আশুরার প্রেক্ষাপট: কিভাবে মহানবীর (সা) কথিত 'উম্মতের' হাতেই শহীদ হন ইমাম হোসাইন (আ) ?

কীভাবে নবীর (সা.) উম্মতই নবীর (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো (!)? -এ জিজ্ঞাসা সব যুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আর এ ধরনের প্রশ্ন জাগাটাও খুব স্বাভাবিক।কারণ, ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়, এ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে বড়ই অদ্ভুত মনে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়।

আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) কথিত উম্মত যারা রাসূল এবং তাঁর বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের (সা.) সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সা.) সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ (সা.)মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!

এই সেই স্থান যেখানে বেহেশতি যুবকদের অন্যতম সর্দার ও শহীদদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.)’র পবিত্র মাথাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল মুসলমান নামধারী একদল জানোয়ার 

মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-

“ তারা মুসলমান হয়নি, ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”

(কারবালায় ইমামের পক্ষে প্রায় ১০০ জন ও বিপক্ষে ইয়াজিদ বাহিনীর প্রায় ২০-৩০ হাজার সেনা সমাবেশের আর্ট ছবি) 

[কারবালা ময়দানের এখানেই ছিল ইমাম হুসাইনেরর (রাদি.)’র একমাত্র জীবিত পুত্র ও নতুন ইমাম হযরত জাইনুল আবেদীন (রাদি.)’র তাবু। অসুস্থতার কারণে তিনি কারবালার যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর বেঁচে যাওয়াটাও ছিল বিস্ময়কর এবং অলৌকিক]

কয়েক যুগ আগের কারবালা 

তিল্লায়ে জাইনাব: একটি উঁচু স্থান যেখানে দাড়িয়ে ইমাম হুসাইন (রাদি.)’র বোন হযরত জাইনাব (রাদি.)’র কারবালার  অসম-যুদ্ধ দেখছিলেন

দামেস্কের জাইনাবিয়া মসজিদ ও হযরত জাইনাব (রাদি.)’র পবিত্র মাজার (পুরোণো ফাইল ছবি) 

বর্তমান যুগে কারবালায় ইমাম হুসাইন (রাদি.)’র ও পাশেই তাঁর সৎ ভাই ও অন্যতম সেনাপতি আবুল ফজল আব্বাসের পবিত্র মাজার

 নাস্তিকতা এবং খোদাদ্রোহিতাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এসব কালজয়ী মহা পুরুষদের মূল উদ্দেশ্য। আর নাস্তিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বস্তুগত সাজ-সরঞ্জাম না হলেও চলে। কারণ,স্বয়ং আল্লাহই তাদের সহায়। তাই ইমাম হোসাইন (আ.)ও উমাইয়া খোদাদ্রোহিতা এবং ইয়াজিদী বিচ্যুতিকে ধূলিসাৎ করে দেবার জন্যেই একবারে অসহায় অবস্থায় পড়েও বিদ্রোহে নামেন। প্রকৃতপক্ষে তার এ পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলদেরই (আ.) অনুকরণ। বুদ্ধিজীবীদের মতে,বিদ্রোহ তখনই মানায় যখন বিদ্রোহীদের অন্ততপক্ষে সমান সাজ-সরঞ্জাম এবং শক্তি থাকে। কিন্তু,ঐশী-পুরুষদের বেলায় আমরা এই যুক্তির কোনো প্রতিফলন দেখি না। বরং তারা সবাই একবারে খালি হাতে তৎকালীন সর্ববৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আ.)ও এ নিয়মের ব্যতিক্রম নন। তাছাড়া ইমাম হোসাইন (আ.) যদি সেদিন ইয়াজিদ বাহিনীর সমান এক বাহিনী নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতেন তাহলে তার এ অসামান্য বিপ্লব ঐশী দ্যুতি হারিয়ে অতি নিষ্প্রভ হয়ে পড়তো। এই দর্শন প্রতিটি ঐশী বিপ্লবের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল।

মানব সমাজে সংঘটিত অজস্র বিপ্লবের মধ্যে ঐশী বিপ্লবকে পৃথক মনে করার দুটি মাপকাঠি রয়েছে:

এক . ঐ বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিচার। অর্থাৎ এসব বিপ্লব মনুষ্যত্বকে উন্নত ও উত্তম করতে,মানবতাকে মুক্তি দিতে,একত্ববাদ ও ন্যায়পরায়ণতাকে রক্ষা করতে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারের মূলোৎপাটন করে মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্যেই পরিচালিত হয়। জমি-জায়গা বা পদের লোভে কিংবা গোষ্ঠীগত বা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে নয়।

দুই . এসব বিপ্লবের উদ্ভব হয় স্ফুলিঙ্গের মতো। চারদিকে যখন মজলুম-নিপীড়ন এবং অত্যাচার ও স্বৈরাচারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারের বুক চিরে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে এসব বিপ্লব। চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মানুষের ভাগ্যাকাশে আশার দীপ জ্বালিয়ে দেয় এসমস্ত ঐশী বিপ্লব। এই চরম দুর্দিনে মানবতাকে মুক্তি দেয়ার মতো দূরদর্শিতা একমাত্র ঐশী-পুরুষদেরই থাকে। কিন্তু,সাধারণ মানুষ একবারে হাল ছেড়ে দেয়-এমনকি কেউ প্রতিকারে উদ্যোগী হলেও তারা তাকে সমর্থন করতে চায় না। এ ঘটনা আমরা ইমাম হোসাইনের (আ.) বিপ্লবের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। তিনি যখন ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তখন সমসাময়িক তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এটাকে অবাস্তব ব্যাপার বলে মনে করল। এ কারণে তাদের অনেকেই ইমাম হোসাইনের (আ.) সাথে একাত্মতা প্রকাশে বিরত থাকে।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (রাদি.) ভালভাবে জানতেন যে, এ মুহূর্তে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তাই অন্য কারও সহযোগিতা থাকবে কি-না সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নবী-রাসূলদের মতো নিজেই আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে উঠলেন। হযরত আলী (রাদি.) বনী উমাইয়াদের ধূর্তামি সম্পর্কে বলেন :

‘‘ তাদের এ ধোঁকাবাজি নিরেট ও অন্ধকারময় প্রতারণা।’’

তাই ইমাম হোসাইন (রাদি.) এই অন্ধকার থেকে উম্মতকে মুক্ত করার জন্যে ইতিহাসে বিরল এক অসামান্য ও অবিস্মরণীয় বিপ্লবের পথ বেছে নেন।

সূত্র:  ‘কারবালার কালজয়ী বিপ্লব’ (সংকলক: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here