তানজিম আল ইসলাম

কপিরাইট হচ্ছে মেধার মালিকানা। কপিরাইট যে শুধু কোনো বইয়ের ওপরই হয় তা কিন্তু নয়। বই ছাড়া আরও কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে কপিরাইট দাবি করা যায়। যেমন চলচ্চিত্র, সংগীত কিংবা নাটক, সফটওয়্যার প্রভৃতি। এসবের কপিরাইট সুরক্ষার জন্য লেখক বা প্রণেতার উচিত তাঁর সৃষ্টকর্মটির নিবন্ধন করিয়ে নেওয়া। যেকোনো সৃজনশীল ও মৌলিক কাজের ওপর প্রণেতার একচ্ছত্র যে অধিকার জন্মে তা-ই হচ্ছে কপিরাইট। কেউ যদি কপিরাইট ভঙ্গ করে নকল করেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার পেতে সুবিধা হয়। কোনো সৃষ্টিকর্মের কপিরাইটের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হলে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত কপিরাইট কার্যালয় থেকে নির্ধারিত আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কপিরাইট কিসে হয় এবং নিবন্ধন করার নিয়মকানুন।

 কম্পিউটার সফটওয়্যার

প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত উভয় ধরনের সফটওয়্যার কর্ম নিবন্ধন করা যায়। কপিরাইট আইন, ২০০০-এর বিধানমতে সফটওয়্যার কর্মের কপিরাইটের মেয়াদ যে বছর কর্মটি প্রথম প্রকাশিত হবে তার পরবর্তী পঞ্জিকাবর্ষের শুরু থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত। সফটওয়্যার নিবন্ধনের জন্য কপিরাইট অফিস থেকে সংগ্রহ করে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে তিন কপি আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। সফটওয়্যার কর্ম সিডি আকারে দুই কপি ও প্রিন্ট আকারে দুই কপি দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় নির্দিষ্ট কোড নম্বরে (অফিস থেকে জেনে নিতে হবে) এক হাজার টাকা ট্রেজারি চালান করে তার মূল কপি, একটি ফটোকপি, কর্মটি মৌলিক মর্মে এবং আদালতে কোনো মোকদ্দমা বিচারাধীন নেই ও প্রদত্ত তথ্য নির্ভুল ঘোষণাসংবলিত ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি এবং পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি সত্যায়িত ছবিও জমা দিতে হবে।

সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের নামেও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা যায়। এ জন্য উল্লিখিত কাগজপত্রের সঙ্গে কোম্পানির মেমোরেন্ডাম, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সার্টিফিকেটের সত্যায়িত ফটোকপি দাখিল করতে হবে। নিয়োগকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠান স্বত্বাধিকারী হলে সৃজনকারীকে প্রতিষ্ঠান-প্রদত্ত নিয়োগপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হবে। হস্তান্তর সূত্রে মালিক হলে তিন শ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে কপিরাইট হস্তান্তর দলিল। কপিরাইট নিবন্ধন সনদ পেতে ৩০ দিন সময় লাগে। কখনো কখনো আরও কিছুদিন সময় লেগে যেতে পারে।

 শিল্পকর্ম

শিল্পকর্মের বেলায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত উভয় ক্ষেত্রে কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। শিল্পীর জীবনকাল ও তাঁর মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত শিল্পকর্মটির কপিরাইট তাঁর থাকবে। শিল্পকর্ম ও সফটওয়্যারের ÿক্ষেত্রে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া একই রকম এবং একই ধরনের দলিলাদি জমা দিতে হবে। ফিও একই রকম। তবে আবেদনের সঙ্গে অবশ্যই তিন কপি শিল্পকর্ম শক্ত কাগজে পেস্ট করে দিতে হবে।

 সাহিত্যকর্ম

পাণ্ডুলিপি ও বই—এ দুয়ের জন্যই কপিরাইট নিবন্ধন করা যায়। লেখকের জীবনকাল ও মৃত্যুর পর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইট বহাল থাকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের নিয়ম একই রকম। তবে দুই কপি পাণ্ডুলিপি বা বই জমা দিতে হবে। বইয়ের ক্ষেত্রে লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে আলাদা চুক্তি করে তা নিবন্ধন করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ৮০০ টাকা ফি জমা দিয়ে নির্ধারিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তি সম্পাদন করে নিতে হবে। এ চুক্তির মধ্যে স্বত্ব নিয়োগের অধিকার, রয়্যালটির পরিমাণসহ যাবতীয় শর্তাবলি উল্লেখ করে নিতে হবে। এর মাধ্যমে প্রকাশক অর্থনৈতিক অধিকার এবং লেখকের নৈতিক অধিকারসহ প্রাপ্য পাওনা দাবি করার সুযোগ পাকাপোক্ত হবে।

 সংগীত

সংগীতের গীতিকার ও সুরকার হচ্ছে আইনত প্রণেতা ও কপিরাইটের মালিক। কণ্ঠশিল্পী, প্রযোজক ও ব্রডকাস্টিং অরগাইনেজেশন হচ্ছে রিলেটেড রাইটসের অধিকারী। তবে কপিরাইট ও রিলেটেড রাইটস মূলত একই অধিকার বহন করে। সংগীত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত দুই ক্ষেত্রেই নিবন্ধন করা যায়। গীতিকার ও সুরকারের কপিরাইট হচ্ছে জীবনকাল ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর। কণ্ঠশিল্পীর ক্ষেত্রে মেয়াদ ৫০ বছর। আর প্রযোজকের ক্ষেত্রে ৬০ বছর ও ব্রডকাস্টিং অরগানাইজেশনের বেলায় ২৫ বছর পর্যন্ত কপিরাইটের মেয়াদ থাকে। কপিরাইট নিবন্ধনের জন্য আবেদনের নিয়মকানুন একই রকম।

 নাটক ও চলচ্চিত্র

নাটকের প্রণেতা হলেন নাট্যকার কিংবা গ্রন্থকার। তিনি জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত কপিরাইটের মালিক। নিবন্ধন আবেদনের প্রক্রিয়া একই রকম। চলচ্চিত্রেরÿক্ষেত্রে প্রণেতা হলেন চলচ্চিত্রের প্রযোজক। তিনি কপিরাইটের অধিকারী। যে বছর চলচ্চিত্রটি প্রথম প্রকাশিত হবে তার পরবর্তী পঞ্জিকাবর্ষের শুরু থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত মালিকানা বহাল থাকে। চলচ্চিত্রের কপিরাইটের আবেদনের প্রক্রিয়া অন্যান্য কর্মের আবেদনের মতোই। তবে চলচ্চিত্রের সেন্সর ছাড়পত্র জমা দিতে হবে এবং চলচ্চিত্রটি সিডি আকারে দুই কপি জমা দিতে হবে। এ ছাড়া যেকোনো রেকর্ড-কর্মের জন্যও কপিরাইট নিবন্ধন করানো যায়।

 কপিরাইট ভঙ্গ করলে প্রতিকার

কেউ যদি কোনো লেখক বা প্রণেতার বই বা কোনো সৃষ্টকর্ম নকল করেন, তাহলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রতিকার চাইতে পারবেন। শাস্তি হিসেবে কপিরাইট ভঙ্গকারীর হতে পারে চার বছরের জেল ও সর্বনিম্ন ছয় মাসের জেল। সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকার জরিমানা ও সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর ও সর্বনিম্ন এক বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ লাখ ও সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা জরিমানা। ফৌজদারি বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে। এ ছাড়া জেলা জজ আদালতেও ক্ষতিপূরণ ও নিষেধাজ্ঞার প্রতিকার চাওয়া যাবে।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here