অনলাইন ডেক্স : ট্রেনটা যাওয়ার কথা ছিল ভারতে৷ সীমান্ত পেরিয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত৷ জীবন নিয়ে শতশত সংখ্যালঘু পূর্ব পাকিস্তানি তথা ব্যবসায়ী মাড়োয়ারি ও অন্যান্যরা দেশত্যাগ করছিলেন৷ ট্রেনটা কিন্তু যায়নি৷ তার কামরায়-রেল লাইনের পাশে পড়েছিল সেই যাত্রীদের মৃতদেহ৷ সংখ্যাটা ৪০০ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা বেশি৷

সরকারিভাবে স্বাধীনতার মরণপণ সংগ্রামের ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধের তথ্যে এর নাম ‘গোলাহাট গণহত্যা’৷ আর পাকিস্তানি সেনার নির্দেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া এই মারণ যজ্ঞের নাম ‘অপারেশন খরচাখাতা’৷ ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত ১৩ জুন দিনটি এখনও মনে ভয় ছড়িয়ে দেয় সেই গুটিকয় বেঁচে যাওয়াদের৷

মুক্তিযুদ্ধে আত্মবলিদান ও গণহত্যার নিরিখে বাংলাদেশে একের পর এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে৷ প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মদানে উপর ভিত্তি করেই একটি জাতি তার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে৷ আর সেই পর্বে সংঘটিত হয়েছিল গোলাহাট গণহত্যা৷ ঘটনাস্থল রংপুর বিভাগের সৈয়দপুর৷

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘ট্রেন’ উপন্যাসের পাতায় পাতায় রয়েছে এই গণহত্যার বিবরণ৷ আর সেদিন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন এখনও ভয়াল ১৩ জুনের কথা ভেবে শিউরে ওঠেন৷ খরচের খাতায় পাঠিয়ে দেওয়ার নীল নকশা করেছিল পাকিস্তান সরকার৷ তাদের প্রত্যক্ষ মদতদাতা হিসেবে গণহত্যায় সামিল হয় স্থানীয় উর্দুভাষী বিহারি সম্প্রদায়৷ একইসঙ্গে চলছিল অকুতোভয় স্বাধীনতার লড়াই-মুক্তিযুদ্ধ৷

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নীলফামারী মহকুমার সৈয়দপুরে দুটি গণহত্যা হয়েছিল৷ বাংলাদেশের অন্যতম সংবাদপত্র ‘যুগান্তর’-এ এর বর্ণনা দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা একেএম শামসুদ্দিন৷ তিনি লিখেছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দুটি জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। একটি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ফার্নেস চুল্লিতে কয়েকশ’ বাঙালিকে ছুড়ে ফেলে পুড়িয়ে ছাই করে মারা, অপরটি ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার নাম করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাট নামক স্থানে ট্রেনে করে নিয়ে বিহারিদের সহযোগিতায় ৪১৩ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা। ১৩ জুন গোলাহাটে মূলত হিন্দু মাড়োয়ারি ও বাঙালি হিন্দু তরুণ ও যুবকরা এ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করে ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বিহারি জনগোষ্ঠী’

ভারত ভাগ হওয়ার আগে থেকেই সৈয়দপুরের রেল কারখানা ঘিরে বিরাট কর্মকাণ্ড গড়ে উঠেছিল৷ সেখানে কাজ করতে আনা হয়েছিল বিহার মুসলিমদের৷ আর ব্যবসার কারণে এখানেই থিতু হন বহু মাড়োয়ারি৷ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরির পরেও মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের অনেকে থেকে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সৈয়দপুরে৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সৈয়দপুরকে ঘিরেই হয় গণহত্যা পর্ব৷ ২৩ মার্চের দিন শহর জুড়ে মাডো়য়ারি ও বাংলাভাষীদের খুনের পর্ব চলে৷ প্রথমে রেল কারখানার চুল্লিতে শতাধিক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়৷ ২৪ মার্চ পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের রুখতে স্থানীয় জননেতা মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু তাদেরই কচুকাটা করে পাকা সেনা ও বিহারী মুসলিমরা৷ এরপর তারপর ১২ এপ্রিল স্থানীয় সংখ্যালঘুদের ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গিয়ে ১৫০জনকে খুন করা হয়৷

এরপর পাক সেনার তরফে জানানো হয়, মাডো়য়ারিদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে ১৩ জুন৷ বিশেষ ট্রেনে তাদের সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া হবে৷ প্রাণ বাঁচাতে শয়ে শয়ে মাড়োয়ারি পরিবার সেই ট্রেনের সওয়ারি হয়েছিলেন৷ তার আগেই পাক সেনা স্থির করেছিল ‘অপারেশন খরচাখাতা’৷

বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা একেএম শামসুদ্দিন লিখছেন- ‘যাত্রীর সংখ্যা মোট ৪৩৬। যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার পরপর বগির সব দরজা ও জালানা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সকাল আনুমানিক ৭টায় চিলাহাটার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। খুব ধীরগতিতে চলতে চলতে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাটের বর্তমান লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেন থামার কারণ জানার জন্য যাত্রীরা জানালা ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অস্পষ্ট আলোতে দেখতে পান, অসংখ্য পাকিস্তান সেনাসদস্য ও বিহারি পুলিশ রেললাইনের দু’দিকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুখে কাপড় বাঁধা একদল বিহারি। তাদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে রামদা কিংবা তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরি। এর পরই শুরু হয় মানবতার ইতিহাসের বিশ্বাসঘাতকতার এক জঘন্যতম এপিসোড; শুরু হয় হত্যার উৎসব। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রধারী বিহারিরা প্রতিটি কামরায় ঢুকে একে একে সবাইকে নামিয়ে রামদা ও ছুরি দিয়ে জবাই করা শুরু করে।’

মৃতদেহের পাহাড়ে পরিণত হয় গোলাহাট৷ ভয়ঙ্ককরতম সেই দিন৷ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম রক্তাক্ত অধ্যায় হয়েই থাকবে দিনটি৷

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here