আবু আফিয়া আহমদ : সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠ, নির্ভিক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম-৮ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) মঈন উদ্দীন খান বাদল গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে ভারতের বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদরোগ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং স্বাধীনতার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ ছিল সব সময় সোচ্চার। তার এই বলিষ্ঠ কণ্ঠ জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে যে কোন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় দেখা যেত। পশ্চিমা দেশে মগজধোলাইকৃত এক শ্রেণীর অতি ধার্মিকদের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ইসলামী জিহাদের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে যে জঙ্গি বানানো হচ্ছে সে বিষয় তুলে ধরেও তিনি বক্তব্য প্রদান করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্র-ধর্মান্ধদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সময়োচিত বক্তব্য পবিত্র সংসদে উপস্থাপন করারও সুযোগ তিনি পেয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ বুদ্ধিজীবী ও সুধিমহলে নিন্দিত ও সমাদ্রিত ছিল। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপন করা গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় তিনি তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যাদের কথায় হাইকোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর কথা বলা হচ্ছে আগামীতে তারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য সরাতে বাধ্য করবে।’ তার মৃত্যুতে জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মর্মাহত।

তিনি কতটুকু অসম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে শ্রদ্ধা করতেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পবিত্র সংসদে ও বিভিন্ন মিডিয়াতে দেয়া বক্তব্য। ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা উল্লেখ করে সংসদে দেয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন দেখেছেন তখন এই মহান নেতা ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি অদ্ভুদ সুন্দর, সাবলিল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘আমার বাংলাদেশে, আমার মানুষরা যার যার ধর্ম নির্বিঘেœ, নিঃসংকোচিত্তে আনন্দের সঙ্গে পালন করবে।’ একটা ছোট প্রত্যাশা। পুলিশ দিয়ে পাহাড়া দিয়ে দুর্গাপূজা হবে, ওই দুর্গাপূজা হয় না, পুলিশের পাহাড়ায় আপনি বৌদ্ধদের উপাসনা কারবেন, তা হয় না। বঙ্গবন্ধু এটুকু স্বপ্নই দেখেছেন। সেদিন বাদল আরও বলেছিলেন, আমি এই পার্লামেন্টে বলতে চাই, ইফ ইউ মাইনাস ধর্ম নিরপেক্ষতা, তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব কিন্তু অস্তিত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৭২ এ কোলকাতার যুগান্তরকে বঙ্গবন্ধু এক স্বাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে সেখানে বলেছেন ‘আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এ চারা যদি কেউ ছিঁড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।’ ধর্মের নামে সমাজে ও দেশে যারা নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা করে তাদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ দিয়ে মইনুদ্দিন খান বাদল বলেছিলেন, ধর্মের নামে যারা জঙ্গি কার্যক্রম করে তারা কি পবিত্র কোরআনের কোন একটি স্থান থেকে দেখাতে পারবে, যেখানে জঙ্গি কার্যক্রমের শিক্ষা রয়েছে বা মানুষ হত্যার কথা বলা হয়েছে। যদি তারা এটি দেখাতে পারে তাহলে আমিও তাদের দলে যোগ দেব। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে ধর্ম নিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি, এর অর্থ ধর্মহীনতা বা ধর্ম বিমুখতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়করা নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমান- এই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা। আর এ নীতিতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

তিনি জানতেন যে, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’-র ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেবার মতো ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে। আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।’ (তথ্য-‘বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ’ পুস্তক-পৃষ্ঠা-৮-১২) বঙ্গবন্ধুর ধর্ম নিরপেক্ষতা উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি ভালোভাবেই অবগত ছিলেন আর এ জন্যই বারবার জাতীয় সংসদে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি তিনি তার বক্তব্যে তুলে ধরতেন। স্বাধীনতার এতটি বছর অতিক্রম করার পরেও এ শান্তিপ্রিয় দেশে যারা ধর্মের নামে রাজনীতি ও বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় জাতি তাদের চিনতে ভুল করেনি আর এ বিষয়টিই তিনি তার বক্তব্যে ও সাক্ষাৎকারে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। মৃত্যুর বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই (মৃত্যুর) মানসিকতা নিয়েই যুদ্ধ করেছি। জয়লাভ করেছি। সেই থেকেই আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। খালি হাতে এসেছিলাম। খালি হাতেই যাব। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

[লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট]

abu.afia2016@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here