বিভাগের সম্পাদক

পৃথিবীর কোনো জাতির ইতিহাসে আমাদের মতো শোকাবহ আগস্ট আছে কিনা জানা নেই। আমাদের জাতীয় জীবনে গভীরতম শোকের মাস আগস্ট। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি- জাতির অবিস্মরণীয় নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ১৫ আগস্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। এই আগস্ট মাসেই আমরা স্মরণ করি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, এ মাসেই তাঁরও অনন্ত যাত্রা। বাংলা সাহিত্যের আর এক দিকপাল কাজী নজরুল ইসলামও চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন এ আগস্টে। কবি শামসুর রাহমান, কথাসাহিত্যিক মাহবুবউল আলম, বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ-এর মৃত্যুবার্ষিকী এ মাসেই। বাংলা ও বাঙালির এই অবিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর প্রয়াণ মাসই শুধু আগস্ট মাসকে শোকাভিভূত করেনি, আবহমান বাংলার সামগ্রিক ব্যবস্থার সঙ্গেও একাত্ম করে রেখেছে।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যকার পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এ মাসটি আমাদের জন্য দুঃখের, লজ্জা এবং অসহনীয় কষ্টের। যত দিন যাচ্ছে গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, ইতিহাসবিদগণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনের উদ্দেশ্যকে তত্ত্ব-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরবার চেষ্টা করছেন, যথেষ্ট না হলেও সময় লাগবে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের। তবে আমি মনে করি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত রাজনৈতিক প্রবাহ বা ধারাকে আমূল দিক পরিবর্তনের একটি কুপ্রচেষ্টা ছিল। শুধু দিক পরিবর্তন বলি কেন বরং বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনাশ্রিত গতিধারা চিরতরে রুদ্ধ করে বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত রাজনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিরোধী একটি উদ্ভট দর্শন এবং প্রক্রিয়া চালু করবার অপচেষ্টা হয়েছে।
হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এবং বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে যে জনপদের বাস সেই জনপদের সংস্কৃতিতে সর্বত্রভাবে অনুধাবন এবং আত্মস্থ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর রাজনৈতিক চর্চায় তিনি এই জনপদের মানুষের আশা-আকাঙ্‌ক্ষার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে জীবন দর্শন হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। হয়েছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালি জাতির। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা এবং অতিবিপ্লবের স্লোগানধারীরা তাই আন্তর্জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের দেশীয় এজেণ্ডা হিসাবে এই মহানায়ককে নিষ্ঠুর, বর্বরভাবে হত্যা করেছিল। এ শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা নয়, বাংলাদেশের হৃদয়কে কেটে-ছিঁড়ে রক্তাক্ত করা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। তাঁকে বাদ দিয়ে দেশকে কল্পনা করা যায় না। যতদিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রবাহিত হবে, এ ভূখণ্ডে জনপদে মানুষের বসবাস থাকবে, ততদিন পর্যন্ত অমর হয়ে থাকবেন এই মহান নেতা। তাঁর অবদান গগনচুম্বী। তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। তাঁর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও নেতৃত্বগুণে তিনি কোটি মানুষের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় সাহসী, নির্লোভ, আপসহীন ও তেজস্বী নেতা। তিনি জীবনে কারো কাছে মাথা নত করেন নি। ভয়, সংশয় ও প্রতিহিংসার ঊর্ধ্বে ওঠে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন পরিচালিত করেছেন। বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রশ্নে তিনি সব সময়েই সোচ্চার ছিলেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে আদায় করে নিতেন সকল দাবি।
এমন এক অবিসংবাদিত নেতাকে হত্যা করা হলো সপরিবারে, যা শুধু নৃশংস নয়, নারকীয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড স্বতঃস্ফূর্ত কোনো ব্যাপার ছিল না বা তাৎক্ষণিক অসন্তোষের কোনো কারণও নয়। তাহলে শুধু তাঁকে হত্যা করা হতো, পরিবার-পরিজনকে নয়। অনেক ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা করে তাঁকে হত্যা করা হয়। যারা খুন করেছিল আজ প্রশ্ন উঠতে পারে তারা কি প্লানটেড ছিল? সবচেয়ে বড় আশ্চর্য ও দুঃখের বিষয় যে, এ হত্যাকাণ্ডের যাতে কোনো বিচার না হয়, তার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়। শুধু-তা নয়, যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিদেশে পাঠিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে।

বাঙালির জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধুর আত্মদান আজও বিপন্ন আর পথভ্রষ্ট মানুষদের যথার্থ দিকনির্দেশনা। নিজেকে নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তেজদীপ্ত উন্মাদনা, অমিত সাহস আর দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের এক লড়াকু সৈনিকের আসনে। দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, নিজস্ব সাংস্কৃতিক সম্পদ নিয়ে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পর থেকে শোককে শক্তিতে পরিণত করার যে প্রক্রিয়া চলছে, আমাদের বিশ্বাস- সেই শক্তিতেই আমরা একদিন বিশ্বমঞ্চে বাঙালি জাতি হিসাবে শির উঁচু করে দাঁড়াবো। আমাদের ভেতরে অবিনাশী শক্তি হিসেবে প্রেরণা জোগাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এবি/টিআর ২-৮-২০১৯

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here