বিভাগীয় সম্পাদক:
গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি একটা সময়। বন্ধুদের কাছে শুনলাম কলকাতার পার্ক সার্কাসের তারক দত্ত রোডে বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের অন্যতম অগ্রপথিক মনীষী কাজী আবদুল ওদুদের বসত বাড়ির হাত বদল হচ্ছে। ওদুদের বংশধররা থাকেন বাংলাদেশে। তারা বাড়িটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ওদুদের ব্যবহৃত বইপত্রগুলো সব পুরনো খবরের কাগজওয়ালা ডেকে সের দরে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে জানালাম এ যুগের ভোলতেয়ার অন্নদাশঙ্কর রায়কে। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। কাজী আবদুল ওদুদ সম্পর্কে অন্নদাশঙ্করের ছিল সীমাহীন শ্রদ্ধা। নির্দেশ দিলেন বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে। তারক দত্ত রোডে গিয়ে দেখা গেল ওদুদ সাহেবের বাড়িটি তখন হাত বদল হয়ে গেছে। কিনেছেন এক অবাঙালি। তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। তবে এটা বুঝেছেন, যার বাড়ি তিনি কিনেছেন, সেই মানুষটি একজন বিশিষ্ট্য ব্যক্তিত্ব। এটা বোঝার পর ওদুদের কিছু পাণ্ডুলিপি তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন। সেগুলো তিনি আমাকে দেখালেন। গভীর বিস্ময়ে দেখলাম, পবিত্র কোরানের ওদুদ কৃত অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। অনুলিখিত। বাড়ির নতুন মালিক এক কথায় বললেন, এগুলো আপনি নিয়ে যেতে পারেন। তিনি আমাকে চেনেন না, জানেন না, অথচ এ অমূল্য সম্পদ দিয়ে দিতে চাইলেন- সেই নবপরিচিত মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে এলো। দেখালেন, ওদুদ ব্যবহৃত কয়েকটি জিনিস। যেমন, একটি ইজি চেয়ার, লেখার টেবিল ইত্যাদি। যেগুলো তিনি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। সরকার বাহাদুর যদি সেগুলো সংরক্ষণ করতে চান, তাহলে সেগুলো দিয়ে দিতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই- এককথায় জানিয়ে দিলেন মহম্দ আসলাম, বাড়িটির নতুন মালিক। বাড়িতে তখন স্তূপাকৃতি কাগজপত্রের ভেতরে রয়েছে ওদুদের শাশ্বত বঙ্গের প্রথম সংস্করণের কিছু কপি। রীতিমতো শিহরণ হচ্ছিল।
পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে তখন-ই ছুটলাম অন্নদাশঙ্করের কাছে। উনি পরম যত্নে সেগুলো দেখলেন। বললেন; এই দেখো মাঝে মাঝে বাঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখাগুলো ওদুদ সাহেবের নিজের। ওর হাতের লেখা এমনিতেই বেশ অপাঠ্য ছিল। তারপর শেষজীবনে উনি মারাত্মক পার্কারসন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অন্যের সাহায্য নিয়ে লিখতেন। অন্নদাশঙ্করই ব্যবস্থা করে পাণ্ডুলিপিগুলো জমা করে দিলেন বাংলা আকাদেমিতে। সেই সময়ে ওদুদের যেটুকু বই, পাণ্ডুলিপি এবং ব্যবহৃত জিনিসপত্র বেঁচে আছে, সেগুলোর সংরক্ষণ এবং তারক দত্ত রোডটির নামকরণ যাতে ওদুদের নামে হয়- সে বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছিলেন অন্নদাশঙ্কর। তার এ উদ্যোগকে কেবল সমর্থন নয়, নিজেরা ঘোরাঘুরি করে কর্তাব্যক্তিদের কাছে এ ভাবনার বাস্তবায়নে সেদিন দু’জন মানুষ আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একজন হলেন আবদুর রাউফ। অপরজন সুরজিৎ দাশগুপ্ত। দুর্ভাগ্যের বিষয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো একজন সংস্কৃতিবান মানুষ মুখ্যমন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্নদাশঙ্করের সেদিনের উদ্যোগ সফল হয়নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, বাংলা আকাদেমির কর্তাব্যক্তিদের ভেতরে সেদিন কেন এই ঔদাসীন্য ছিল?
কলকাতা কর্পোরেশন থেকে তারক দত্ত রোডের নাম ওদুদ সাহেবের নামে রাখার জন্য কারও কোনো আপত্তি আছে কিনা- এই রকম একটা নোটিশ খবরের কাগজে বেরোয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তখন চিকিৎসার জন্য কলকাতাতে রয়েছেন। উঠেছেন পার্ক সার্কাসের কিম্বার স্ট্রিটে নাজেশ আফরোজের মাসির বাড়িতে। ওদুদের নামে কলকাতার রাস্তার নামকরণ হচ্ছে শুনেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমাতে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন ইলিয়াস। বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় তখন জামায়াত-বিএনপি জোট। ইলিয়াস বললেন; সত্যিই অভিনন্দন যোগ্য উদ্যোগ। আজও আমরা ভাবতেই পারি না, ঢাকার কোনো রাস্তা ওদুদের নামে হবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই নোটিশ থেকে গেল নোটিশেই। নোটিশের বাস্তবায়ন আর ঘটল না। কেন ঘটল না, তাও জানা গেল না। যদি তারক দত্তর নামটা রেখে দেয়াটা বিশেষ জরুরিই হয়ে থাকত তাহলে সেই রাস্তাটির কিছুটা (রাস্তাটি অনেকটাই লম্বা) ওদুদ সাহেবের নামে নামকরণ করতে পারা যেত। যে মানুষটি শাশ্বত বঙ্গের মতোই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লালন করে গিয়েছিলেন শাশ্বত ভারতকে, অখণ্ড ভারতকে, তার প্রতি কি আমাদের এতটুকু কর্তব্যবোধ নেই? দায়বদ্ধতা নেই? কৃতজ্ঞতা নেই? ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ কোনোদিন মেনে নিতে পারেননি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ঋত্ত্বিক ওদুদ। তাই দেশভাগের পর শত প্রলোভন সত্ত্বেও যাননি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। থেকে গিয়েছিলেন ভারতবর্ষেই। থেকে গিয়েছিলেন এপার বাংলাতেই। স্ত্রী, পুত্র, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে একা নিঃসঙ্গ জীবন কার্যত যাপনের ভেতর দিয়েই সারস্বত চর্চাতে নিজেকে ব্রতী করেছিলেন- সেই মানুষটির প্রতি কোন দায়িত্ব আমরা পালন করেছি?
যিনি শেষ জীবনে ওদুদের লেখার অনুলিখন নিতেন, কিছুটা তার সেবাযতœ ও করতেন, আবদুর রাউফের কাছে শুনেছিলাম সেই মহীয়সী ব্যক্তি জীবনে ছিলেন এস ইউ সি আই দলের সঙ্গে যুক্ত। নিজের রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে তিনি ওদুদের অনুলিখন নিয়েছিলেন বলে ওদুদের লেখা হযরত মোহম্মদ ও ইসলাম, পবিত্র কোরআন (বাংলা তর্জমা) এর মতো ঐতিহাসিক, অমূল্য লেখাগুলো পেয়েছি। নিজেকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে বাংলার সমাজ সংস্কৃতিকে যিনি এতখানি প্রাণশক্তি সঞ্চারে সাহায্য করেছিলেন- কালের গতিতে তাকে আজ আর আমরা কেউ ই মনে রাখিনি। যেমন আত্মবিস্মৃত বাঙালির কাছে এখন ওদুদকেও চেনাতে হয়। জানাতে হয় তার ঐতিহাসিক অবদানকে। সম্প্রতি কিংবদন্তিতুল্য লোকসংস্কৃতিবিদ ড. আবুল আহসান চৌধুরী ওদুদ সাহেবের কিছু অগ্রন্থিত লেখা প্রকাশ করেন নিজের সম্পাদনায়। সেই মহামূল্যবান গ্রন্থে ও দেখা যাচ্ছে পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ নিয়ে প্রকাশক ভারতী বুক স্টলকে দেয়া ওদুদের চুক্তিপত্রটি। ৬ নম্বর রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটে ভারতী বুক স্টলটি আজ ও দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের এ মহামানবের স্মৃতিকে সম্বল করে।
১৩০১ বঙ্গাব্দের (১৯৯৪) ১৪ বৈশাখ বৃহস্পতিবার অবিভক্ত ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রামে কাজী আবদুল ওদুদের জন্ম। মনীষী ওদুদকে বুঝি কোনো একটি বিশেষ দেশের, বিশেষ জেলার গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না। কাজী আবদুল ওদুদ মানে একটি গোটা বাংলা, অখণ্ড বাংলা। কাজী আবদুল ওদুদ মানে একটা গোটা ভারতবর্ষ, অখণ্ড ভারতবর্ষ। ওদুদের বাংলার ভেতরে যেমন আজকের বাংলাদেশের পাংশা (এই এলাকাটি বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের আর এক পুরোধা কাজী মোতাহার হোসেনেরও স্মৃতিবিজড়িত) আছে তেমনিই আছে বিশ্বতীর্থ শান্তিনিকেতন, যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ওদুদ প্রথম নিজাম বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যে বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল; বাংলায় হিন্দু মুসলমানের বিরোধ। ওদুদের ভারতের ভেতরে আছে সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খানের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র পেশোয়ার অঞ্চল, রাজনৈতিক ভূগোলে যা আজ পাকিস্তানের অন্তর্গত। প্রেসিডেন্সি কলেজ মনে করে উনিশ শতকের নবজাগরণের নক্ষত্রদের মতোই বিশ শতকের দ্বিতীয় জাগরণের অন্যতম নক্ষত্র কাজী আবদুল ওদুদ প্রেসিডেন্সির ও। বস্তুত ওদুদ, অন্নদাশঙ্কর, রোকেয়া, সুফিয়া কামালদের কোনো দেশ হয় না। তাদের দেশ হল মুক্তবুদ্ধির পান্থজনের হৃদয়ভূমি। পাবনা জেলায় বর্তমান নিবন্ধকারের পূর্বপুরুষদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জেরে সেখানে কিছু জমিজিরেত ছিল। নিবন্ধকারের পিতৃদেব একধরনের ইতিবাচক আত্মগরিমা অনুভব করেন এই কারণে যে, ওদুদের পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল পাবনা জেলারই কসবা নামক একটি জায়গায়। আবার বর্তমান নিবন্ধকারের গর্ব তার জন্মস্থান ৬৮ এ বেগবাগান (এটি অনেকে ‘বেক’ লেখেন। এটি ভুল। বেগ সাহেবের বাগান থেকে অঞ্চলটির নামকরণ হয়েছে বেগবাগান, বেকবাগান নয়) রো থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই থাকতেন বিশ শতকের এ মহামানব।
নদিয়ার মানুষ (ব্যাপক অর্থেই ধরছি,কারণ; তাই কুষ্টিয়ার গর্ব আবুল আহসান চৌধুরী পরম যত্নে অগ্রন্থিত ওদুদ সম্পাদনা করেছেন) আত্মতৃপ্তি পান এই ভেবে যে, তাদের জেলার চাঁদপুর হল ওদুদের মাতুলালয়। ওদুদের মাতামহ পাঁচু মোল্লা ছিলেন সে যুগের নদিয়ার একজন বিশেষ সম্ভ্রান্ত মানুষ। অনেকেই মুসলমান সমাজকে খাটো করার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের উনিশ শতকজুড়ে শিক্ষার পশ্চাৎপদতা নিয়ে খোঁটা দেন। ব্রিটিশ এবং অভিজাত হিন্দু সমাজের কলকাঠি নাড়ার জেরে মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশের ভেতরে সেদিন কূপমণ্ডূকতার জগতে আত্মনির্বাসিত করে থাকার একটা প্রবণতা থাকলেও এই পাঁচু মোল্লার মতো মানুষও বাংলার মুসলমান সমাজে তখন ছিলেন, যাদের শিক্ষার দক্ষতাকে হিন্দু জমিদাররাও সমীহ না করে পারতেন না। স্থানীয় হিন্দু জমিদার জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে ওদুদের মতামহ পাঁচু মোল্লার অভিমতকে বিশেষ রকমের গুরুত্ব দিতেন। এ দেশের আপামর মুসলমান জগতের যে সময়ে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রতি একটা অনীহা ছিল, সেই সময়কালে ওদুদের মাতামহ পাঁচু মোল্লা তার সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিলেন।
১৯২৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকায় স্থাপিত হয় মুসলিম সাহিত্য সমাজ। উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের শেষ জীবিত উত্তরাধিকার অন্নদাশঙ্কর কাজী আবদুল ওদুদদের এই মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং তাদের মুখপত্র শিখাকে ঘিরে কর্মকাণ্ডকে অভিহিত করেছিলেন; বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ হিসেবে। এ আন্দোলনকে এ শিরোনামে অভিহিত করেই তিনি মাসিক নন্দন পত্রিকাতে বর্তমান নিবন্ধকারের অনুলিখনে একটি প্রবন্ধ ও লিখেছিলেন। ওদুদ ছাড়াও কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখের উদ্যোগে মুসলিম সাহিত্য সমাজকে কেন্দ্র করে সংস্কার মুক্ত মন নিয়ে বুদ্ধির মুক্তির সাধনায় বাংলার মুসলমান সমাজের যুবকদের ঝাঁপিয়ে পড়া কেবল বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। নজরুল থেকে মুজফফর আহমদ- কে না ছিলেন ওদের সঙ্গে। রমেশচন্দ্র মজুমদার থেকে মোহিতলার- কে না লিখেছেন ওদের মুখপত্র শিখাতে। সেখানেই প্রকাশিত হয়েছিল কাজী মোতাহার হোসেনের আগুনঝরা লেখা, সঙ্গীতে মুসলমানের অবদান। বাংলা তথা ভারতের রাজনীতি তখন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, খেলাফত আন্দোলন- এসব নানা ঘাত-প্রতিঘাতে তরঙ্গায়িত। কোন পথে যাবো- জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আধুনিক মনষ্ক, শিক্ষিত যুবকদের কাছে তখন তীব্র জিগ্যাসা। এই অবস্থাতে ’২৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার সলিমুল্লাহ হলে কাজী আবদুল ওদুদ পাঠ করলেন; মুস্তাফা কামাল সম্বন্ধে কয়েকটি কথা নামক ঐতিহাসিক প্রবন্ধটি।
বক্তৃতার শুরুতেই ওদুদ বললেন; আমাদের তরুণ কবির সেদিনকার যে প্রাণময় উচ্ছ্বাস- ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া ভাই’। সেদিনই ছিল আমাদের সবার অন্তরের অন্তরতম কথা। (কাজী আবদুল ওদুদ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, সম্পাদক আবদুল হক,বাংলা একাডেমি ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা-৫) বক্তৃতার অন্তিমলগ্নে ওদুদ বলছেন; কিন্তু সত্যের আঘাত বড় প্রচণ্ড। মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে গতানুগতিকতাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে নব সৃষ্টির প্রয়োজন ও সম্ভাবনা দেখিয়ে, মুসলমান সমাজের বুকে কামাল যে সত্যিকার আঘাত দিয়েছেন, আশা করা যায়, এ আঘাতেই আমাদের শতাব্দীর মোহনিদ্রার অবসান হবে। ধর্মে, কর্মে, জাতীয়তায়, সাহায্যে, সব ব্যাপারেই আমাদের ভেতরে স্থান পেয়েছে যে জড়তা, দৃষ্টিহীনতা, মনে আশা জাগছে, যেমন করেই হোক, এবার তার অবসান আসন্ন হয়ে এসেছে। কামালের প্রদত্ত এ আঘাতের বেদনাতেই হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারব- সত্যিকার ধর্ম জীবন কী, জীবনের সঙ্গে শাস্ত্রের সত্যকার সম্বন্ধ কী। হয়তো আরও উপলব্ধি করতে পারব, জীবন সমস্যার চরম সমাধান কোনোকালেই হয়ে যায়নি, নতুন করে সেসব বিষয়ে সচেতন হওয়া আর তার মীমাংসা করতে চেষ্টা করা- এই-ই জীবন। ওদুদ সফল না ব্যর্থ এই বেদনাক্লিন্ন মন কেবল গুমরেই মরে। বাম জমানাতে বাংলা আকাদেমি থেকে একটি ভুলে ভরা ওদুদ জীবনী ছাড়া তার কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। বস্তুত অন্নদাশঙ্করের প্রভূত চেষ্টার পর রেজাউল করীমের একটি প্রবন্ধ সংকলন ছাড়া বাঙালি মুসলমানের কোনো সৃষ্টিই সে সময়ে বাংলা আকাদেমী থেকে প্রকাশিত হয়নি।
বিস্মৃত মানবপ্রকৃতি বেত্তা কাজী আবদুল ওদুদের মৃত্যুদিন (১৯ শে মে) স্মরণের একটা ছোট উদ্যোগ মানুষ নিয়েছিলেন। উদ্যোগকারীদের একাংশের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ প্রত্যক্ষ থাকাতে সেই উদ্যোগে কতখানি আন্তরিকতা আছে তা নিয়ে প্রথম থেকেই একটা সংশয় ছিল। কুড়ি বছর আগের অভিজ্ঞতার নিরিখে সেই উদ্যোগী মানুষ গেলেন ওদুদের বাড়িটা যিনি কিনেছেন তার কাছে। দেখা গেল; ওদুদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটা আর নেই। সেই জায়গাতে মাথা তুলেছে পেল্লায় ফ্ল্যাট। কুড়ি বছর আগে যে মানুষটি ওদুদের প্রতি এত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তার সঙ্গে দেখা হল না। তিনি বাড়ির ভেতরে থেকেও দেখা করলেন না। ওর ছেলের কাছেই আবেদন জানানো হল; ওদের ফ্ল্যাটে ঢোকার প্রশস্ত জায়গায় এক ঘণ্টার এই স্মরণ অনুষ্ঠানটি করার। ছেলেটির দেখা গেল মানসিক সম্মতি থাকলেও বাবার কথা না শুনে তখনই সে কিছু বলতে পারছে না। পরে বহু চেষ্টাতেই ওর বাবাকে যখন ফোনে ধরতে পারা গেল, যে মানুষটা কুড়ি বছর আগে ওদুদ সম্পর্কে শ্রদ্ধায় আপ্লুত ছিলেন, দেখা গেল; এখন তো এটা আমার বাড়ি বলে ফ্ল্যাটের লনেও ওদুদ স্মরণের অনুমতি দিতে নারাজ। অগত্যা আয়োজকরা ঠিক করলেন ওই বাড়ির সামনের ফুটপাতেই ছোট্ট অনুষ্ঠান করবেন। পুলিশের অনুমতিও মিলল। শেষপর্যন্ত দেখা গেল অনুষ্ঠানের দিন মূল আয়োজক পাহাড়ে বেড়াতে চলে গেছেন। ওদুদের একটা ছবিও শেষ অবধি জোগার করা গেল না। যদিও এই নেটদুনিয়াতে ছবি জোগার এখন কোনো সমস্যাই নয়। এপার বাংলার এতটা নির্লিপ্তি কি বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের এ ঋত্ত্বিকের প্রাপ্য ছিল?
এবি/টিআর