ পূর্বরাত্রে শেষ দিবস রেখে এই চাল ভক্তিপূর্বক রন্ধন শেষে মহাদেবের অর্চনা করতে হবে এবং কার্তিক মাসের ১ম দিবসে সেই অন্ন ভক্ষণে মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সে নিয়ম মেনে রোগ ও অভিশাপমুক্ত হয়েছিলেন দেবি সংজ্ঞা।

অশ্বিনী কুমারদ্বয় হলেন- নাসত্য ও দস্র। ঋগ্বেদ এবং সংস্কৃত সাহিত্যেও তাঁদের নাম এসেছে। মহাভারতের আদিপর্বের পৌষ্যপর্বাধ্যায়ে উপমন্যোপাখ্যানে দেব-চিকিৎসক হিসেবে তাঁদের ভূমিকার কথা জানা যায়।

কার্তিক একসময় ছিল অভাবের মাস। সেই মাসের প্রথম দিনের সকালে সন্তানকে ভালোমন্দ খাইয়ে মায়েরা আশা করতেন- ‘পুরো বছরটা ভালো যাবে, সন্তান থাকবে দুধে ভাতে। ’

চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সময়টাতে ১৩/২১ বেজোড় সংখ্যার চাল-ডাল, শাপলার ডগা, কাচা কলা, পেঁপে ও নানান সবজি মিলিয়ে রান্না করা হয়। মোমবাতি বা কুপির আলোকশিখার ওপর কলাপাতা রেখে দেওয়া হয়। সকালে কলাপাতায় জমে থাকা কালি ছোটদের কপালে টিপ আকারে লাগিয়ে দেওয়া হতো, যেন কারও খারাপ দৃষ্টি না পড়ে। কালক্রমে এসব সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তির পথে।

অশ্বিনী কুমারের ব্রত উপলক্ষে গত কয়েকদিন ধরে নগরে নারিকেল ও গুড়ের জমজমাট বিকিকিনি হয়েছে। দোকান-রাস্তার পাশে ভ্যানগাড়িতে বিক্রি হয়েছে নারিকেল ও বাংলা কলা। ছোট-বড় আকারের নারিকেল ৩৫-৫০ টাকা, গুড় কেজিপ্রতি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলে জানান দোকানীরা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here