দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা আমাদের দায়িত্বশীলদের পুরনো প্রবণতা, বিশেষ করে মন্ত্রীদের। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের মতো এডিস মশার প্রজনন ঠেকানো যাচ্ছে না। একইদিন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেন, ডেঙ্গু নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
কিন্তু গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এসব কথায় সমালোচনার ঝড় শুরু হলে তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই বলেন, দায়িত্বশীল পদে থেকে দায়িত্বহীনের মতো কথা বলা উচিত নয়।
যার বা যার পরিবারের কারো ডেঙ্গু হয়েছে তিনি ও তারা জানেন এর যন্ত্রণা। হাসপাতালে সিট নেই; মেঝেতে, লিফটের সামনে এমনকি ডাক্তাররা রোগী দেখেন যেখানে, সেখানেও এখন ডেঙ্গু রোগী। সারা দেশে তো বটেই, শুধুমাত্র ঢাকা শহরের কয়েকট বড় হাসপাতাল কেউ ঘুরে এলে দেখতে পারবেন ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। যারা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাননি তাদের পক্ষে এটি আন্দাজ করাও অসম্ভব।
সুতরাং ঈদযাত্রার আনন্দে মানুষ ডেঙ্গুর কথা ভুলে গেছে—এরকম রসিকতা অন্তত ওবায়দুল কাদেরর মতো সিনিয়র ও সজ্জন রাজনীতিবিদ এবং দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তির মুখে শোভন নয়।
উত্তরবঙ্গে রেল ও সড়কপথে এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ বিগত অনেক বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়; ৬ ঘণ্টার পথ ২৪ ঘণ্টায় পার; সন্ধ্যার বাস পরদিন দুপুরেও না ছাড়া; পরিবার-পরিজন আর ব্যাগবস্তা নিয়ে রেলেস্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে।
এ কথা ঠিক যে, প্রতি বছর দুটি ঈদে কোটিখানেক লোকের একসঙ্গে কোনো একটি শহর ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বেই বিরল। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উঠতি অর্থনীতির দেশে যেখানে সড়ক ও রেল অবকাঠামো এখনও ১৭ কোটি মানুষের উপযোগী ও পর্যাপ্ত নয়।
সুতরাং একসঙ্গে এত লোকের বাড়ি যাওয়া এবং উৎসব শেষে আবার শহরে ফিরে আসা একটি বিশাল যজ্ঞ। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপে নিশ্চয়ই ঘাটতি আছে। ঘাটতি, গাফিলতি, বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব যে বড় দায়ী, সে বিষয়েও দ্বিমত পোষণের সুযোগ কম। সুতরাং পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে দলে দলে মানুষ যাবে, এই আবেগ ও বাস্তবতাকে স্বীকার করে একসঙ্গে এত লোকের একটি শহর ছেড়ে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যাওয়া এবং উৎসব শেষে ফিরে আসার মতো প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠানো নির্মাণের দায়িত্ব প্রধানত সরকারের।
কিন্তু যতক্ষণ না তারা সেই কাজটি সুচারুরূপে করতে পারছে, ততক্ষণ তার দায়িত্বশীলদের হুঁশ করে কথাবার্তা বলাই বাঞ্ছনীয়। মানুষের আবেগের প্রতি সম্মান দেখানোই রাজনীতিবিদদের প্রধান কাজ। তারা সেটিতে ব্যর্থ হলে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মন জয় করতে পেরেছিলেন তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখানোর কারণেই। যে কারণে বলা হয়, মানুষের পালস বুঝতে পারাই পলিটিশিয়ানের প্রধান যোগ্যতা।
যদিও ঈদযাত্রার দুর্ভোগকে মানুষ আনন্দ মনে করে—এ কথা বলার পরদিনই ওবায়দুল কাদের মহাসড়কে দুর্ভোগের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। প্রশ্ন হলো, আগের দিনের কথাটি তিনি কি না বুঝে বলেছিলেন নাকি পরের দিনের দুঃখপ্রকাশ নিতান্তই সমালোচনা এড়ানোর জন্য?
আমাদের রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা ও কাজেকর্মে ডাবল স্ট্যান্ডার্ডও নতুন কিছু নয়। কিন্তু সবার কাছ থেকে মানুষ এ ধরনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রত্যাশা করে না। বিশেষ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে যে দলের নেতৃত্বে, যে দলটির প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভরসা ও আস্থা—সেই দলের নীতিনির্ধারক তো বটেই, মাঝারি মানের নেতাদেরও কথাবার্থায় যথেষ্ট সতর্ক ও সংযত থাকা প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। আলোকিত বোয়ালখালী-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। লেখার বিষয়বস্তু এবং বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্বও লেখকের। অনুরূপভাবে মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।)