অধ্যক্ষ শেখ এ۔রাজ্জাক রাজু

“শিক্ষিত লোকের অভাব নেই এই পৃথিবীতে কিন্তু শিক্ষিত বিবেকবান মানুষের বড্ড অভাব l” আমার উপলব্ধিতে শিক্ষা মানে শুধু সনদ অর্জন নয় বরং যে অর্জিত জ্ঞান, চর্চার মাধ্যমে সামাজিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করা এবং জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার নানাবিধ কৌশল আয়ত্ত করার অভিজ্ঞতাই হলো শিক্ষা”l আশাবাদী মানুষেরা সবসময় স্বপ্ন দেখে নতুন কিছু করার l

আপনি লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক গবেষক কবি যেই হোন না কেন; আপনার লেখনীর মাধ্যমে যদি একজন মানুষও উপকৃত হয়- তাতে ক্ষতি কী ? কোনো মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান করেও আত্মপোলব্ধির মাধ্যমে বেঁচে থাকার কৌশল রপ্ত করতে পারে- ওটাই তার শিক্ষা l

আমি শিক্ষক হিসেবে প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করি এবং সমাজকে নিয়ে দু’দণ্ড সময় বের করে ” সমাজের কথা ভাবি- কী করে এই সমাজ থেকে অবিচার- অনাচার, হিংসা-বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার দূর করে সমাজে বসবাসরত মানুষের আচরণিক পরিবর্তন, পরিমার্জন, নৈতিক আচরণ, সামাজিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক পরিবেশ গঠনে সমাজের লেখক-সাহিত্যিক-কবি-গবেষক, শিক্ষক- সাংবাদিক, সমাজসেবক, রাজনীতি- বিদ, শিক্ষাবিদ স্ব -স্ব অবস্থান থেকে যদি এগিয়ে আসেন, তবে সমাজে সৎ ও আদর্শ মানুষ তৈরি করা কোনো কঠিন কাজ নয়; প্রয়োজন সততা ও সদিসচ্ছা l

” আশাবাদী সমাজের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি,”Nothing is impossible in the world.” মানুষ পরিবেশের দাস l তাই, পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে জীবন ও জীবিকার মাধ্যমে সমাজে টিকে থাকার নামই জীবন l

প্রসঙ্গত, ২১ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়ানো এক আদর্শ শিক্ষকের নাম টমাস হাওলাদার যিনি রাজধানীর একটি নামকরা কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অন্যতম পরিচালক ও শিক্ষক l দীর্ঘ ১৬ মাসব্যাপী মহামারী করোনার কারণে সরকারের নির্দেশনায় নন- এমপিও স্কুল- কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার আর্থিক অনুদান বা সহায়তা না পাওয়ার কারণে এদেশের লাখ লাখ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকেরা মানবেতর জীবন-যাপন করছে l জীবন ও জীবিকার তাগিদে থমাস হাওলাদার তার স্কুলের সামনে ফুটপাতে যিনি বর্তমানে সবজি বিক্রেতাl এরূপ থমাস হাওলাদারের মতো হাজার হাজার শিক্ষক,পরিবার- পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন- যাপন করছে, তারা না পারছে কাউকে কইতে (বলতে) না পারছে সইতে l যাঁরাই দেড় বছর আগেও কোটি কোটি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মানের পূজনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন অথচ তাঁরা আজ তথাকথিত সমাজের কাছে উপহাস ও অবহেলার পাত্র !

অনেক শিক্ষককে আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, করোনার আগে অনেকেই সন্মানের সাথে সালাম দিয়ে বলতো, ‘স্যার কেমন আছেন’? আর করোনা কালীন সময়ে মাঝে মধ্যে তাদের সাথে দেখা হলে কেউ কেউ বলে, ” মাস্টর সাব কা’ন (কেমন চলে দিনকাল) চলের? আমি শিক্ষকদেরকে বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই, এ জাতীয় তথাকথিত লোকদেরকে জবাব দিবেন এভাবে, “আই আ’ম নো বডি” l দিস ইজ মাই রিকোয়েস্ট- ইট ইজ কলড “টিট ফর ট্যাট” l তাদেরকে আরো স্মরণ করিয়ে বলা অত্যুক্তি হবে না যে,” এক মাঘে শীত যায় না” l কবি কালী প্রসন্ন ঘোষ তাঁর কবিতায় চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কথা বলে গেছেন , ‘ পাঁচ জনে পারে যাহা, তুমিও পারো তাহা, পারো কী না পারো করো যতন আবার; একবার না পারিলে দেখো শতবার l’

লকডাউনের নামে গার্মেন্টস সেক্টরসহ বাজার বিভিন্ন অফিস আদালত, শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাগারে বন্ধ রেখে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সমাজকে একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন শুধু তাই নয়, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের পথের ভিখেরি বানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রীর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে l সরকার বিষয় বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর কথা না রেখে কার কথা রাখলেন- তা আমাদের বোধগম্য নয় l

অথচ এই ১৬ মাস ব্যাপী শিশু থেকে ১৮ বছর বয়সী মানুষের সংক্রমণের হার(২-৭) শতাংশের নিচে তথাপিও সপ্তাহে তিন বা চার দিন করে তিন ঘন্টাব্যাপী স্কুল-কলেজ খুললে মহাভারত অশুদ্ধি হতো না এবং সংক্রমণ বেড়ে সব মানুষ মারাও যেত না l সরকার একমাসের জন্যে হলেও স্কুল খুলে দিয়ে ট্রায়াল দিতে পারতেন কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর এটাই হয়তো বা সরকারের বদ্ধ ধারণা l

বৈশ্বিক করোনা যখন গোটা বিশ্বকে সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে তখনো এক শ্রেণির “আমরা” আমাদের নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি l কেউ কেউ আবার “আখের গোছানোর” কাজে ব্যস্ত সময় পার করছিl ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং করোনার লাগাম টেনে ধরতে পারছে না বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা l বাংলাদেশেও প্রায় পনেরো হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এবং সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে l সব কিছুতেই আমাদের বাড়াবাড়ি একটু বেশিl

পাশের বাড়ির কুদ্দুছের পরিবার তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সাত দিনের ট্যুরে গেছে , চলো আমরা দশ দিনের জন্য বিদেশে ঘুরে আসি l এ যেন নীরব প্রতিযোগিতা চলছে এদেশে l অথচ চলমান জীবনের সাথে মাস্ক ও সামাজিক দূরত্ব যে যুক্ত হলো তা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি l

অনলাইনে ক্লাস করা ছেলে-মেয়েদের একঘেয়েমি দূর করতে বাবা- মায়েরা বেড়াতে নিয়ে গেছেন সমুদ্র সৈকতে বা কোনো পাহাড়ে, রেস্টুরেন্টে বা দূরে কোথাও ! অথচ এসব ছেলেমেয়েদের জীবন বাঁচাতে সরকার দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছেন- অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই মহামারীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে “শিক্ষা ব্যবস্থা” কিন্তু শিক্ষা খাতকে মূল্যহীন ভেবে বন্ধ রেখেছেন বোধ করি সরকার, নইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে এতোটা উদাসীন কেন?

পরিশেষে, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করছি- ” তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন”?

অধ্যক্ষ শেখ এ۔রাজ্জাক রাজু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খণ্ডকালীন) ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক; প্রাবন্ধিক, সমাজচিন্তক-গবেষক ও সংগঠক l

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here