হাজী এম, নুরুল হক (এম এ)

সম্ভবতঃ ১৯১৭/১৮ ইংরেজী সনে আমার জন্ম। আমি আমার পিতার সাত সন্তানের ষষ্ঠ সন্তান। আমার পিতা মরহুম ফজলুর রহমান মােক্তার। তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের জন্য সরকার তাঁকে স্বর্ণপদক ও সনদ দান করেন। তিনি বাংলা, গণিত ও সংস্কৃতে বিশেষ বুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের সম্বন্ধে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ ১৯৫৩ ইংরেজীতে তার বাড়ীতে আমাকে বলিয়াছিলেন। আমি সাহিত্যবিশারদ হইলে কি হইবে আপনার পিতা ছাড়া এদেশে আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ পুঁথির বিশদ ব্যাখা করার মতাে লােক কেহ আছে বলিয়া আমার জানা নেই। আমিতাে তাঁর নিকট কিছুই নই।’ তাঁর পান্ডিত্যের জন্য তিনি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং তখনকার পন্ডিত লােকেরা তাহাকে বিশেষ ভয়ের চোখে দেখিতেন। মুসলমানদের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি তৎকালীন নর্মাল থার্ড ইয়ার পাশ ছিলেন। এজন্য সরকার তাহাকে একমাত্র মুসলমান হিসাবে চট্টগ্রাম জিলা শিক্ষা পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। কিন্তু তিনি সরকারী চাকুরী ত্যাগ করিয়া আইন-ব্যবসা আরম্ভ করেন। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার অগ্রদূত হিসাবে আমাদের সকল ভাইকে শিক্ষা প্রদানে কার্পন্য করেন নাই। বৃদ্ধ বয়সে তাহার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল না থাকায় আমার শিক্ষাদীক্ষায় আমাকে বিশেষ সুযােগ সুবিধা দিতে পারেন নাই। তথাপি স্থানীয় উত্তর ভূষী মধ্য ইংরেজী স্কুল হতে আমাকে নিয়া ১৯২৪ (ইং) সালের জানুয়ারী মাসে চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেনীতে ভর্তি করাইয়া দেন। আমার শিক্ষাদীক্ষার ব্যয়ভার বহন করা কষ্টকর ছিল বলিয়া অনেক সময় আমাকে অন্যত্র গৃহশিক্ষক হিসাবে থাকিতে হইয়াছিল। স্কুলে আমি বিনা বেতনে পড়িতাম এবং ১৯৩২ (ইং) সনে প্রথম বিভাগে প্রবেশিক্ষা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সেই বছরেই চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে ভর্তি হই। সেখানে শিক্ষকদের অনুকম্পায় সরকারী বৃত্তি লাভ করি। কিন্তু হঠাৎ ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। মস্তিষ্কের অস্থিরতাজনিত রােগে আক্রান্ত হইয়া বহুদিন যাবত কলেজে উপস্থিত থাকা সম্ভব হইয় উঠে নাই। তথাপি প্রিন্সিপাল এ.কে. চন্দ, পদ্মিনীভূষণরুদ্র, খান বাহাদুর মােহাম্মদ হাসান, করুনাময় খাস্তগীর এবং ডঃ সুবােধ সেনগুপ্ত (এম, এ, পি. এইচ ডি, এস, পি. এইচ. ডি ইত্যাদির অপার অনুগ্রহ ও কৃপায় ১৯৩৪ (ইং) সনে আই.এ. এবং ১৯ ৩৬ সনে বি.এ. পাশ করি। আমার শিক্ষাজীবনে আমি বিশেষভাবে তাদের কাছে ঋণী। ডঃ সেনগুপ্ত প্রায় সময় আমাকে আর্থিক সাহায্য করিতেন। যিনি আমার পাঠ্যজীবনে সাধারন সাহায্য করিতে পারিয়াছিলেন, তিনি আমার বড় ভাই জনাব সােলতান আহমদ। তিনি বার্মায় সামান্য বেতনে চাকরী করিতেন। ছােট বেলা হইত উচ্চ শিক্ষা লাভের যে প্রগাঢ় ইচ্ছা উদ্দীপনা ছিল তাহা কোনদিনও শ্লথ হয় নাই। ছােটবেলা হইতে আমার স্বর্গীয় মাতা পেয়ারজান সদাসর্বদা আমাকে উৎসাহিত করিতেন। তাঁহার উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কঠোর শাসনের মধ্যেই আমার উচ্চশিক্ষা লাভের আকাঙখা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। তিনিই সর্বপ্রথম এতদা অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের আমাদের দেউড়ী ঘরে আরবী শিক্ষা দিতেন। ইহার জন্য সরকার তাঁহাকে মাসিক তিনটাকা করে পারিশ্রমিক দিতেন। ক্রমে উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রবল আকাঙ্খা আমাকে পাগল করিয়া তুলিল। তাই স্থানীয় জমিদার অন্নদা চরন চৌধুরী ও হাজী জিন্নাত উল্লাহ সাহেব হইতে সামান্য কিছু টাকা ধার নিয়া ঢাকায় চলিয়া আসি। তখন আমার বড়ভাই সােলতান আহম্মদ আমার জন্য পঞ্চাশটি টাকা পাঠান। ইহার দ্বারা আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী ও আইন বিভাগে ভর্তি হই সত্য তবে অর্থাভাবে ও অনটনে অধিক অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হইয়া উঠে। এসময় আমার সহপাঠী অধ্যাপক আসহাবদ্দীন এম. এ. আমাকে তাঁহার সাথে ঢাকা মুসলিম হলে রাখেন। তখন চট্টগ্রামবাসী মৌলভী আবুল হাসেম সাহেব আমাকে একটি গৃহশিক্ষকতার ব্যবস্থা করিয়ে দেন। তখন তিনি ঢাকা কলেজিয়েট হাইস্কুলের আরবী শিক্ষক ছিলেন। চট্টগ্রামে আমার শিক্ষাসাথী জনাব তােফায়েল আহমদ এম. এ. জনাব আব্দুস সালাম, জনাব ছিদ্দীক আহমেদ চৌধুরী আমাকে যথাসম্ভব আর্থিক সাহায্য দিয়া কোনরকমে টিকাইয়া রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডঃ মােহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ মাহমুদ হাসান ডি. লিট. ইত্যাদি মহানুভব ব্যক্তিদের সুনজর না থাকিলে আমার শিক্ষার দরজা তখনই বন্ধ হইয়া যাইত। এই অবস্থায় আমার ভাগ্য পরীক্ষা করি এবং দুবার বি. সি. এস. পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। কিন্তু সে যুগের বিরাট প্রতিযােগীতার মুখে টিকে থাকা অসম্ভব হইয়া পড়ে। ডাক্তারী ও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আমি অযােগ্য প্রমানিত হই। ইহার জন্য আমাকে এম. এ. পরীক্ষায় একবছর পিছাইয়া যাইতে হয়। অতএব আমি ১৯৩৯ ইং সনে ইংরেজীতে এম. এ. পাশ করিয়াই ঢাকা হতে কলিকাতা চলে যাই। তথায় তদানীন্তন চট্টগ্রাম জিলা প্রশাসক জনাব নিয়াজ মােহাম্মদ খান চট্টগ্রামবাসী আসাম বেঙ্গল পােস্টমাস্টার জেনারেল জনাব ফজলুর রহমান ও তৎকালীন শিপিং মাস্টার বাংলাদেশের সাবেক গভর্ণর জনাব জাকির হােসেন সাহেবদ্বয়কে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে একটি চাকরি দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া সত্ত্বেও কোন কাজে আসে নাই। জনাব নিয়াজ মােহাম্মদ তাঁহার অফিসে একটি ভাল পােস্ট দেওয়ার জন্য ঢাকা হইতে আমাকে টেলিগ্রাম দিয়া নিয়াছিলেন সত্য কিন্তু ঐ চাকরীর জন্য তদানীন্তন মন্ত্রী সন্তোষ বােসের শালা প্রার্থী থাকাতে আমাকে দিতে পারেন নাই এবং আমাকে পূর্বোক্ত পদের নীচের পদটি নিতে অনুরােধ করিলে আমি উহা গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিয়া দুঃখ ভারাক্রান্ত হইয়া ঢাকায় চলিয়া আসি। ইহার পর নিয়াজ সাহেবের সাথে আমার আর দেখা হয় নাই। এখনও নিয়াজ সাহেবের কথা অমান্য করার জন্য আমি দুঃখ অনুভব করি এবং তঁহার কথা প্রায়ই স্মরণ করি। আমার কলিকাতা জীবনে আমাকে বিশেষ সাহায্য করেন যশােহরের খান বাহাদুর বজলুর রহমান সাহেব। কলিকাতা যাওয়ার প্রথম অবস্থায় তিনি কোনরূপে মাথা গুজিয়া থাকিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। এবং তাহার অফিসে সামান্য বেতনের একটি চাকরী দিয়া কোনরূপে খােরপােষের ব্যবস্থা করিয়াছেন। পরে হিসাবরক্ষণ বিভাগে একটি চাকরী পাই একং চট্টগ্রামের খান সাহেব জাকের হােসেন সাহেবের বাসায় গৃহশিক্ষক হিসাবে অবস্থান করি।

তখন খান সাহেব জাকির হােসেন কলিকাতার বড় বাজার প্রেসিডেন্সি পােস্ট মাস্টার। সেখানে থাকাকালীন চট্টগ্রাম সাহিত্য মজলিস, কলিকাতা নামে একটি সাহিত্য মজলিস প্রতিষ্ঠা করি। এবং ইহার প্রেসিডেন্ট ছিলাম আমি এবং চট্টগ্রামের কৃত সন্তান মরহুম সুলতানুল আলম ইসলামাবাদী এম.এ ছিলেন ইহার সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামের কলিকাতা প্রবাসী শিক্ষিত যুবকদের দ্বারাই ইহা গঠিত হয়। মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী ও ডঃ বেনী মাধব বড়ুয়া ডিলিট ছিলেন ইহার পৃষ্ঠপােষক প্রতি রবিবার ৭৭ নং কুলটোলা রােডের একটি ছােট কামরার ইহার বৈঠক বসিত এবং সাহিত্য চর্চা ও বক্তৃতা শিক্ষা দেওয়া হইত। এই প্রতিষ্ঠানের অনুপ্রেরণা ও সহায়তার একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহাতে কলিকাতাবাসী শ্রমিকদের ছেলেদের অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হইতাে। এই স্কুল ঘরের জন্য ২২নং বলাই দত্তরােডের চট্টগ্রামবাসী চিৎপুর রােডস্থ প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জনাব সােলায়মান চৌধুরী তাঁহার ঘরের একটি কামরা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এই স্কুল কলিকাতা কর্পোরেশনের অনুমােদন ছিল এবং চট্টগ্রামবাসী ডঃ অরবিন্দু বড়য়া ইহাতে সাহায্য করিয়াছিলেন। তখন তিনি কলিকাতা কর্পোরশনের শিক্ষা অফিসার ছিলেন। পরে যখন চট্রগ্রামের জনাব জহুর আমেদ চৌধুরী এ মজলিসের সদস্য ভুক্ত হন, তাঁহার ষড়যন্ত্রে ঐ স্কুলঘর ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হই এবং আমি মাসিক ৪০ টাকা ঘর ভাড়া দিয়া অনস্থানে স্কুল বসাই। উক্ত মজলিসের সংস্পর্শে আসিয়া কলিকাতা প্রবাসী অনেকে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক প্রেরনা লাভ করেন। এই মজলিসেই চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান সাবেক শ্রমমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী তাঁহার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম খড়ি আমার হাতেই লাভ করেন। তাই তিনি আমাকে সারাজীবন ওস্তাদ মানিয়া গিয়াছেন। কলিকাতায় তিনি বহুদিন আমার সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলেরা সবেই আমার স্কুল আর, নূরুল হক হাইস্কুল হতে প্রবেশিকা পাশ করে। এই সনে আমার লিখিত বৃহত্তর চট্টল’র পান্ডুলিপি শেষ করি যাহা পরে অর্থাৎ ১৯৭৮ ইং সনে প্রথম বারের মতাে প্রকাশিত হয়। এই ব্যাপারে মৌলানা ইসলামাবাদী ও ডঃ বেনীমাধব বড়ুয়া আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণ দান করেন। মৌলনা ইসলামাবাদী ইহার পান্ডুলিপি সংশােধন করেন। বহুদিন কলিকাতায় ৭৭ নং কুলটোলা রােডে তাঁহার সাথে ছিলাম এবং বহু ব্যাপারে আমি তাঁহার নিকট ঋণী। ঐ সময় অর্থাৎ ১৯৪৩ সনে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মহামারী দুর্ভিক্ষের সময় স্থানীয় মন্ত্রী ও চট্টগ্রামবাসী এম.পিদের উপর বিরক্ত হইয়া । ফজলুল হক সাহেবের উপর চাপ সৃষ্টি করি এবং চট্টগ্রামবাসীর ত্রাণার্থে কয়েক হাজার মন চাল পাঠানাের ব্যবস্থা করি। অথচ তখন চট্টগ্রামবাসী এম.পি.রা এই মহাবিপদে একটুও উচ্চ বাচ্য করেন নাই। হক সাহেবের কাছে ডেপুটেশনের জন্য মৌলনা ইসলামাবাদী ছাড়া আর কাহাকেও পাওয়া যায় নাই। অথচ তার আগের দিন মিটিংয়ে কথা ছিল চট্টগ্রামের এম.পি.রা আমার সাথে সংসদ অধিবেশনের পর হক সাহেবের কাছে সবেই যাইবেন। কিন্তু মাগরিবের নামাজের পর কাহাকেও পাওয়া যায় নাই। সবেই গা ঢাকা দিয়া চলিয়া গিয়াছেন। কেবলমাত্র মৌলনা সাহেবকে আচকানের আঁচল ধরিয়া টানিয়া নিলাম।

১৯৪১ইং সনের ৬ই জুলাই ঢাকার এক অতি সভ্রান্ত পরিবারে আমার বিবাহ হয় এবং ঐ বিবাহ মজলিসে আমার ওস্তাদ হিসাবে ডঃ মােঃ শহীদুল্লাহ, ডঃ মাহমুদ হাসান উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর মহরমের দিন আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এই অনন্য সাধারণ গুণবতী রমনী শাহজাদী বেগম আমার সব সুখ দুঃখের ভাগী ছিলেন। সর্ব শ্রেণীর লােকদের সাথে অবাধ মলামেশা, অভাব গ্রস্তদের প্রতি অপরিসীম দয়াশীলতার জন্য তাঁহার মহানুভবের কথা আমাদের দেশে এখনও প্রবাদ বাক্যে মতাে জিগিয়ে আছে। এখনও অনেক ভিক্ষারীকে আমার ঘরের দরজায় এসে তাহার জনা অশ্রু বর্ষনে বুক ভাসাইতে দেখা যায়। ঢাকায় তার নানার প্রতিষ্ঠিত সােবহানবাগ মসজিদের উত্তর দিকের বারান্দার উত্তর পাশ্বে কবরস্থ আছেন।

ছােটবেলা হইতে আমার গ্রাম্য নিরক্ষর এলাকাকে শিক্ষিত করে তােলা আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাই আমার শিক্ষালাভের সঙ্গে সঙ্গে যেকোন চেষ্টায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তােলার আপ্রাণ চেষ্টা করি এবং আমার পিতা মরহুম ফজলুর রহমান মােক্তার ইহাতে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। এতদউদ্দেশ্যে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই কিছু জমি রেজিষ্ট্রি করে দিয়া যান। পরে সংখ্যা গরিষ্ঠদের বিপুল বাধা ও বিপত্তির মাঝে তদানীন্তন জিলা বাের্ডের চেয়ারম্যান মরহুম আনােয়ারুল আজীম বার-এট-ল আমার পিতার স্মৃতি স্মরণার্থে সর্বপ্রথম একটি নিম্ন প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়ে যান ১৯২৯ ইং সনে। বহু বাধা বিঘ্নের মধ্যে জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরীর সহানুভূতিতে ও আমর ছােট ভাই অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য বিভাগের ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব আব্দুল হক সাহেবের কঠোর চেষ্টা সাধনা ও মাসিক আর্থিক অবদানে এই স্কুল জুনিয়র এবং পড়ে এফ, আর আমার পিতা ফজলুর রহমান হাই মাদ্রাসা রূপে ১৯৫১ইং সনে এবং এবং বর্তমানে ১৯৬৭ সনে সরকার কর্তৃক এ.আর. নূরুল হক হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়। আমার সহধর্মিনি শাহজাদী বেগমের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও পরম আত্মীয় তদানীন্তন কৃষি এসিসটেন্ট ডাইরেক্টর আব্দুল হালিম সাহেব তকালীন ঢাকা বাের্ডের চেয়ারম্যান জনাব প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খানের আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকিলে এ বিদ্যালয়ের সরকারী অনুমােদন লাভ অসম্ভব হইত। জনাব প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খানই সর্ব প্রথম এই প্রতিষ্ঠানে ১৯৫১ সনে। সরাসরি হাই মাদ্রাসা রূপে সরকারী অনুমােদন দান করেন। কিন্তু ছাত্রদের উৎসাহ উদ্দীপনা আমার জুনিয়র মাদ্রাসাটি হাই মাদ্রাসায় পরিণত হয় সত্য কিন্তু আমার একক প্রচেষ্টায় এতবড় একটা প্রতিষ্ঠান চালানাে অসম্ভব হইয়া পড়ে। জনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী জিলা চেয়ারম্যান থাকা কালীন এই প্রতিষ্ঠানে এক হাজার টাকা করিয়া অনুদান দিতেন। তবুও অর্থাভাব দারুন প্রকট হইয়া পড়ে ফলে প্রত্যেক শ্রেণীর বিষয় আমাকেই পড়াইতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাধ্য হইয়া ব্যবসায় লাইনে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হই। আমার শ্বশুর পক্ষ হইতে আমাকে প্রদত্ত দুই লক্ষ টাকা পুঁজি দিয়া পুস্তকের ব্যবসা আরম্ভ করি। শহরে একটি বুকস্টল ও স্থানীয় কালাইয়ার হাটে বা কালু ফকিরের হাটে একটি লাইব্রেরী স্থাপন করি। এগুলি চালানাের জন্য দুইজন লােক নিযুক্ত করি। কিন্তু কিছুদিন পরে ঐ ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া আমার এক আপন আত্মীয়কে দোকানে বসাইয়া দেই। শেষকালে সেই লােকেই আমার শহরের দোকানটি আত্মসাৎ করিয়া ফেলে। তখন আমি বিরাট সমস্যায় পড়ি। ব্যবসা চালাইতে গেলে আমার স্কুল করা হয় না আর স্কুল। চালাইতে গেলে ব্যবসা থাকেনা। সুতরাং বাধ্য হইয়া ব্যবসা ছাড়িয়া দেই এবং হাইস্কুলটিকে উন্নত করিতে লাগিয়া যাই। আমার ব্যবসাটির সমস্ত পুঁজি ও জীবনের সমস্ত আয় এই প্রতিষ্ঠানেই ব্যয়িত হয়। ১৯৪৮ ইং সনে এই স্কুলের জন্য কিছু জমি সরকার হুকুম দখল করিল । ইহার জন্য গুটিকতক লােক আমার বিরুদ্ধে শত্রুতা করিয়া আমাকে দুর্নীতি দমন বিভাগের মােকদ্দমায় জড়িত করিয়া নানারূপে দুর্ভোগ ও যন্ত্রনায় ফেলে।

বিবাহের পর আমি কিছুদিন কলিকাতার পার্ক সার্কাসে সস্ত্রীক ছিলাম। কিন্তু ১৯৪৩ইং সনে আমাকে বাংলাদেশ সার্জেন জেনারেলের পি, এ হইতে সামরিক বিভাগে। এডমিনেসট্রেটিব অফিসার করিয়া বদলী করায় আমি কলিকাতা ছাড়িতে বাধ্য হই। ১৯৪১ইং ২২শে ডিসেম্বর রােজ শনিবার আমার পিতার মৃত্যু হইলে আমার স্ত্রীকে আমার নিজ বাড়ীতে রাখিয়া যাই। ক্রমে আমাকে বরিশাল, আসামের গৌহাটি, পালং-এ বদলী করা হয়। এবং শেষবারের মতাে ১৯৪৪ সালে মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিন পূর্বে চাকরী ছাড়িয়া দিয়া সােজা ঢাকা চলিয়া যাই। সামরিক বিভাগে চাকরী করিবার সময় যখন বরিশাল ছিলাম আমার অধীনস্থ সমস্ত নিরক্ষর লােকদিগকে অক্ষরজ্ঞান ও সাধারণ লেখাপড়া শিখানাের ব্যবস্থা করি। সমস্ত তাবুতে একজন শিক্ষক নিযুক্ত করিয়া দিয়া প্রতি রাত্রে একটি নথি জ্বালানাের ব্যবস্থা করি। যতদিন পর্যন্ত তারা নিজ নিজ দস্তখত দিয়া মাসিক মাহিনা নিতে পারে নাই ততদিন পর্যন্ত তাদের মাহিনা বন্ধ করিয়া রাখি এবং পরে সবেই নিজ নিজ নাম দস্তখত দিয়া মাহিনা নিতে বাধ্য হয়। আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল,“এত উচ্চশিক্ষিত লােকের সামরিক বিভাগ চাকরী করা উচিত নয়। তাই সামরিক বিভাগে চাকরী করা আমার জন্য কঠিন হইয়া পড়ে। কারণ আমি যেখানেই বদলী হইতাম আমার কোম্পানীর লােকেরা আমার সাথে সাথেই বদলি হওয়ার জন্য সংগ্রাম করিত। ফলে আমি অন্য অফিসারদের বিরাগভাজন হই। তাই আমি আমার নিজের গা বাঁচানাের পথ খুঁজিতে থাকি। ১৯৪৪ সনে যখন আসামের পান্ডুয়ায় ছিলাম তখন আমাকে চাকুরী হইতে রেহাই দেওয়ার জন্য দরখাস্ত করি। কিন্তু সিমলা কর্তৃপক্ষ বরাবরই নামঞ্জুর করিয়া দেন। সেখানে থাকার সময় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের চাকরী যায় এবং ইহার জন্য আমাকই দায়ী করে। শেষ পর্যন্ত আমি গৌহাটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হই। সেখানে কিছুদিন থাকার পর এই সুযােগে আমি ঢাকায় ফিরিয়া আসি। এখানেই আমার চাকরী জীবন শেষ। ঢাকা মেডিকেল বাের্ডে আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়া সিভিল সার্জনের অনুমােদন চাওয়া হয়। বহু চেষ্টা তদবিরের পর আমার দরখাস্ত অনুমােদন পায় ও ১৯৪৬ ইং সনে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখাইয়া কোন রকমে সামরিক বিভাগ হইতে ছাড় পাই। ইহার পর বহুবার সরকারী চাকুরীতে যােগ দেয়ার জন্য ডাকা হয়। কিন্তু আমি সব সময় অস্বীকার করি চাকুরী ছাড়িয়া বাড়ীতে চলিয়া আসার পর সংসার চালানাে তাগিদে আমাকে বিভ্রান্ত করিয়া তুলিল। তখন সবেমাত্র আমার বড়ছেলে মাহমুদুল হক খান (মাছুম) অতি ছােট। চারিদিকে ছাত্ররা আমাকে ঘিরিয়া ধরিল তাহাদের প্রাইভেট পড়াইতে হইবে সুতরাং আমাকে ঐ পথ অবলম্বন করিতে হইল। এতে কি হয়। সংসার চালানাে বহু কষ্টকর ও ব্যয়সাপেক্ষ।

এই অশিক্ষিত অঞ্চলের শত শত নিরক্ষর হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে পড়াইয়া বর্তমান এই অঞ্চলকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষিত অঞ্চলে পরিণত করিয়াছি সত্য কিন্তু নিয়তির এমনই অপুর্ব পরিহাস যাহারা আমার দ্বারাই মানুষ হইয়াছে তাহাদের অধিকাংশই বর্তমানে আমাকে অপদস্ত করিবার জন্য লাঠি লইয়া পথে ছড়াইয়া রহিয়াছে। তথাপি আমার এই অনুন্নত সমাজকে সর্বদিকে উন্নত করিবার মহৎ উদ্দেশ্যে কয়েকবার বাংলাদেশ আইন সভার সদস্য পদ প্রার্থী হই । কিন্তু দারুণ অর্থাভাবে ইহা কোনরূপে কার্যকর হইয়া উঠে নাই বুঝিলাম দেশের মানুষর কাছে জ্ঞান ও গুণের কোনই মর্যাদা নাই, শুধু টাকার মােহ ও গদী দখলের লােভ বর্তমান যুগে রাজনীতি শুধুই টাকার খেলা সত্যিকার দেশ দরদী ও মঙ্গলকামী লােক নাই বললেই চলে। আমার জীবনে অধিকাংশ সময় মুসলিমলীগের খেদমত করিয়া কাটাইয়াছি। কিন্তু অর্থের অভাবে দেশের কোন উল্লেখ যােগ্য কাজ করিতে পারি নাই। তবুও পাকিস্তান আমলে আইযুবখানের সময় আমাকে জোর করিয়া দুইটি ইউনিয়নের সংযােগে B.D. চেয়ারম্যান করিয়া দেওয়া হয়, যার ফলে এতদ অঞ্চলের সামান্য কিছু খেদমত করিয়াছি বলিয়া মনে হয়। অনেক বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়া একটি নতুন খাল কাটাইয়া দিয়াছি যাহা বর্তমানে ‘হকখালী নামে পরিচিত, এবং যার বদৌলতে হাজার হাজার কৃষকরা ইরি ফসল উৎপাদনে প্রভুত লাভবান হইতেছে বলিয়া কথিত হয় ইহার জন্য আমাকে ভূমির মালিকদের সাথে ফৌজদারী মােকদ্দমা চালাইতে হয় এবং অনেকে টাকা খরচ করিতে হয়। ভরাট বৈদ্যানি খাল, কুমারখালী হাড়গাজীও ভারম্বাভখাল কয়েকবার সংস্কার করাইয়া দেই। সমস্ত রাস্তাঘাটগুলি প্রশস্ত ও গাড়ী চলাচলের সুযােগ করিয়া দেই। স্থানীয় সারােয়াতলী পােস্ট অফিসকে সাব পােষ্টাফিসে পরিনত করাইয়া ইহাতে পাবলিক টেলিফোনের সংযােগ ব্যবস্থা করি। ধােরালা দাতব্য হাসপাতাল গৃহকে পাকা করিয়া দিবার ব্যবস্থা করি, কয়েকটি পাকা সেতু পাকা নালা, নর্দমা, এবং অনেকগুলি গভীর নলকুপের ব্যবস্থা করি। বহু বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়া আমার স্কুলগৃহটি নিজের একক প্রচেষ্টায় পাকা ছাদ করিয়া দিয়াছি যাহার আয়তন (২১ X ২৫) এবং বিজ্ঞান ভবন (৪6 x ২) ব. ফুট। আমি চেয়ারম্যান থাকা কালীন ইং ১৯৬০ হইতে ১৯৬৬ পর্যন্ত ইউনিয়ন কাউন্সিল তহবিল হইতে নিজের জন্য কোন ভাতা, বা ব্যক্তিগত আসা যাওয়ার খরচ নেই নাই। স্থানীয় সমস্ত খালগুলি সংস্কার করাইয়া দিয়াছি, যাহাতে নৌকা, সাম্মান অবাধে চলাফেরা করিতে পারে, এই স্কুলের ব্যাপারে আমার জীবনের সমস্ত আয় সম্পদ ব্যয়িত হয়। দেশ ও জাতির জন্য বহু কিছু করার স্বপ্ন ছিল কিন্তু মানুষের স্বার্থ পরতার দরুন ও সুযােগের অভাবে সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রহিয়া গেল, তাহা কোন রূপ বাস্তবায়িত হয় নাই।

চাকরী ছাড়িয়া দিয়া আমার আরবী শিক্ষার প্রতি বিশেষ ঝোঁক উঠায় ১৯৪৭ইং সনে আরবীতে প্রাইভেট হিসাবে এম.এ.পাস করি যাহার জন্য আমাকে ডাবল এমএ বলা হয় পূর্বে বি.এ.তে আরবী আমার অন্যতম বিষয় ছিল। ইংরেজীতে এম.এ পাশ করিয়া আমার ধারণ হইল ইসলাম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলাম এবং আমার জীবন সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলে মনে হইলাে।

চট্টগ্রামের অতীত বর্তমান কৃতী সন্তানদের কোন জীবন বৃত্তান্ত না থাকায় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতদূর সম্ভব ‘চট্টল প্রতিভা’ নামে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করি, যদিও ইহা সম্পূরক নয়।

ইহার প্রথম সংস্কার বাহির হয় ১৯৮১ইং সনে এবং দ্বিতীয় সংস্কবণ বাহির হয় ১৯৮৪ইং সনে। ১৯৬৩-৬৪ সনে ইসলামের ইতিহাস নামে একটি স্কুল পাঠ্য বই প্রকাশ করি যাহার নমুনা। আমার কাছে নাই। আমার লিখিত বয়েস ফেবেলছ’ ‘মাই ফেবেলছ আরাে অনেক স্কুল পাঠ্য বই ইংরেজ পাকিস্তান আমলে ছিল, যা এখন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বর্তমান বিংশ শতাব্দীর শেষ– দেশের শিক্ষাঙ্গন ও সমাজ জীবনে অভূতপূর্ব পরিস্থিতি ও মুসলমান কিশাের কিশােরীদের অধৌগতি ও ইসলামের সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া না করিয়া আমি ইসলাম কোন পথে (১৯৮৪) ও ইসলামিক মূল্যবােধ নামে দুটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করি। বর্তমানে এইগুলি সমাদৃত না হইলেও ভবিষ্যতে ইহা কিছু সুফল দিবে। ইহা পড়িলে ভুল পথে চালিত সমাজকে নিশ্চয় সঠিক পথের সন্ধান দিবে বলিয়অ আশা রাখি ১৯৭৮ সনে আমার বড় ছেলে মাহামুদুল হক, খান এম, এ (মাছুম) ও আমার মেয়ে লুফুন্নেছা খানম বি.এ ও ছােট ছেলে ফজলুল হক খান এম এস সি (শামীম) ইহাদের সংযােগ আমাকে হজ্জ করাইয়া আনার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে শােকর গুজারী করি যাহা আমার পক্ষে কোন দিনও সম্ভবপর হইতাে না। বর্তমান শেষ সয়সে বহুবিধ রােগের দরুন কর্মক্ষমতা হারাইয়া ফেলি, তথাপি কিছু কিছু লােকের ভাই বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের ও সরকার এর সহযেগিতায় আমার পাড়ার । জুমা মসজিদটিকে মুসল্লিদের স্থান অসংকুলান হওয়ায় ইহার সম্মুখভাগ ও উত্তর পাশে পাক ছাদ দিয়া সম্প্রসারিত করিয়া দিয়েছি। ইহাতে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হইয়াছে, এবং আরাে দু লক্ষ টাকার মত খরচ হইবে বলিয়া মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে আমার মাতা পিতার কবরটির উত্তর পার্শ্বে এক মহান তাপস আউলিয়ার কবর মানুষ পশুদের অত্যাচার হইতে রক্ষা করিবার জন্য আমি বহুবার আর্দিষ্ট্য হইয়াছি, বর্তমানে ইহা পাকা করিয়া দেওয়ায় কাজ হাতে নিয়াছি। এই মহান আউলিয়ার নাম মুজাফর আহমদ খান (রাঃ) যিনি আমার পিতার দাদা হন এবং তাহার নাম আমাদের বংশ কুজিতে আছে। তাহার নাম যােগার করিতে অনেক কষ্ট হয়। খােদায় তৈফিক দিন যাহাতে এই পবিত্র কাজটি সম্পূর্ণ করিতে পারি মসজিদ পুকুরটির তিন দিকের কবর স্থানটি পাকা দেওয়াল করিয়া দেওয়ার জন্য ৭৮ বছর পূর্বে ইট আনাইয়া রাখিয়াছি কিন্তু কতক উচ্ছংখল প্রতিবেশীর অবৈধ অস্বাভাবিক ও অশােভন ব্যবহারের জন্য ইহা এখনও সম্পূর্ণ করিতে পারি নাই, ইহা ভবিষ্যতে হইবে। কিনা তাহা আল্লাহই জানেন। আমার জীবনের শেষ চেষ্টা আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সরকারী করণ ও চট্টগ্রাম কানুনগােপাড়া বাস রাস্তাটি পাহাড়ের ভিতর দিয়া রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পুদুয়া বাস রাস্তার সংগে পার্বত্য চট্টগ্রামের উদরবন্যার সঙ্গে সংযুক্ত করিয়া দেওয়াওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা সরকারের কাছে পেশ করিয়াছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইলে রাস্তার উভয় পার্শ্বে কলকারখানা, শিল্প-বাণিজ্ব গড়িয়া উঠিবে, ফলে চট্টগ্রামের সংগে পার্বত্য চট্টগ্রামের সরা সরি সড়ক যােগাযােগ স্থাপিত হইবে। ইহার দ্বারা লক্ষ লক্ষ লােকের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হইবে। এই পরিকল্পনা, আমার জীবন অবস্থায় বাস্তবায়িত না হইলেও ইহা কার্যকরী করার দায়িত্ব আমার অনুসারিদের প্রতি থাকিয়া যাইবে। বর্তমানে আমার শেষ বয়সে আমরা যে মুসলমান তাহা কেমন করিয়া বুঝিব’ নামক একটি ক্ষুদ্র পুস্তকের পান্ডুলিপি শেষ করিয়াছি। খােদায় তৈফিক দিলে ইহা শীঘ্র ছাপানাে প্রকাশিত হইবার আশা রাখি।

পরিসমাপ্তিতে বর্তমান শিক্ষাক্ষণে S.S.C তে হাই স্কুল বিভাগে আরবী সাহিত্যের অর্থ পুস্তকের অভাবে ছাত্র ছাত্রীরা যাহাতে আরবী অন্যতম বিষয় হিসাবে শিক্ষা করিতে সাহায্য করে তার জন্য S.S.C. -র আরবী সাহিত্য এর একটি অর্থ পুস্তক প্রকাশ করিয়াছি যাহাতে মুসলমান ছেলে মেয়েরা S.S.C তে আরবী পাঠ্য হিসাবে নিতে উৎসাহিত ও অনুপ্রেরণা লাভ করে।

আমি কানুনগােপাড়া স্যার আশুতােষ কলেজে গভর্নিং বৰ্ডির মেম্বার হওয়ার পূর্বে তিন চার বার আই. এ ডিগ্রী পরীক্ষার সেন্টার চলিয়া যায়। যাহা আমার পরিশ্রম, আপ্রাণ চেষ্টায় পুনরায় আই. এ. ও ডিগ্রী পরীক্ষার সেন্টার হিসাবে আবার … পুনসংস্থাপিত হয়। এই কলেজের উন্নয়নে এবং ইহা জাতীয়করণে আমার প্রচেষ্টা ও অবদান সর্বাধিক আমি দেশে থাকাকালীন খুনী মােকদ্দমার সেশনে অন্যতম জুরি (jury) ও সেন্সর ছিলাম।

আমি যখন আই,এ তে পড়ি আমাদের অংক করাতেন মুর্শিদাবাদের শশী বাবু (গােল্ড মেডালিস্ট) আমাদের একটি পারমােটেশান কবিনেশনের অংক কলেজের বাের্ডে দশ বার দিন থেকে করাইতে থাকেন। কিন্তু শেষের দিকে গিয়ে শেষ পর্যায়ে সঠিক উত্তর দিতে না পারায় বাের্ডে অসমাপ্ত থেকে যায়। আমি আমার আব্বার সাথে প্রতি শনিবার গ্রামের বাড়ী যাইতাম। এবং প্রতি সােমবার বাড়ীতে গিয়ে উনার সাথে আবার কলেজে আসতাম। রবিবার প্রায়ই উনি আমার খাতা দেখতেন। আমার খাতায় ঐ অসমাপ্ত অংকটি দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন “এই অংকটির উত্তর কি? আমি বললাম আমাদের স্যার দশ বার দিন কলেজের বাের্ডে অংকটি করে দেন কিন্তু এই পর্যন্ত ইহার কোন সঠিক উত্তর দিতে পারেন নাই। তিনি বললেন “ কেন? ইহার উত্তর তাে চার” কাছেই একটি ছােট লাল পেন্সিল ছিল ইহা টেনে নিয়ে আমার খাতায় অসমাপ্ত অংকটি দুই লাইন।

উত্তর লিখিয়া দেন। আশ্চর্য হইয়া ও সন্দেহে আক্রান্ত হইয়া আমার বাড়ী বীজগণিতটা খুলিয়া ঐ অংকের উত্তর দেখলাম– আনন্দে উৎফুল্ল হয় পরের দিন সােমবার কলেজে গিয়ে বাের্ডে লিখিত অংকের উত্তর লিখিয়া ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসিয়া রইলাম। দ্বিতীয় ঘন্টায় স্যার ক্লাসে বাের্ডে গিয়ে দেখেন কে বাের্ডে বাকী দুই লইনে অংকটি করিয়া দিয়াছেন। উত্তর দেখিয়া জোর গলায় বললেন এটা করেছে কে? পিছন থেকে বললাম আমি করছি স্যার তুমি রােল নম্বর ৬৪ তুমি কেমন করে করবে? কখনােই নয়। তুমি এ অংক করতে পারাে না। সত্যি করে বল”। পরে আমি বললাম আমার আব্বা আমার খাতায়—– দুই লাইনে উত্তর লিখে দিয়েছেন কলেজে এসে ইহা বাের্ডে লিখে দিয়েছি”। তিনি অবাক হয়ে দুই মিনিট পরে বললেন তিনি কে? কি পাশ”? ;

আমি বললাম তিনি নরমাল থার্ড ইয়ার পাশ করেছেন । তখন মুসলমানদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নরমাল থর্ড ইয়ার পাশ ছিলেন। ইহা কেহই পাশ করতে না পারায় পরের বছর ইহা। উঠে যায়। আমার স্যার শশীবসু তখন হাত জোর কর বললেন “আজকের থেকে উনাকে আমি গুরু মানলাম”। সেই আমলে এদেশে ইংরেজী ভাষা আসেনি বাংলা, অংক, সংস্কৃত, জ্যামিতি, পরিমিতি, জনমিতি, ত্রিকোনমিতি, বাংলা ব্যাকরণ, অলংকার ইত্যাদিতে তাহার গভীর জ্ঞান ছিল। এদেশের পন্ডিত লােকেরা তাকে বিশেষ ভয়ের চাখে দেখিতেন । তার অগাধ পান্ডিত্যের জন্য ও দৈহিক শক্তির জন্য আমাদের দেশে মানুষের মুখে বহু দেখা অদেখা ঘটনা আজও প্রবাদ বাক্যে তাহার জীবনী কথায় জারী রহিয়াছে। এইজন্য এদেশের লােকেরা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে তাঁহাকে গুরুর মত শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখিত “সদভাব শতক” অনুকরণে “কুসমাঞ্জলী” নামে তাহার একটি বই আমার হাত পড়ে।

আমাদের বাড়ী কয়েকবার পুড়িয়া যাওয়ায় বহুমূল্যবান গ্রন্থ কাগজাদি দলিলাদি পুড়ে যায় । চট্রগ্রামের সর্বস্থলে এক নামে সুপরিচিত মুন্সী পন্ডিত ফজলুর রহমান মুক্তার। শহরের প্রায়ই সব বড় লােকদের বাড়ীতে খানাপিনা দাওয়াত হইতাে। তাহাকে খুবই আদর সমাদর করিত। উকিল রেয়াজ উদ্দিন খান বাহাদুর কাসেম আলী খান বাহাদুর আমান আলী মাস্টার খাঁন বাহাদুর আবদুল হাকিম মিয়া, অলি মিয়া কন্টাকটার, হাজী উইফুস আলী, আবদুল জাব্বার সওদাগর ইত্যাদির বিবাহ উৎসবে তার দাওয়াত ও সম্মতি ছাড়া হইতাে না। আমি ও ছােটকালে সবসময় তাহার সাথে যাইতাম। তাহারা তাহাকে মুসলমানদের শিক্ষার অগ্রদূত ও পন্ডিতএবং আইনজীবি হিসাবে বিশেষ সম্মানের চোখে দেখিতেন। আমি ১৯৫৩ সনে সভায় নির্বাচন ব্যাপার মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশাদের বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি একজন অতি বয়স্ক লােক তাহার সাক্ষাতের অপেক্ষায় একাকী বসে আছেন।

তিনি বললেন সাহিত্য বিশারদ অন্দরে গেছেন আপনি অপেক্ষা করুন। দশ মিনিট নিরবতার পর লােকটি বললেন কিছু মনে না করিলে আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাস করিতে পারি কি?” আমি বললাম “কেন? বলুন” তিনি বললেন “আপনি কি মুন্সী ফজলুর রহমান মােক্তার সাহেবের ছেলে। তিনি বলেন “আপনাকে দেখইে তাঁর স্মৃতি আমার হঠাৎ জাগিয়া উঠল। তিনি আমাদের বড় মুরব্বী ছিলেন। আমার বাড়ী কক্সবাজারের টেকনাফের শেষ মাথায়। আমাদের সেখানে তিনি বহুদিন ছিলেন। এই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব আজ আমাদের মধ্যে নেই। তাহার কথা প্রায়ই মনে পড়ে।

চাকরি ছাড়িয়া দেশের অশিক্ষিতটা কৃষককূলকে শিক্ষার আলাে দেওয়ার চরন উদ্দেশ্য কয়েকবার অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় খুলি। স্কুলের শিক্ষকগণ ও শিক্ষিতি যুবকেরা আমাকে সহযােগিতা করে এবং চার বছর নিয়মিত স্কুলে চলে।

সরকারের উদাসিনতা, অসহযােগিতায় ক্রমে ক্রমে ইহা অচল হয়ে পড়ে। ১৯৪১ সনের ভয়াবহ তুফানে আমার স্কুল গৃহটি ভাঙ্গিয়া পড়িয়া যাওয়াতে নৈশ বিদ্যালয়টি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৬০-৬৬ সময়ে আমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন ভােট না দিলে বর্তমান গােমদন্ডীর ফকীরনীর দিঘি বােয়ালখালী উপজেলায় হেড কোয়াটার হইত না। হাজীর হাটের ইকবাল পার্কের পক্ষে জোড় বেশী ছিল। কিন্তু চতুদিকের লােকজনর আসা যাওয়ার খুবই অসুবিধা ছিল বলিয়া আমিও শ্রীপুর চরনদ্বীপের চেয়ারম্যান জনাব জহুরুল ইসলাম যােগাযােগের সুবিধার জন্য গােমদন্ডীকে হেড কোয়াটার ও থানা হাসপাতাল করাই। তখন গােমদভীর রাস্তা যাহা বর্তমানে হাওলারােড নামে পরিচিত হইয়াছে ইহার কিছুই ছিল না। আমরা চেয়ারম্যানদ্বয় ও তৎকালীন সার্কেল অফিসার জনাব সফিউল আলম এর সহযােগিতায় বছর বছর সংস্কারে বর্তমান হাওলা রােড, গােমদন্ডী উপজেলা হেডকোয়াটার ও থানা হাসপাতাল নির্মিত হয় ।

ছােট বেলা হইতেই আমার অনুন্নত অশিক্ষিত সমাজকে উন্নত করার মানসে বহু চেষ্টা সাধনা করিয়াছি। কিন্তু সুর্যোগ সুবিধার অভাবে বিশেষ কিছু করিতে পারি নাই। পূর্বে বাংলাদেশ আইন সভায় বােয়াল খালীর কোন পৃথক আসন ছিলনা আমি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন কেস করিয়া সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাত্তার সাহেবের সহযােগিতায় আইন সভার আসন অনুমােদন করাই। এ বিষয়ে আমাকে বিশেষ সমর্থনদেন তখনকার চট্টগ্রাম জেলা প্রসাশক জনাব এনামূল হক সাহেব।

আমার পাঠ্য অবস্থায় কারও সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ছিল না। বিশেষ কিছু আন্তরিকতা ছিল একজনের সাথে যদিও তাহার সাথে কয়েক বছর দেখা হয় নাই। আমি তাকে প্রায়ই স্মরণ করি । তাহার নাম গােলাম কুদুস বাড়ী চকোরিয়া থানার পেকুয়া গ্রাম জমিদার ফতেআলী চৌধুরীর ছেলে সিরাজ মিয়ার বড় সন্তান। শিক্ষাঙ্গনের সাথে বহু বছর জড়িত থাকায় দেশের অনেক ছাত্রদের সাথে পরিচয় হয়। আমি আমার কার্যে সহযােগিতার জন্য তাদের কাছে ঋনী। মােঃ আব্দুল জলিল বর্তমান সােনালী ব্যাংকের ডেপুটি ম্যাজোর আব্দুল কুদুস মধ্য প্রাচ্যে কার্যরত । রওশন আলী মৃত আব্দুস সােবহান, আবুবকর, সৈয়দ আহাম্মেদ ডাঃ মােঃ শরীফ। তারা আমাকে সব সময় সহযােগিতা করিত এবং তারা আমার অনেক প্রিয় ছাত্র ছিল।

মিলন নামে এক গরীব পিতৃহীন হিন্দু ছাত্রকে আমার বাড়ীতে রেখেছিলাম। তাকে বি, এ, পাশ করিয়ে কৃষি বিভাগে চাকুরী দিয়ে দেই। তার বাড়ী সাতকানিয়া থানার বাজালিয়া গ্রামের ফকিরার খিল। সে আমার অনুগত ছাত্র ছিল । হিন্দু ছাত্র আমার কাছে রেখেছিলাম বলে আমাকে আমার বাড়ীর এবং পাড়ার অনেকের বাধার সম্মুখীণ হতে হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কোন আপােষ করিনি। আজ সে প্রতিষ্ঠিত। সমাপ্ত

লেখকের কুরআন -সুন্নাহর আলোকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা গ্রন্থের পিছনে ১০পৃষ্ঠার লেখাগুলো কোন পরিবর্তন পরিমার্জন না করে হুবহু প্রকাশ করা হল। কারণ লেখকের এই নিবন্ধটিতে বোয়ালখালীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে- যা এখন কালের স্বাক্ষী- সম্পাদক।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here