প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় মক্তবে। একই উপজেলার খরণদ্বীপ নিবাসী প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন মাওলানা সৈয়দ আতহার আলীর তত্ত্বাবধানে জামাতে পাঞ্জুম পর্যন্ত চট্টগ্রাম মোহছেনিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি রাজশাহী মাদ্্রাসায় জামাতে উলায় অধ্যয়ন করেন। অতঃপর কলিকাতা মাদ্রাসায়ে আলীয়া থেকে সর্বশেষ পরীক্ষায় ১২৯৫ হিজরী সনে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হন।
মাওলানা চরণদ্বীপী ১২৯৬ হিজরী সনে কলিকাতা আলীগড় জামেউল উলুম মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে যোগদান করেন। সেখানে শিক্ষকতাকালীন সময়ে ১২৯৮ হিজরী সনে রাসূলে করীম (দ.) কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হন। তৎকালীন কলিকাতা মাদ্রাসায়ে আলিয়ার যুগশ্রেষ্ঠ ও সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, অলিয়ে কামেল মাওলানা শাহসুফি ছফিউল্লাহ (রহ.) স্বপ্নের ব্যাখ্যা দান করেন। ওই বছরেই শিক্ষকতার পেশা ইস্তফা দিয়ে নিজ জন্মভ‚মি বোয়ালখালীর চরণদ্বীপ গ্রামে চলে আসেন। ইতোমধ্যে বাংলার জমিনে একমাত্র প্রবর্তিত তরিকা ‘মাইজভাÐারী তরিকা’র মহান প্রবর্তক হযরত গাউসুলআজম শাহ আহমদ উল্লাহ মাইজভাÐারী (ক.) [১৮২৬-১৯০৬] কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মাইজভাÐার দরবার শরীফে গিয়ে গাউসুল আজম মাইজভাÐারীর ফয়জে ইত্তেহাদীর বরকতে অভিষিক্ত হন।
একজন ¯্রষ্টানুরাগী মুমিন-মুসলমান যখন একজন পীরের কাছে গিয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে মুর্শিদের চরণে নিবেদন করেন তখন তাঁকে বলা হয় মুরিদ। সাধারণত এটি পীর-মুরিদ সম্পর্ক। মাওলানা শাহসুফি শেখ অছিয়র রহমান ফারুকী চরণদ্বীপি (ক.) ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি প্রচলিত ধারার সাধারণ কোন মুরিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুরাদ। স্বয়ং গাউসুলআজম মাইজভাÐারী কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাঁরই মহিমান্বিত মুরাদ হওয়ার মধ্য দিয়ে মাওলানা শাহ চরণদ্বীপীর আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার অভিষেক। যাঁর বহিঃপ্রকাশ স্বয়ং গাউসুলআজম মাইজভাÐারীর ইত্তেহাদী গাউছিয়তের ফয়েজ বরকত লাভের মাধ্যমে তাঁরই অবয়ব প্রাপ্তি এবং প্রথম ও প্রধান খলিফার পদমর্যাদায় ভ‚ষিত হন। ১৮৮৫ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ছবিযুক্ত ‘পূর্ণ ষোল আনা’ এক টাকার একটি রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে গাউসুল আজম মাইজভাÐারী তদীয় আধ্যাত্মিক উত্তরসুরী মাওলানা শাহ চরণদ্বীপীকে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনয়ন ও গদীতে বসার হুকুম প্রদান করেন। বায়াত গ্রহণের পর মাওলানা শাহসুফি শেখ অছিয়র রহমান চরণদ্বীপী (ক.) তাঁর সমগ্র জীবনসত্তা দিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। মুর্শিদ করীমের ইঙ্গিতে মসজিদে ইবাদত বন্দেগী এবং আউলিয়ায়ে কেরামের মাজার জিয়ারতে রত থাকতেন। এ সময়কালে প্রতিদিন এক খতম কোরান শরীফ তেলাওয়াত, রাতে নফল ইবাদত ও তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। তিনি সামান্য সময় ঘুমাতেন। অল্প আহার করতেন এবং বেশিরভাগ সময় রোজা রাখতেন। কোন কোন সময় পাঁচ/সাত দিন পর্যন্ত অনাহারে থেকে দাঁড়ানো অবস্থায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আবার কখনো পাহাড়-পর্বতে, বন-জঙ্গলে অবিরাম রিয়াজত করতেন। সীতাকুÐ পাহাড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, মায়ানমারের আকিয়াব পাহাড়, আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড় এখনো তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার স্মৃতি ধারণ করে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ওই সময়কালে তাঁর অসংখ্য কারামত প্রকাশ পায়।
রেয়াজতের সফর ও কঠোর ইবাদত বন্দেগীতে স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে গেলে পিতার ইচ্ছা ও তত্ত¡াবধানে সংসার জীবন শুরু করেন। বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল নিবাসী মৌলভী সৈয়দ সলিম উল্লাহর কন্যা মোহমেনা খাতুনের সাথে শাদী মোবারক সুসম্পন্ন হয়। দুই কন্যা সন্তান জন্মদানের পর মোহমেনা খাতুন ইন্তেকাল করলে পরবর্তী সময়ে চরণদ্বীপ নিবাসী হাজী দায়েমুল্লাহ সওদাগরের কন্যা বেগমা খাতুনকে শাদী করেন। মুহতারামা বেগমা খাতুনের গর্ভে ৬ পুত্র ও ৪ কন্যার জন্ম হয়। বড় ছাহেবজাদা মাওলানা শেখ আবুল বশর ফারুকী (রহ.) ও মেঝ ছাহেবজাদা মাওলানা শেখ আহমদ খায়রুল বশর ফারুকী (রহ.) দুজনেই ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ অলিয়ে কামেল।
আল্লামা শাহসুফি শেখ অছিয়র রহমান চরণদ্বীপী (ক.) তাঁর বেলায়তী করুণাধারায় হেদায়তের আলোতে অনেক অখ্যাতকে খ্যাতনামা করেন। যোগ্যতাসম্পন্ন গুণীজনকে যোগ্যতানুযায়ী খেলাফত দান করে বেলায়তের বিভিন্ন স্তরে উন্নীত করে সর্বমোট ৯৫ জনকে ‘অলিয়ে কামেল’ বানিয়েছেন। এ মহান অলীয়ে কামেল ৬৮ বছর বয়সে ১৯২০ সালের ২৯ আগস্ট মোতাবেক ১২ জেলহজ্ব, ১২ ভাদ্র, শনিবার সকাল ৮ ঘটিকায় বেছাল বরণ করেন। এ বছর (২০২০ সালে) গাউসুল আজম মাইজভাÐারীর প্রথম ও প্রধান খলিফা মাওলানা শাহে চরণদ্বীপীর ওফাত শতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক