আলোকিত মানুষের কথা ভাবলেই শ্রদ্ধার সাথে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আনন্দ আলোর পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছিল।
ঢাকায় তাকে ধরাই যাচ্ছিল না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজ, সভা-সমাবেশে বক্তৃতা, লেখালেখির কাজে দারুণ ব্যসত্ম সময় কাটাচ্ছেন। আনন্দ আলোর জন্মদিন সংখ্যায় তাঁর একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চাই- একথা বলতেই একটু ভেবে নিয়ে জানালেন, ঢাকায় হবে না। আমি সোনারগাঁওয়ের পাশে পাকুন্দায় থাকব। সেখানে আসতে পার। নির্ধারিত দিনে ঢাকা থেকে পাকুন্দার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। প্রিয় শিক্ষকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। ঢাকা থেকে গাড়িতে মাত্র দেড়ঘণ্টার পথ। দূর থেকে নজরে এল একটি সাদা বিল্ডিং। দিক নির্দেশনা বলছে এই বাড়িতেই আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। লেখালেখির কাজে তিনি ঢাকার কোলাহল ছেড়ে প্রিয় ছাত্র আলোকচিত্রী এম এ তাহেরের এই বাড়িতে উঠেছেন। প্রায়শই তিনি এখানে আসেন। আমরা সহজেই পৌঁছে গেলাম। স্যার ঘুমাচ্ছেন। উঠলেন ৫টার দিকে। বাড়ির তৃতীয়তলায় আমরা বসলাম সাক্ষাৎকার নিব বলে। ভাবছি কোত্থেকে শুরু করব? কোন পরিচয়ে বড় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ? ষাট দশকের সাহিত্য আন্দোলনের নেতা, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, অদম্য সংগঠক, অপরাজেয় টিভি উপস্থাপক, অপ্রতিদ্বন্দ্বী বক্তা, পরিবেশ ও সমাজের শুশ্রূষাকারী, নাকি আলোকিত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা? তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এতসব বিশেষণের এখন আর প্রয়োজন নাই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই নামটিই যথেষ্ট। তাই অতি সাধারণ একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু হলো আমাদের সাক্ষাৎকার যাত্রা…
আনন্দ আলো: শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে একটা পত্রিকা। কেন? কী মনে হচ্ছে আপনার?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হয়তো কিছুটা আমার টানে, কিছুটা গ্রামের টানে… কারণ ঢাকায় ব্যসত্মতার কারণে আমাদের মাঝে যোগাযোগ খুব কমই হয়। আবার এ কথাও সত্য ঢাকায় সবার সঙ্গে সবার দেখা হলেও নিজের সঙ্গে দেখা হয় খুব কম। শহরের মধ্যে আমরা নানা রকম কাজ, দায়িত্ব, দুর্ভাবনা, দুশ্চিনত্মার বৃশ্চিক দংশনের মধ্যে সময় কাটাই। গ্রামে এলে হঠাৎ এর থেকে বিচ্ছিন্ন হই। এই পরিবেশ মনটাকে রিল্যাক্স করে দেয়। অবকাশের আনন্দে মন ভরে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারি, ভালো লাগে। পত্রিকাটি হয়তো এই আনন্দ খুঁজতেও গ্রামে আমার কাছে ছুটে এসেছে- হা… হা… হা…
আনন্দ আলো: আমরা একজন তারকার খোঁজে এসেছি। আপনার কাছে তারকা কারা?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারকা শব্দটা নিয়ে আমি আগেও বহুবার ভেবেছি বলেছিও। শব্দটার মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতা আছে। ফিল্মে স্টার হয়। তারা দূরে দূরে থাকে। তারা রহস্যে ঘেরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাছে যাওয়া যাবে না। ছোঁয়া যাবে না। এরকম একটা ব্যাপার তাদের মধ্যে থাকে। কিন্তু অন্যক্ষেত্রে যারা স্টার তাদেরকে রাসত্মায় রাসত্মায় ঘুরতে হয়। পলিটিক্যাল স্টারকে অনেক ঘাম ঝরিয়ে মানুষের কাছে আসতে হয়। বাসত্মবতা ও সুখ দুঃখের সঙ্গী হতে হয়। ধরা যাক, একজন লেখক যদি জনবিচ্ছিন্ন থাকেন তাহলে তিনি কখনোই ভালো লেখক হবেন না। মানুষের কটু সাহচর্য, সুখ-দুঃখপূর্ণ সান্নিধ্য তাকে পেতে হবে। এবং জগতের সমসত্ম দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হবে এবং এটা সে যত বিশ্বসত্মতার সঙ্গে করতে পারবে ততই তার কল্পনাশক্তি বাড়বে এবং একই সঙ্গে সে বাসত্মব ও কল্পনাকে দাঁড় করিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারবে। একটা কথা ভাবা জরুরি, ফেঞ্চি আর ইমাজিনেশন এক নয়। ফেঞ্চি হচ্ছে এক ধরনের ভেসে যাওয়া কল্পনা। ওড়াউড়ি ব্যাপার। বাসত্মব জগতের সঙ্গে সেটা সবসময় মেলে না। ব্যাপারটা কিন্তু সুন্দর। যেমন বোম্বে ফিল্ম। খুব সুন্দর। কিন্তু বাসত্মবতা নাই। পোশাক সুন্দর, বাড়ি সুন্দর। এই হিমালয়ের নিচে নাচল আবার দৌড়ে চলে গেল সমতলে নদীর ধারে যেটা একেবারেই বাসত্মব নয়। সুন্দর পোশাক, সুন্দর বাড়ি দেখতে ভালো লাগে। সুন্দর দৃশ্য দেখালে মন আনন্দে ভরে যায়। তাই এর সঙ্গে পরিচালক পাত্র-পাত্রীকে দাঁড় করিয়ে দেয় আরও সুন্দর করার জন্য। কখনোই ভাবে না বাসত্মবতার সঙ্গে এর কোনো মিল আছে কিনা। কিন্তু ইমাজিনেশন হচ্ছে দুঃখের, সুখের হলাহল পান করে বাসত্মব মন্থনের ভেতর দিয়ে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে উঠে আসা মানুষের জীবনচিত্র।
আমি মনে করি, তারকা শব্দটা ফিল্মের লোকজনের জন্য প্রযোজ্য বেশি। একসময় টেলিভিশনের লোকরাও তেমনভাবে তারকার পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। টেলিভিশন যখন এলো তখন এটা ছিল সংস্কৃতির একটা শাখা। একটা সিরিয়াস ব্যাপার ছিল এর মধ্যে। সেখানে শিল্প, সাহিত্য, কল্পনা-জীবনের বড় কিছুকে আবিষ্কারের স্বপ্ন-আনন্দে বিভোর ছিল। টেলিভিশন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে, মানুষকে মুক্তি দিবে… কত স্বপ্নই না ছিল। কিন্তু পরে তো আর এই অবস্থা থাকেনি। পরে এটা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে যায়। এখন টেলিভিশনের উদ্দেশ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরা নয়, উদ্দেশ্য মূলত ব্যবসা। বিজ্ঞাপনের সাথে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান দেখা যায়। আর তাই সেখানে নায়ক নায়িকাকে বাসত্মব থেকে দূরে নিয়ে রমণীয় জগতের মধ্যে তাদেরকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। সেজন্য টিভিতেও আজকাল স্টার শব্দটা বেশ জনপ্রিয়। আমরা যখন টিভিতে অনুষ্ঠান শুরু করি তখন সত্যিকার অর্থে টেলিভিশনে ভালো অনুষ্ঠান হয়েছে। তখন কিন্তু ‘স্টার’ বলা হতো না। বলা হতো পারসোনালিটি…। কারণ অ্যাজ এ পারসন- একটা মানুষ হিসেবে তাকে এসে দাঁড়াতে হতো। ভালো-মন্দ, প্রিয়-অপ্রিয়- সবকিছুই তার ওপর নির্ভর করত।
আনন্দ আলো: তার মানে টিভি ও চলচ্চিত্রের লোকজনই তারকা?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অনেকটা তাই। কখনই অন্যান্য সেক্টরের মানুষকে স্টার বলা হয়নি। প্রতিভা বলা হয়েছে।
আনন্দ আলো: আমরা এই ধারণাকে পাল্টে দিতে চাই। একজন সফল কৃষকও তো তারকা মর্যাদা পেতে পারেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, পেতে পারেন। একটা শব্দটাকে, তার অর্থকে আমরা সম্প্রসারিত করছি। জল আর জলবসনত্ম… আসেত্ম আসেত্ম শব্দটির সীমা বাড়ছে- জলীয়, জলজ, জলযান…। একটা জল থেকে আমরা কতকিছুই না বের করে নিতে পারি। তেমনি হচ্ছে তারকাও। তারকা শব্দটার মধ্যে কেন যেন সসত্মা সসত্মা ভাব আছে। যেমন একজন কৃষককে যখন তারকা বলা হয় তখন আমার কেন যেন মনে হয় বাড়িয়ে বলা হচ্ছে। কৃষক সাধারণত তারকা নয়। তাকে সেই মর্যাদা দিতে গিয়ে, গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাকে যেন ছোট না করে ফেলি।
আনন্দ আলো: সবার মধ্যে তারকা হবার প্রবণতা কি আপনি লক্ষ্য করেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তারকা হবার নেশা যার মধ্যে আছে সে তারকা হয় না। এটা আমার ধারণা। ক্লোজআপ ওয়ান প্রথম পর্বের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাকে একবার কথা বলতে হয়েছিল। তখন আমি তাদেরকে বলেছিলাম তারকা হবার চেষ্টা করবে না। তারকা হলেই কিছুদিনের মধ্যে হারিয়ে যাবে। তোমরা গায়ক হবার চেষ্টা করো। সত্যিকারের সঙ্গীতশিল্পী হও তাহলে চিরদিন তারকা মর্যাদা পাবে। আলাদাভাবে যে তারকা হবার চেষ্টা করে তার পতন অনিবার্য।
আনন্দ আলো: তারকা খ্যাতির একটা বিড়ম্বনা আছে বোধহয়…
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অবশ্যই তারকা খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। এবং এটা খুবই সসত্মা ধরনের। সসত্মারই বেশি বিড়ম্বনা থাকে। কারণ সসত্মা হলেই তার গ্রাহক বেশি থাকে। সসত্মা হলেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। যে সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে পারে সে কখনোই অসাধারণ নয়।
আনন্দ আলো: জনপ্রিয়তা বলে একটা ব্যাপার আছে…
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: জনপ্রিয়তা খুবই নিম্নশ্রেণীর জিনিস..
আনন্দ আলো: আপনার এই মোহ ছিল না?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, আমার কোনোদিন জনপ্রিয়তার মোহ ছিল না। কিন্তু মানুষ একটু জানুক… একটু দেখুক…
আনন্দ আলো: এটাকে কি মোহ বলা যায় না?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তা হবে কেন? মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই- এই জনপ্রিয়তা তো সবাই আশা করে। মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই- কথাটার মধ্যে একটা মৃত্যু আক্রানত্ম মানুষের আকুতি, কান্নার শব্দ শোনা যায়। এই পৃথিবীতে সবই থাকবে অথচ আমি থাকব না। কিন্তু একটা মাত্র উপায় আছে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যদি জীবনত্ম হৃদয় মাঝে স্থান করে নেওয়া যায়। সুতরাং মানুষের হৃদয়ের মাঝে আমি বাঁচতে চাই। এটা জনপ্রিয়তা নয়, অমরত্ম লাভের আকাঙক্ষা। জনপ্রিয়তার আকুতি আর অমরত্মের আকুতি এক নয়। জনপ্রিয়তা ক্ষণস্থায়ী। অমরত্ম দীর্ঘস্থায়ী। জনপ্রিয়তা একটা বাজারের বিষয়। অধিকাংশ সময় এটা ব্যবসার বিষয়ও।
আনন্দ আলো: শিক্ষক হিসেবে আপনি ছাত্রদের কাছে বেশি প্রিয় এবং আলোচিতও। এর মাজেজা কী?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: মাজেজা কিছু নাই। তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতে পারি। আমি যত কাজই করেছি মূলে কিন্তু আমি একজন শিক্ষক। যে তার আশপাশের সবার সমৃদ্ধি কামনা করে। যে যেখানে আছে তাকে আরও উচ্চতর জায়গায় কীভাবে আরও বিকশিত করা যায় এই স্বপ্নের দ্বারা যিনি আক্রানত্ম অথবা তাড়িত সেই মানুষটাই হলেন শিক্ষক। আমি নিজেকে এভাবেই সব জায়গায় প্রকাশ করেছি। টেলিভিশনে যখন গিয়েছি তখনও মাস্টারি করেছি। কিছুটা টিভি ব্যক্তিত্ব, কিছুটা শিক্ষক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ার সময়ও তাই হয়েছে। আমার ধারণা তিনটা বিষয় আমার মধ্যে কাজ করে। এক. আমি কিছুটা ফিলোসফিক্যাল। দুই. কিছুটা কাব্যিক। ৩. কিছুটা হিউমারাস। কয়েকদিন আগে আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল- আপনার কথা শুনতে এত ভালো লাগে কেন? উত্তরে তাকে শুধু এটুকুই বলেছিলাম- আমার জীবনের চেষ্টাই হচ্ছে সুন্দরকে খোঁজা। আমার শরীর যদি একটু ভালো থাকে তখন আমি যে শব্দগুলো ব্যবহার করি চেষ্টা করি আরো আনন্দময়, আরও আনন্দময়… করে তোলার। আর একটি বিষয়- মানুষকে আমি কখনোই শক্তিমান মনে করি না। গম্ভীর কথা, ভারি কথা আমি নিজেও বুঝতে পারি না এবং টের পাই অন্যেরা তা বুঝতে পারে না। আর তাই সবসময় চেষ্টা করি কীভাবে সবচেয়ে সহজভাবে কথা বলা যায়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি- ছোটবেলায় খুব বোকা ছিলাম। কলেজে ওঠার আগে পর্যনত্ম তো আমি কথাই বলতাম না। খুবই বোকা ছিলাম। ‘বহে জলবধি’ নামে আমার একটি গ্রন্থে আমার শৈশবের কাহিনী আছে। ওটারই একটা কিশোর সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে। নাম ‘আমার বোকা শৈশব’। কত ধরনের বোকামি যে করেছি তা ওই বইতে লেখা আছে। সুতরাং আমি বোকামির অপমান বুঝতে পারি। বোকা মানুষের দুঃখ, উপেক্ষা, যন্ত্রণা আমি জানি। আর তাই বোকা মানুষ কীভাবে খুশি হতে পারে আমি সেজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। আমার ধারণা বোকা মানুষকে যদি আমি বোঝাতে পারি তাহলে আর সবাইকে বোঝাতে পারব। আর তাই ক্লাসে পড়ানোর সময় আমি কখনই ভালো ছাত্রটার জন্য চিনত্মা করিনি। আমি ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ, বোকা ছাত্রটাকে পড়ানোর চেষ্টা করেছি। কারণ আমি জানি বোকা ছাত্রটা যদি আমার ক্লাসের লেকচার বুঝে ফেলে তাহলে ভালো ছাত্রটাও বুঝবে। যে কারণেই বোধকরি ছাত্ররা আমাকে ভালোবেসেছে।
আনন্দ আলো: ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে আপনি কীভাবে দেখেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: অবশ্যই বন্ধুর মতো সম্পর্ক হওয়া উচিত। তবে আমি একটা অবাক ব্যাপার লক্ষ্য করতাম। যখন ক্লাস নিতাম তখন দেখতাম ছাত্ররা আমার কথা শুনে খুশি হচ্ছে, হো… হো… করে হাসছে কখনো, আবার কখনো বেশি সিরিয়াস। কিন্তু খুবই আশ্চর্য যে ক্লাসের বাইরে ছাত্ররা কখনোই আমার কাছে আসত না। আমার সারা জীবনে যত ছাত্রকে পড়িয়েছি তাদের মধ্যে বড়জোর ১০/১২ জন ছাত্রের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় বা সম্পর্ক হয়েছে। ছাত্ররা কেন যেন ক্লাসের বাইরে গেলেই আমার থেকে দূরে চলে যেত। এখন ভাবি আমার স্বভাবের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ত্রুটি ছিল। কেন আমি ক্লাসের বাইরে তাদের বন্ধু হতে পারিনি।
আনন্দ আলো: আপনার এই বিশ্লেষণ বোধকরি ঠিক নয়। লাখ লাখ ছাত্র আপনাকে দূর থেকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে…
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, করে। তবুও আমি বলব ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আমি তৈরি করতে পারিনি। ছাত্রদের জীবনে ব্যক্তিগতভাবে আমি জায়গা করে নিতে পারিনি।
আনন্দ আলো: এটাকে কী ব্যর্থতা বলে মনে করেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: হ্যাঁ, আমি এটাকে বড় ব্যর্থতা বলে মনে করি। কারণ একজন ছাত্রের জীবনের রক্তের কণায় কণায় একজন শিক্ষকের থাকা উচিত। শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কও থাকা জরুরি। আমার ব্যক্তিত্বের মধ্যে হয়তো কোথাও কোনো আড়ষ্টতা, কোথাও কোনো অপ্রতিভ অবস্থা আছে। ছোটবেলা থেকেই আমি ইনফিরোয়িটি কমপ্লেক্সে ভুগতাম। সবকিছু দেখালে আমার ভয় হতো। আবার যত বেশি ভয় হতো তত বেশি সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। সেই ঝাঁপিয়ে পড়াটা হয়তো ব্যর্থ হয় নাই। সামষ্টিকগতভাবে আমি হয়তো বেশ প্রিয়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার বন্ধু খুব কম।
আনন্দ আলো: এর কারণ কী?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ওই বোধহয় আমার জড়তা, আমার ভেতরের অপ্রস্তুত মানুষটা এজন্য দায়ী। যে নিজেকে মেলে দিতে পারে না, ডাক দিতে পারে না, নিজের বুকের ভেতরে জড়িয়ে নিতে পারে না… এটা ক্ষতি করেছে আমার শিক্ষক জীবনকে। মানুষের চাইতে মানবতার দিকে আমার আগ্রহ বেশি। অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে আমার ঝোঁক বেশি, আইডিয়ার দিকে ঝোঁক বেশি। ব্যক্তি মানুষের চেয়ে সিস্টেম, অর্গানাইজেশনাল ফর্মের দিকে আমার আগ্রহ অধিক। এটা আমি বুঝি। এক হাজার মানুষের সামনে আমি বক্তৃতা করতে পারব, কিন্তু একটা মানুষের সামনে ওই আনন্দ নিয়ে কথা বলতে কেন যেন সঙ্কোচ বোধ করি।
আনন্দ আলো: শিক্ষকতা জীবনে কখনো কি ত্যাঁদোড় ছাত্রের পাল্লায় পড়েছিলেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: না, আমি কখনো ত্যাঁদোড় ছাত্রের পাল্লায় পড়িনি। কারণ তারা আমার ক্লাসে একদম সুবিধা করতে পারত না। কারণ ক্লাসে সবাই আমার কথা শুনতে চাইত। যদি কেউ কখনো বাঁদরামি করতে চাইত তাহলে অন্যেরা তাকে দমন করত। ক্লাসে ছাত্ররা কখনো আমাকে প্রশ্ন করত না। কেউ করতে চাইলেও অন্যরা করতে দিত না। থাম, বসে পড়… মাতব্বর হয়ে গেছে… এইসব বলে থামিয়ে দিত। এবং আমাকে ক্লাসে সারাক্ষণ কথা বলতে হতো। এর ফলে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় যেটা- প্লেসিং, আমি তা করতে পারিনি। আমাকে করতে হয়েছে পিসিং- হে মানব জাতি তোমরা শোন… আমি ওপর থেকে কখনো কথা বলতে চাইনি। আমার মধ্যে পিতৃ হৃদয় নাই, প্রবীণ মানুষের হৃদয় নাই। সনত্মানের হৃদয় নাই, আমার মধ্যে একটা হৃদয়ই আছে। তা হলো বন্ধুর হৃদয়। আমি সব মানুষকে সমান মনে করি। আমি কয়েকদিন আগে জন্মেছি বলে আরেকজন আমার চেয়ে ছোট, প্রকৃতির চক্রানেত্ম আমি একটু আগে পৃথিবীতে এসেছি, এজন্য আমি একটা কিশোরের চেয়ে বড়, ৭০ বছর বয়সেও তা ভাবি না। আমার চেয়েও অনেক মেধাবী কিশোর পৃথিবীতে আছে। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য কিশোর পৃথিবীতে আছে। সুতরাং মানুষের সঙ্গে মানুষের একটাই সম্পর্ক আমি বুঝি- বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্ক।
এবি/টিআর