বাজারে পেঁয়াজের দাম আরেক দফা বাড়ল। গতকাল রোববার রাজধানীর তিন পাইকারি বাজারে এক দিনে চার দেশের পেঁয়াজের কেজি ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সকালে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, বিকেলে তার চেয়ে বেশি দাম চাইছেন বিক্রেতারা।
বাজারের এই অস্থিতিশীল আচরণের কারণ সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি। রাজধানীর পাইকারি বাজার ও ঢাকার বাইরের বাজার ঘুরে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, পেঁয়াজের সরবরাহ খুব কম। গতকাল খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ ২৪০-২৫০ টাকা, মিসরীয় ও চীনা ভালো মানের পেঁয়াজ ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
অবশ্য সরকারি কোনো কোনো সংস্থা ঘাটতির কথা এখনো মানছে না। পেঁয়াজের ঘাটতি নিয়ে দুই ধরনের কথা এল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক বৈঠকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, সরবরাহ ও যৌক্তিক মূল্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে গতকাল মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দুই মন্ত্রী, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীরা।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের (বিটিসি) সদস্য আবু রায়হান আল বেরুনি বলেন, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন মনে করে পেঁয়াজের আমদানি ও মজুত স্বাভাবিক রয়েছে। কোনো ঘাটতি নেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘বাজারে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি নেই। আপনারা পেঁয়াজের কথা বলেন, বাজারে আছে তো সব।’
অন্যদিকে গত কয়েক দিনে উড়োজাহাজে ৪০০ টনের মতো পেঁয়াজ আসার কথা জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের যা লাগবে, সব আছে, এটা বললে ঠিক কথা বলা হবে না। তাহলে এই হিসাব কেন দিলাম যে আমাদের আনতে হচ্ছে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী নতুন করে আরেকটি আশ্বাস দেন। সেটি হলো, ১০ দিনের মধ্যে আমদানি করা বড় চালান এসে যাবে ও দেশি পেঁয়াজ উঠবে।
অবশ্য এমন আশ্বাস মানুষ আগেও পেয়েছে। ট্যারিফ কমিশনের যে সদস্য গতকালও ঘাটতি নেই বলে দাবি করলেন, তিনি এর আগে ১৬ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম কমবে মন্তব্য করেছিলেন। এরপর পেঁয়াজের কেজি ২৫০ টাকায় উঠেছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বিভিন্ন সময় সরবরাহ বৃদ্ধির আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু বাজারে সরবরাহ সেভাবে না বাড়ায় দাম দিন দিন আরও উঁচু ডালে উঠেছে।
এফবিসিসিআইয়ের বৈঠকে সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, এক সপ্তাহের মধ্যে জাহাজ চলে আসবে। সিটি গ্রুপ এই চালানে আড়াই হাজার টন পেঁয়াজ আনছে। বৈঠকে উপস্থিত মেঘনার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ ইকবালও প্রথম আলোকে জানান, তাদের বড় একটি চালান ১ ডিসেম্বর দেশে আসবে।
জাহাজে আনা পেঁয়াজের দাম কত দাঁড়াবে, তা–ও জানিয়ে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, কেজিপ্রতি মোট ব্যয় ৩২ টাকার মতো পড়বে। সেটা ৬০-৭০ টাকায় খুচরা বাজারে পাওয়া যাবে। এ সময় ব্যবসায়ীরা বলেন, আরও কম দামে মিলবে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভয়ে ভয়ে একটু বাড়িয়ে বললাম।’
অবশ্য বড় চালান আসার আগে পেঁয়াজের পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটাই দেখার বিষয়। কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানে (৫ কেজি করে কেনা যায়) শনিবার যে দেশি পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ২০০ টাকা ছিল, সেটা গতকাল বিকেলে ২২০ টাকার কমে বিক্রিতে রাজি হননি বিক্রেতারা।
শ্যামবাজারে মিসরের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ১৩০-১৪০ টাকা ও কারওয়ান বাজারে ১৫০ টাকা দরে। ভালো চীনা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকা দরে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ ২০০-২২০ টাকা ও পাকিস্তানি পেঁয়াজ ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
‘অহেতুক দাম বাড়ালে শাস্তি’
এফবিসিসিআইয়ের বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। বৈঠক শেষে ভারত নিজ রাজ্য মহারাষ্ট্রের নির্বাচনের পর পেঁয়াজ রপ্তানি খুলে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ‘সফরকালে ভারত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও কথা দিয়েছিল যে নির্বাচনের পর পেঁয়াজ রপ্তানি খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দুর্ভাগ্য, তারা খুলে দেয়নি।’
২৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পরের সপ্তাহেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। সফরসঙ্গী ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও।
ভারত নিজেদের বাজার সামাল দিতে ২৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়।
এক সাংবাদিক খাদ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, সরকারি হিসাবে দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। তাহলে দাম বাড়ল কেন? জবাবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘চালের দাম বাড়েনি। যেটুকু বেড়েছে, খুচরা বাজারে বেড়েছে।’
বৈঠকে তাহলে কী হলো—এ প্রশ্নের জবাব দেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, একটি সোজা বার্তা দেওয়া হয়েছে, যদি কেউ মজুতদারি করে, অহেতুক দাম বাড়ায়, তাহলে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে।